বরিশালে ঝাড়ুদার থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক

বরিশালে ঝাড়ুদার থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক

জেলা প্রতিনিধিঃ বরিশাল নগরীর একটি ক্লিনিকে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন মো. হোসেন শাহীন। তিনি প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। তার ভাই ইব্রাহিম রানা ফেরি করে ফল বিক্রি করতেন। সেসব কাজ ছেড়ে এখন তারা বরিশাল নগরীর আগরপুর রোড এলাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছেন।

প্যাথলজিতে ন্যূনতম দক্ষতা না থাকলেও তারা রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করে আসছিলেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন চিকিৎসকের স্বাক্ষর জাল করে রোগ নির্ণয়ের ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করতেন তারা।

অবৈধভাবে নগরীর আগরপুর রোড এলাকায় ভাড়া বাড়িতে ‘দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেস’ নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে রোগ নির্ণয় করতেন হোসেন শাহীন ও তার ভাই ইব্রাহিম রানা। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এভাবে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। তাদের প্যাথলজি পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্টে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

ভুয়া ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছেন আরও কয়েকজন। তাদের মধ্যে শ্যামল মজুমদার নামে নগরীর এক ব্যবসায়ীও রয়েছেন। তিনি দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেস ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একজন ব্যবসায়িক অংশীদার। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসার কাজে তাদের সহায়তা করতেন শ্যাম সাহা নামে এক যুবক।

আজ শনিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ‘দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেস’ সেন্টারে অভিযান চালান। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে এসব প্রত্যারণার তথ্য বেরিয়ে আসে। অভিযানে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিনিধি চিকিৎসক মুন্সী মুবিনুল হক উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেসের অন্যতম ব্যবসায়িক অংশীদার মো. হোসেন শাহীন একসময় নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঝাড়ুদারের কাজ করতেন। তবে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশিদিন টিকতে পারতেন না তিনি। ২০১৪ সালে লিমা নামে নগরীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি ঝাড়ুদারের কাজ নেন। অপকর্মের কারণে কয়েক মাস পর সেখান থেকেও তাকে বাদ দেয়া হয়। এরপর হোসেন শাহীন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবসার মূলধন সংগ্রহ করেন। এরপর বাসা ভাড়া নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে হোসেন শাহীন ও তার সহযোগীরা মিলে বিভিন্ন নামে নগরীতে অন্তত ছয়টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে ব্যবসা করেছেন। বর্তমানে হোসেন শাহীন দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক। তার নিয়ন্ত্রণে একটি দালাল চক্র রয়েছে। গ্রামাঞ্চল থেকে যেসব রোগী আসেন ওই দালাল চক্র তাদের শাহীনের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসেন। রোগী আনা বাবদ দালালদের দেয়া হয় মোটা অংকের কমিশন।

ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকলে শাহীন তার ভাই ইব্রাহিমকে ব্যবসায় যুক্ত করেন। ইব্রাহিম একসময় লঞ্চ টার্মিনাল ও বাস টার্মিনালে ফেরি করে ফল বিক্রি করতেন। তারা দুই ভাই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসে চিকিৎসকের সিল-স্বাক্ষর জাল করে প্যাথলজি রিপোর্ট দিতেন। দুই ভাইয়ের প্যাথলজি সংক্রান্ত কোনো ধরনের যোগ্যতা বা ন্যূনতম জানা শোনা নেই।

অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নগরীর আগরপুর রোড এলাকার দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেস নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিতে প্যাথলজিস্ট কোনো চিকিৎসক ছিল না। ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক জাকির হোসেন খন্দকার ও টেকনোলজিস্ট মো. মুজিবুর রহমানের সিল-স্বাক্ষর জাল করে দেয়া হয় প্যাথলজি রিপোর্ট। অথচ তারা ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসেন না। তাৎক্ষণিক মুঠোফোনে চিকিৎসক জাকির হোসেন খন্দকার ও টেকনোলজিস্ট মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা বলেন, দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেসের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। তারা ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনো দিন যাননি।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান আরও বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার ছাড়াও তারা প্যাথলজি পরীক্ষার রিপোর্ট চিকিৎসকের পরিবর্তে নিজেরাই দিতেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৭ সালে শেষ হলেও নতুন করে তা নবায়ন করা হয়নি। এসব অপরাধে দ্য মুন মেডিকেল সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী হোসেন শাহীন ও শ্যামল মজুমদারকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সহযোগী ইব্রাহিম রানা এবং শ্যাম সাহাকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি সিলগালা করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top