সব সত্য কী লিখা যাবে – শংকর মৈত্র

PicsArt_07-16-12.18.13.jpg

।। স্মৃতির পাতায় কতো স্মৃতি।।
২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের সময়(ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিন এর শাসনের সময়) আমি ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলাম। সে সময় বেশিরভাগ কাজ করেছি হাইকোর্টে ও দুর্নীতি দমন কমিশন আর সংসদ ভবনের ক্যাঙ্গারু কোর্টে। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতারা জেলে। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিচ্ছে দুদক, দুর্নীতির তালিকা প্রকাশ করছে ঘটা করে । মনে আছে দুদকের সচিব ছিলেন মনে হয় দেলোয়ার হোসেন নামের একজন। তিনি প্রথম দিন ঘটা করে ৫০ জনের তালিকা প্রকাশ করলেন যাদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক নেতা। এদের সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়।
কিছুদিনের মধ্যেই সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বিচার শুরু হয়। একের পর এক রায় হচ্ছে। প্রতিদিন বিশাল বিশাল নিউজ। রায়ে ১৩ বছর নিচে কোনো কারাদণ্ড নেই । ক্যাঙ্গারু কোর্টে আমাদের সাংবাদিকদের সে কি ব্যস্ততা। দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের ভীড়। বিশেষ পাস নিয়ে ঢুকতে হতো। পুলিশ গোয়েন্দা আর সাংবাদিক। এই তিন পেশার লোক মাঠে। রাজনৈতিক কর্মিরা তখন দৌঁড়ের ওপর।
অশোক দা (অশোক চৌধুরী, বর্তমানে হেড অব নিউজ, বৈশাখী টিভি,তখন ছিলেন এটিএন বাংলায়) মাণিক ভাই ( জুলফিকার আলী মাণিক, বর্তমানে নিউইয়র্ক টাইমসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি, তখন ছিলেন ডেইলি স্টারে) আর আমি। তিনজন ছিলাম ত্রিফলার মতো। নিউজ জোগাড় করে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে কাওরানবাজারের চারুলতায় ছিল বিশ্রাম সময়। খেতে খেতে নিউজ সাজানো। কাওরানবাজার থেকে বাংলামটর অফিসে হেঁটে যেতে যেতে মাথায় নিউজ তৈরী হয়ে যেতো। কম্পিউটারে বসে কি ভাবে যে হাজার খানেক শব্দের নিউজ লিখা হয়ে যেতো এসব ভাবলে এখন আশ্চর্য হই।
সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। কতোজনের কতো রূপ দেখেছি। রাজনৈতিক নেতাদের অসহায়ত্ব দেখেছি। আমলাদের কামলা বনে যেতে দেখেছি। কতো বড় বড় আইনজীবীকে পালিয়ে যেতে দেখেছি। শেখ হাসিনার নাম নিয়ে যেসব আইনজীবী নেতা খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেছিলেন, শেখ হাসিনা জেলে গেলে তাদের অনেকেই একটা বিবৃতিতেও স্বাক্ষর দিতে রাজি হননি, ওকালতনামায় স্বাক্ষর দেননি। এমন ঘটনা কাছ থেকে দেখেছি। মেজর,ক্যাপ্টেনদের ভয়ে কতোজনকে তটস্থ থাকতে দেখেছি। কতোজনকে রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যেতে দেখেছি। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার কতো তত্ব শুনেছি। এসব লিখতে গেলে বিশাল ইতিহাস হয়ে যাবে।
আমি মনে করি সাংবাদিকরা বিশেষ করে মাঠের রিপোর্টাররা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাক্ষী থাকেন। কারণ সংবাদ সংগ্রহে তাদেরকে সব স্থানেই যেতে হয়,সব মতের কথা শুনতে হয়। সময় সুযোগে কে কি বলেন তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকেন মাঠের সাংবাদিকরা। যে ভাবে ওয়ান ইলেভেনের কতো ঘটনার সাক্ষী আমরা।
২০০১ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন,ক্ষমতার পরিবর্তনটা সচেতনতার সঙ্গে দেখেছি, সেই তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন, তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মামলা( ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলা), এনিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে দুপক্ষের আইনজীবীদের হামলা, ভাংচুর, প্রধান বিচারপতির ভূমিকা, এটর্নি জেনারেলের ভূমিকা, এজলাস ভাংচুর, রাজপথে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা, বিচারপতি কেএম হাসানকে নিয়ে বিতর্ক,বিচারবিভাগ পৃথক করণের সেই ঐতিহাসিক মামলা ( মাসদার হোসেন মামলা) এর সবকিছুইতো খুব কাছ থেকে দেখেছি। সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি। ইতিহাসের এ অংশগুলো নিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষন করলে খুব কি খারাপ হবে? সব সত্য কী লিখা যাবে? খুব ইচ্ছে হয় লিখি।

শংকর মৈত্র
সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top