হস্তরেখা – সাগর চৌধুরী
আমি আর খালেদ একই সাথে পড়াশুনা করতাম। একই মহল্লায় পাশাপাশি থাকতাম। স্কুলে পড়ার সময় আমরা তুই তোকারী করে কথা বলতাম।
কখনো কখনো নদীতে নেমে পড়তাম ছোয়াছুয়ি খেলার জন্য। নদীর পাড়ে বেঁধে রাখা নৌকা নিয়ে নদীর এপার থেকে ওপাড় পাড়ি দিতাম। এক সাথে স্কুলে যেতাম, স্কুল পালিয়ে কির্তনখোলা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম; এই পাড়ে শহর অন্য পাড়ে বালুচড়, ইটভাটা, ধানখেত, ফসলের মাঠ, কির্তনখোলার পাড়ে ফুটবল খেলা, দারিয়াবান্ধা খেলা, আজো মনে পড়ে। কত স্বপ্নের মতো মনে হয় সেই সব দিনগুলো! ছোট্টবেলার সেই কির্তনখোলা!
বরিশাল শহরের সকল ময়লা, আবর্জনা কির্তনখোলার পানিতে ফেলতো, এসব জঞ্জাল দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো। আমার কাছে মনে হতো নদীটাকে সবাই ঘড়ের পাশে নর্দমা মনে করতো। ভালো লাগতো এই দেখে; কির্তনখোলার পানিতে এত জঞ্জল ফেলা হতো; তার পরদিন গিয়ে দেখতাম ঝকঝকে জলের রুপালি হাসি। এই হাসি দেখে আমার মন ভরে যেত, আমি যেন হারিয়ে যেতাম। কিন্তু খালেদের মনে কি হতো আমি জানি না।
খালেদের নানা রকমের উদ্ভট চিন্তাভাবনা ছিল। আমি মাঝে মাঝে কেমন যেন চিন্তায় পড়ে যেতাম ওর কাজ দেখে। একদিন জেলা স্কুলের পাশ দিয়ে কালেক্টর ভবনের সামনের রাস্তা হয়ে কির্তন খোলার পাড়ে যাচ্ছি।
এমন সময় খালেদ বললো চল আমরা আজ হাত
দেখাবো।
বললাম, কেন?
দেখি আমি বড় হয়ে কি হতে পাড়ি!
হাত দেখে কীভাবে জানা যায়, আমার হাত দেখে তুই বলতো বড় হলে আমি কী হব?
আমার দিকে একটু ডান কাত হয়ে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ও এমন একটা ভাব করলো আর বললো, দূর বোকা। আমি কি করে বললো অ্যাঁ। হাত দেখার লোক তো কোর্টের সামনে বসে আছে। চল আজ হাত দেখাবো। আমি একটু উৎসাহী হয়ে বললাম তাহলে আমারটাও দেখাবো।
এবার খালেদ একটু থেমে বললো, তোর কাছে দুই টাকা আছে। বললাম আছে।
টাকার কথা কেন খালেদ ?
হাত দেখাতে টাকা লাগে না ।
ও আচ্ছা। বললাম আমি।
কোর্টের সামনে এক বুড়ো টিয়ে পাখি নিয়ে বসে আছে, চটের মতো এক প্রকার চাটাইয়ের উপর, লোকটার পাকা দাড়ি চুল; দু’কান বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে ঠিক যেমন বট গাছের শিকড় বাকড়ের মতো। চোখ দুটো কোঠরাগত, মনে হলো পৃথিবীর সব ঘুম তার চোখে হরতাল ডেকেছে। চোখের মনি দুটো বাসি জবাফুলের মতো রং দেবে গেছে।
পরনে চিটচিটে ময়লা একটা ফতুয়ার মতো, তবে সেটা কবে যে সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধোয়া হয়েছে বলা মুশকিল।
লোকটার সামনে খালেদ হাত বাড়িয়ে দিল। হাতের রেখাগুলোর ডান বাম দেখতে দেখতে রাশ ভারী কণ্ঠে বুড়ো বললো, বাবা কি করে ?
