আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না – তসলিমা নাসরিন
‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’, এ কথা শুধু জর্জ ফ্লয়েডের মুখ থেকে বেরোয়নি। এরিক গারনারের মুখ থেকেও বেরিয়েছিল যখন মাটিতে ফেলে পুলিশেরা তার গলা চেপে ধরেছিল। এরিক বলছিল, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। কিন্তু তারপরও পুলিশেরা এরিকের কণ্ঠদেশ থেকে তাদের শক্ত বাহু সরিয়ে নেয়নি। কী দোষ ছিল এরিকের? সিগারেট বিক্রি করছিল, যে সিগারেট বিক্রিটা বৈধ ছিল না।
কী দোষ করেছিল জর্জ ফ্লয়েড? কুড়ি ডলারের জাল নোট দিয়ে এক দোকান থেকে সিগারেট কিনেছিল। আরও দোষ তাদের ছিল, এরিক আর জর্জ দুজনেই কালো, দুজনই দরিদ্র। আজ আমেরিকার লক্ষ লক্ষ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করছে। এরিকের জন্যও ঠিক একই রকমভাবে ২০১৪ সালে সারা আমেরিকাজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী মিছিল বেরিয়েছিল। একই রকমভাবে মানুষ তখন স্লোগান দিয়েছিল ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’। এখন যেমন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ প্ল্যাকার্ডে লিখছে, ‘কালোদের জীবনও জীবন’।
তখনও তাই করেছিল।
আমেরিকায় তখন কালো প্রেসিডেন্ট। আর কালো লোকদের মেরে চলেছে সাদা পুলিশেরা। ২০১৪ সালেই মিসৌরির ফার্গুসনে এক সাদা পুলিশ মাইকেল ব্রাউন নামের কালো একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ছ’টি বুলেট ঢুকেছে মাইকেলের শরীরে। পুলিশের দাবি, মাইকেল এক দোকান থেকে সিগার চুরি করার চেষ্টা করেছিল। কেউ সিগার চুরি করতে চাইলে কোনও পুলিশের অধিকার নেই তাকে মেরে ফেলা। ফার্গুসনে সেদিনও প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছিল।
পুলিশের নৃশংসতা নতুন ঘটনা নয়। পুলিশি হেফাজতে গ্রেফতার হওয়া মানুষের মৃত্যুও নতুন ঘটনা নয়
নৃশংসতা এবং হত্যার শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে কালো লোকের সংখ্যাটা বরাবরই বেশি, এও নতুন ঘটনা নয়। তবে নতুন কী? নতুন এটিই, কথা ছিল ঘর থেকে বের না হওয়ার, কথা ছিল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার, সেই কথা কেউ রাখছে না বা রাখতে পারছে না। নিজের জীবন বাঁচানোর চেয়েও জরুরি হয়ে উঠেছে অন্যের জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম। পৃথিবীতে হঠাৎ উদয় হওয়া ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস ১ লক্ষেরও চেয়ে বেশি প্রাণ নিয়েছে যে দেশে, সে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনার ভয়ডর উপেক্ষা করে হত্যার প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছে।
বর্ণবাদ আমেরিকায় নতুন কিছু নয়। শুধু পুলিশে নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠানেই এটি আছে। সুপ্ত অবস্থায় আছে। কিন্তু আছে। আছে লক্ষ লোকের অন্তরে। বর্ণবাদ আমেরিকায় ভাইরাসের মতো আছে, ৪০০ বছর ধরে আছে। এই ভাইরাসের কোনও ভ্যাক্সিন এখনও বানানো হয়নি। ১৬১৯ সালে আমেরিকার জেমসটাউনে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা একটি লোককে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। তখন থেকেই বর্ণবাদ চলছে, বৈষম্য চলছে, আজও চলছে। তবে এটা ঠিক, বৈষম্য আগে যে রকম বিপুল