জেল সুপার ও কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি

PicsArt_07-22-09.51.23.jpg

জেল সুপার ও কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট 

বিশেষ রিপোর্টঃ ২২ মাস আগে দায়িত্বে থাকা জেলারের বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ। দুর্নীতির তদন্ত হয়েছে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণও পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু তদন্ত কমিটি এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের সঙ্গে আরেকজন সাবেক কর্মকর্তার নাম তালিকায় দিয়েছে। যে সময়ের দুর্নীতির ফাইল ধরে তদন্ত করেছে, তার ২০ মাস পূর্বে পদোন্নতি পেয়ে ওই কর্মকর্তা অন্য কর্মস্থলে যোগদান করেন। ফলে ওই সাবেক কর্মকর্তার নাম দুর্নীতির তালিকায় আসা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ওই কারাগারের সাবেক জেলার এস এম মহিউদ্দিন হায়দারের নাম দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো: শহিদুজ্জামান বলেন, এ রকম অভিযোগ পেয়েছি আমরা। বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’

কারা সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি নতুন কর্মস্থল বাগেরহাট জেলা কারাগারে জেলার হিসাবে যোগ দেন এস এম মহিউদ্দিন হায়দার। গত বছরের নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের দুর্নীতি তদন্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং উপ-সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি গত বছরের ১৬ ও ১৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলা কারাগার সরেজমিন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে একজন ডিআইজি, কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারের ক্যান্টিনের ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১৬ মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয়। কারাগারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এই ১৬ মাসে ক্যান্টিন থেকে আয় করেছে ৩৩ লাখ ১ হাজার ৭৪৩ টাকা। এই সময়ের মধ্যে ক্যান্টিনের পেছনে কারা কর্তৃপক্ষ ব্যয় করেছে ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৮ টাকা। অর্থাৎ ক্যান্টিন চালাতে গিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত খরচ করেছে। ক্যান্টিন পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী বন্দি ও কারারক্ষী কল্যাণে খরচ দেখানো হলেও বিল ভাউচার পরীক্ষা এবং বন্দি ও কারারক্ষীদের বক্তব্য অনুযায়ী মূলত তাদের কল্যাণে কোনো টাকা খরচ করা হয়নি। জেল সুপার নিজের ইচ্ছামত ক্যান্টিনের লভ্যাংশ খরচ করেছেন। কারারক্ষী ও বন্দিদের কাছে জেলারের দায়িত্বে নিয়োজিত ডেপুটি জেলার আমিরুল ইসলামের কোনো গুরুত্ব নেই। সব কিছু জেল সুপার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। প্রত্যেক মাসে কারা ক্যান্টিনের লভ্যাংশের টাকা বিধি বহির্ভূতভাবে খরচ দেখিয়ে জেল সুপার ও হিসাব রক্ষক কুক্ষিগত করেছেন। এ ক্ষেত্রে জেল সুপার জাকের হোসেন এবং হিসাব রক্ষক আজহার আলীর আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি স্পষ্ট।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই ১৬ মাসে তাদের দায়িত্বকালে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের খাদ্য হিসেবে সরবরাহকৃত সবজি, মাছ, মাংস ও ডাল নিম্নমানের ছিল। বন্দিদের নির্ধারিত ডায়েটস্কেল অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ খাবার সরবরাহ না করে বরাদ্দকৃত অর্থ তারা আত্মসাৎ করেছেন। কারাগারে আটক বন্দিদের নিকট থেকে বন্দি বেচা-কেনা, সাক্ষাত ও জামিন বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য চিকিৎসা বাণিজ্য, পিসি বাণিজ্য, পদায়ন বাণিজ্য এবং কারাভ্যন্তরে মাদক প্রবেশ বাণিজ্যসহ এসকল অনিয়ম জানা সত্বেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে জেল সুপার সেগুলো বন্ধ না করেননি। জেল সুপার অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতিমাসে বন্দিদের নিকট থেকে টাকা আদায়পূর্বক আদায়কৃত অর্থ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন। কারাগারের ভিতর মধ্যযুগীয় কায়দায় বন্দীদের চোখ ও হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালানো হয়। বন্দীদের নির্যাতন চালানোর পেছনে ৫ জন কারারক্ষীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এরা হলেন কারারক্ষী নুরুজ্জামান, সামসুল হক, মাহফুজুর রহমান, মজিবর রহমান ও তপন কুমার হাওলাদার।

কারাগারের ভিতর মাদকসহ নিষিদ্ধ মালামাল প্রবেশ ও বিক্রির পেছনে জেল সুপারের নিয়ন্ত্রিত কারারক্ষীরাই এই কাজটি করে থাকেন। এরা হলেন দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, সহকারী প্রধান কারারক্ষী শরিফুল ইসলাম, গেট চাবি কারারক্ষী সাইদুল ইসলাম, কারারক্ষী বাদল হোসেন, ফারুক রহমানসহ আরো ৫ জন কারারক্ষী।

যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ: ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে তদন্ত কমিটি এরা হলেন, কারারক্ষী আবু সাইদ, কারারক্ষী (অর্ডারলি) জিয়াউর রহমান, খাদ্য গুদাম সহকারী মনিরুজ্জামান, কারারক্ষী (ভর্তি শাখা) মাহাবুবুর রহমান, মামুন হোসেন-১, কারারক্ষী (উৎপাদন শাখা) সোহেল রানা, কারারক্ষী ( গেট অর্ডার) দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, গেট চাবি কারারক্ষী সাইদুল ইসলাম, বাদল হোসেন, ফারুক আহম্মেদ, ডিউটি বণ্টনকারী কারারক্ষী মজিবার রহমান, সহকারী প্রধান কারারক্ষী শরিফুল ইসলাম, কারারক্ষী আনিচুর রহমান, হারুন অর রশিদ, মাসুদ রানা, আরিফুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, আশিকুর রহমান, রাশেদুল ইসলাম, মামুন হোসেন-২, জসিম উদ্দিন, আমিরুল ইসলাম, আফছার হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম রেজা, নুরুজ্জামান, সামসুল হক, মাহফুজুর রহমান, প্রধান কারারক্ষী শফিকুল ইসলাম, মজিবর রহমান, তপন কুমার হালদার, হিসাব রক্ষক আজহার আলী, প্রাক্তন জেলার এস এম মহিউদ্দিন হায়দার এবং জেল সুপার জাকের হোসেন সরাসরি জড়িত। এদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করছে তদন্ত কমিটি। এর পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার কারণে যশোর বিভাগীয় ডিআইজির বিরুদ্ধে বিধিগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। তদন্ত কমিটির এই তদন্ত চলাকালে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের সাবেক জেলার এস এম মহিউদ্দিন হায়দার বাগেরহাট জেলা কারাগারের সিনিয়র জেলার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এ ব্যাপারে বাগেরহাট জেলা কারাগারের জেলার এস এম মহিউদ্দিন হায়দার বলেন, ২০১৬ সালের ৫ জুন থেকে ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত আমি কুষ্টিয়া কারাগারের জেলার হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। আমার দায়িত্ব পালনের পর তদন্ত কমিটির তদন্ত চলাকালীন পর্যন্ত আরো ৪ জন জেলার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যে সময়ে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে-ওই সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অথচ আমি বুঝতে পারছি না কি কারণে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হলো? আমার কোনো বক্তব্যই নেয়নি তদন্ত কমিটি। দুর্নীতি তদন্তের সময়কালে তো কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে কোনো দায়িত্বেই আমি ছিলাম না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top