জর্জ কোর্টের উকিল। উত্তরে বললো খালেদ।
তারপর হাত দেখে বললো, তুমি বড় হয়ে ডাক্তার হবা। তোমার ভবিষ্যৎ খুব ভালো। তুমি সুন্দর ছেলে, ভালো ছেলে। আর শোনো; মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবা।
কথাগুলো শোনার সাথে সাথে খালেদের চোখে মুখে কেমন যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। এত আনন্দ আগে কখনো দেখিনী ওর। খালেদ খুশি হয়ে পাঁচ টাকার একটা নেট বের করে দিল।
আমি ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম, কথাগুলো শুনছিলাম সব। এবার খালেদ আমাকে দেখিয়ে বললো; ও হাত দেখাবে।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এস সামনে এস । আমি তার সামনে এগিয়ে গেলাম। আমাকেও সেই একই প্রশ্ন; বাবা কি করে? বললাম তহশিল অফিসের ক্লার্ক।
মুখটাকে বাংলা অংকের পাঁচের মতো করে হাতটা
টেনে নিয়ে কিছু না দেখেই বললো, তুমি আর কি হবা? তোমার তো হাতের রেখাই নেই।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল; আমার বন্ধু হবে ডাক্তার আর আমি কি হব? আমার তো হাতের রেখাই নেই।
অবশ্য খালেদ পরে বলেছিল, আমাকে তখন দেখতে নাকি অনেক ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিল। হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো বুড়ো; তোমার ভবিষ্যৎ খুব খারাপ।
জানি না সেদিনের কথা কতটুকু মনে প্রভাব ফেলেছে খালেদের, তবে সেদিন রাতে আমার তেমন ঘুম হয় নি। সারা রাত সেই কথা মনে করে ঘুমাতে পারি নি। শুধু একটা কথাই মনে বার বার বেজে উঠেছিল, আমার তো হাতের রেখাই নেই।
আমাদের বাংলা ক্লাসের টিচার একদিন একটা রচনা লিখতে দিল ক্লাসে। বড় হয়ে কি হতে চাই।
সেখানে খালেদ লিখলো ডাক্তার হব। ক্লাসের টিচার ওকে খুব বাহবা দিল।
আমার খাতায় লিখলাম, এক বুড়ো আমাকে বলেছে আমি কিছুই হতে পারবো না। আমার নাকি হাতের রেখাই নেই।
স্যার আমাকে ডেকে পাঠালো আর বললো, বুড়ো তোমাকে কি বলেছে এটা বড় কথা না; তুমি কি হতে চাও এটাই বড় কথা। সেদিন পণ করেছিলাম আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। খালেদ তো ডাক্তার হবেই।
2.
বাবার বদলির চাকরি বলে আমাদেরও স্কুল বদল করতে হয়। আমরা বরিশাল ছেড়ে চলে এলাম চাঁদপুরে। পিছনে ফেলে এলাম কির্তনখোলা নদী, বরিশাল শহর, ভিলেজপার্ক, আমার স্কুল,বগুড়া রোড আর খেলার সঙ্গি পরেশ সাগর মাঠ। যাদের নাম বললে এখনও অনেকে চিনতে পারেন সেই সব বন্ধু খালেদ সহ। অনেকেরই ঠিকানা পরে আর খুঁজে পাইনি।
এসএসি পাস করে ভর্তি হলাম ঢাকার এক কলেজে। সেখান থেকে ইউনিভার্সিটিতে।
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে বিসিএস দিয়ে হলাম পাবলিক সার্ভিস আফিসার। ফরিদপুরে জয়েন করলাম। অনেক পুরনো এক শহর। বাবার মুখে ফরিদপুরের অনেক গল্প শুনেছি।
কবি জসিমউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি। আরো কত ইতিহাসের এই ফরিদপুর দ। আব্বারও প্রথম জয়েন এই ফরিদপুরে।
আনন্দ আর উৎসাহ নিয়ে জয়েন করলাম ফরিদপুরে।
৩.