পরিমাণে ছিল, সেরকম এখন আর নেই। অনেক কমেছে। এক সময় কালোদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কালো ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করার অধিকার সাদাদের ছিল। ইচ্ছে হলে মেরে ফেলারও অধিকার তাদের ছিল। সেই দিন আর নেই। শত বছরের আন্দোলনের ফলে এখন ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। আইনের চোখে আমেরিকায় কালো সাদা বাদামি হলুদ সব মানুষ সমান। কিন্তু ঘৃণা কি এত সহজে উবে গেছে সাদাদের মন থেকে? এত সহজে এ যাওয়ার নয়। যে বৈষম্য একসময় বৈধ ছিল সর্বত্র, সেই বৈষম্য রাষ্ট্রে, প্রতিষ্ঠানে না থাকলেও সমাজে সংসারে তো আছেই। না থাকলেও মনে আছে, মনের গভীরে। কার মনের গভীরে কালো ত্বকের প্রতি ঘৃণা কিলবিল করছে, তা কে বুঝবে! পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনকে দেখে কেউ কি বুঝতো যে কালোদের ওপর ঘৃণা তার এত বেশি যে কালোদের খুন করতেও সে দ্বিধা করবে না? আমেরিকার সমস্যা ভেতর-ঘরেই। অন্তরেই।
আমেরিকার বর্ণবাদ শুধু কালোদের বিরুদ্ধে নয়, যে সাদা নয় তার বিরুদ্ধেই। বাদামি হলুদদের বিরুদ্ধে। যে ক্রিশ্চান নয়, তার বিরুদ্ধেও। আরব, মুসলিমদের বিরুদ্ধে। কিছু ক্ষেত্রে এমনকী ইহুদিদের বিরুদ্ধেও। এখন প্রশ্ন হলো, বর্ণবাদ কি শুধু আমেরিকায়? শুধু ইউরোপে? বর্ণবাদ এশিয়া আর আফ্রিকায় নেই? ইউরোপ আর আমেরিকায় আফ্রিকা থেকে লোক ধরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে ক্রীতদাস বানানো হয়েছে। এশিয়া আফ্রিকায় কিন্তু নিজের লোকদেরই নিজেরা ক্রীতদাস বানিয়েছে।
বর্ণবাদ জঘন্যভাবে পালিত হয়েছে আমেরিকায়, আবার এই আমেরিকাতেই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এশিয়া আর আফ্রিকায় কিন্তু বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন হয়নি। আগের চেয়ে বর্ণবাদ অনেক কম এখন, তারপরও আমেরিকায় একটি মৃত্যু ঘিরে তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যায়। পথে নামে কালোরা। তারা তো নামবেই। কিন্তু মুগ্ধ হই যখন সাদারা নামে। যখন মিছিলের অগ্রভাগে থাকে সাদারা। যখন পুলিশের সংগে সংঘর্ষে নামে সাদারা। যখন সাদাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, আই ক্যান’ট ব্রিদ, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। এর নাম সহানুভূতি, সহমর্মিতা, মানবতা। এর নাম সভ্যতা।
এ শুধু কালোদের সংগ্রাম নয়। এ আমেরিকার সাদা কালো বাদামি হলুদ সবার সংগ্রাম। পুলিশের বর্বরতার বিরুদ্ধে, নৃশংসতার বিরুদ্ধে, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। সমতার পক্ষে, সমানাধিকারের পক্ষে সংগ্রাম। একটি সুষ্ঠু সভ্য সমাজ গড়ার জন্য আজ করোনাভাইরাসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছে। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আজ অবধি প্রতিবাদীদের সংগে একাত্ম বোধ করে কোনও ভাষণ দেননি, যে ভাষণ শুনে মানুষ আশ্বস্ত হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধুই সামনের নির্বাচনে জেতার স্বপ্ন দেখছেন। করোনাভাইরাসের মহামারী নিয়েও তিনি ছেলেখেলা করেছেন, বর্ণবাদের মহামারী নিয়েও তিনি একই কাজ করেছেন। যারা লুট করছে, আর যারা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছে, তাদের এককাতারে ফেলে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। অশোভন কথা বলছেন। ট্রাম্প সম্ভবত নির্বাচনে জিতবেন না। তিনি চলে গেলে নতুন কোনও প্রেসিডেন্ট আসবেন, কিন্তু বর্ণবাদের কি অবসান হবে? যেহেতু শ্রেণি বৈষম্য বহাল তবিয়তে বিদ্যমান, তাই বর্ণ বৈষম্যও শ্রেণি বৈষম্যের সংগে হাতে হাত রেখে হাঁটবে। আমেরিকার দরিদ্রের মধ্যে অধিকাংশই কালো, শিক্ষা স্বাস্থ্য থেকে তারাই বেশি বঞ্চিত। সুতরাং ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে বসে পোকা মাকড়ের মতো তাদের মেরে ফেলতে খুব একটা কারোর অসুবিধে হয় না।
একটি কালো লোকের পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে, এটি খবর হলে আমেরিকায় আগুন জ্বলতো না, ভিডিওটিতে হত্যার নির্মম দৃশ্যটি দেখেই মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। অন্যায় আর অত্যাচারের শিকার অনেকেই হচ্ছে, প্রতিদিনই হচ্ছে, হঠাৎ একটি অন্যায় মানুষকে নাড়ায়, একটি হত্যা মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, একটি বিপ্লব সমাজ পরিবর্তন ঘটায়। সমাজ পরিবর্তন করার জন্য চিরকালই উদার এবং স্বপ্নবান মানুষেরা উদ্যোগ নিয়েছে।
যেভাবে মানুষ জেগে উঠেছে, আমেরিকায় যেটুকু বর্ণবাদ অবশিষ্ট আছে, সেটুকু কোনও একদিন বিলুপ্ত হবে, এই আশা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কেউ তো পথে নামে না। একে তো নারীবিদ্বেষ, তার ওপর বর্ণবিদ্বেষ। কালো মেয়েদের প্রেম হয় না, বিয়ে হয় না। ত্বক ফর্সা করার কেমিক্যালে ছেয়ে গেছে বাজার। এইসব কেমিক্যাল ত্বকের ক্ষতি করে জানার পরও কালো মেয়েরা বাধ্য হয় এইসব ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার করতে। শুধু বর্ণ নয়, ভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ তো উপমহাদেশে কম আগুন জ্বালায়নি, কম মানুষকে উদবাস্তু করেনি, সর্বস্বান্ত করেনি! কম মানুষকে হত্যা করেনি। তারপরও এই বিদ্বেষের কোনও কমতি নেই।
আমেরিকায় যেমন কালোদের ওপর অত্যাচার হলে সাদারা প্রতিবাদ করে… এমন কেন সারা পৃথিবীতে হয় না, কেন আমাদের এই উপমহাদেশেও হয় না? এখানে হিন্দুরা আক্রান্ত হলে মুসলমানরা প্রতিবাদ করবে, মুসলমানরা আক্রান্ত হলে হিন্দুরা প্রতিবাদ করবে! এই সহানুভূতি না থাকলে সমাজে বিদ্বেষ আর বৈষম্য টিকে থাকবেই। সংখ্যালঘুর সমস্যা ঘোচানোর জন্য আন্দোলন সংখ্যাগুরুকেই করতে হয়, চিরকালই করতে হয়েছে। এশিয়ায় যত বৈষম্য, সত্যি বলতে তত বৈষম্য ইউরোপ আমেরিকায় নেই। ওদের বৈষম্য চোখে পড়ে, কারণ ওদের বৈষম্যের প্রতিবাদ করে ওরা ব্যাপকভাবে, আমাদের সমাজের বৈষম্য যেমন আছে, তেমন থাকে, কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ হয় না। পুলিশি হেফাজতে আমাদের কম মানুষের মৃত্যু হয়েছে? কিন্তু কেউ পথে নামেনি। কাপড়ের আড়ালে ঘা লুকিয়ে রাখলে সেই ঘা হয়তো দেখা যায় না, কিন্তু সেই ঘা না সারালে অসুস্থ হয়ে সারাটা জীবন কাটাতে হয়। সুস্থ সভ্য সমাজ চাইলে সব রকম অন্যায়, সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
নিজেদের বৈষম্য ঘোচানোর চেষ্টা যে করে না, সে অন্যের সমাজের বৈষম্যের দিকে আঙ্গুল তুলে নিন্দে করে, নির্লজ্জ হলেই করে। এমন নির্লজ্জের সংখ্যা আমাদের সমাজে প্রচুর। নিঃশ্বাস নিতে না পারা মানুষ যে আমাদের কত, তা কি আমরা গুনে শেষ করতে পারবো কোনওদিন? পারবো না।