আমার চাকরির সুবাধে আম্মা-আব্বা এখানে বেড়াতে আসবেন।
অফিসের এক জুনিয়র কলিগকে বললাম, আমার জন্য প্রাইভেট কার ভাড়া করতে যেহেতু বাবার এই শহর আগে
থেকেই চেনা, তাই তাদের নিয়ে একটু ঘুরে বেড়ানো।
ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ছিলাম বলে বাবার অনেক পছন্দের বিষয়গুলোও জানতাম। সকালবেলা অফিসে যাবো, এমন সময় আমার কলিগ বললো, স্যার গাড়ি ভাড়াটা একটু দরদাম করে নিয়ে নিন আর কবে প্রয়োজন ড্রাইভারের সাথে কথা বলে নিন। বললাম দরদাম আর কি করবো ?
ড্রাইভার কে বলেন, আগামী কাল সকালে আসতে আমরা রেডি থাকবো।
ড্রাইভার আমাকে সালাম দিয়েছে কিনা জানি না, তবে কে যেন একবার বললো, স্যার খুব ভালোলোক। ভারা নিয়ে বাঁধবে না আপনি সকাল সকাল চলে আসবেন।
খেয়াল নেই অফিসের তাড়াহুড়ায় আমি বের হয়ে গেলাম।
পরদিন সকাল সকাল ড্রাইভার এলো।
এসেই আমাকে বললো স্যার, কোথায় কোথায় যেতে
হবে আমাকে বলবেন।
বললাম, আচ্ছা বলবো।
আমি আম্মা-আব্বার সাথে নানা রকম কথায় মশগুল । আব্বার পুরনো অফিস, সে যেখানে থাকতো, কবি জসিমউদ্দীনের বাড়ি নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিকেলে যখন ফিরবো তখন ড্রাইভার বললো, স্যার আপনি কি কখনো বরিশালে ছিলেন ?
বললাম ছোটবেলায় ছিলাম আব্বা চাকরি করতো সেখানে। আমাকে চিনতে পারছেন।
স্যার?
সারাদিন পর এই প্রথম ড্রাইভারের দিকে তাকালাম।
লম্বা, রোগা, মুখে খোচাখোচা দাড়ি,গায়ে আধময়লা একটা শার্ট। পড়নে তালি দেওয়া একটা প্যান্ট। সামনের দিকে একটু ঝুকে পড়েছে।
অনেকক্ষণ এর সাথে আমার বাল্যবন্ধু খালেদের কোন মিল পেলাম না। মিল পাবারও কথা না। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছে। হাতে একটা কালো বেল্টের অল্পদামের ঘড়ি। মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
না। ফর্সা বর্ণ আমার বন্ধু খালেদ দেখতে মোটামুটি স্বাস্থ্যবান এবং শক্ত সামর্থ্য ছিল। তার দিকে তাকিয়ে বললাম না। আপনাকে এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় নাতো।
একটু সামনে এসে বললো, আপনি কি জেলা স্কুলে পড়তেন?
বললাম হ্যাঁ।
আমি খালেদ।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে; ও খালেদ।
৪.
অনেকদিন পর আমার ছেলেবেলার প্রিয় সেই কির্তনখোলার পাড়ে গিয়েছিলাম একবার।
বরিশালের সেই প্রাচ্যের ভেনিস নগরীতে। নগরীর রাস্তায় রাস্তায় আলোক বাতি, রাস্তার মোড়ে আধুনিক পানির ফোয়ারা। নতুন নতুন দালান কোঠা, অফিস-আদালত, আরো কত কি!
আমার সেই স্কুল, পরেশ সাগর মাঠ, বগুড়া রোড আরো কত খানে। কোর্টের সামনের রাস্তায় হাত দেখা সেই লোকগুলো। কির্তনখোলা নদীর সেই হাসি। সবই চিনতে
পেরেছিলাম শুধু খালেদকে ছাড়া।
আজ কাল ও আমাকে স্যার বলে ডাকে। আমি না শোনার ভান করে থাকি। আমার জুনিয়র কলিগ ওর জন্য সুপারিশ নিয়ে আসে। আমিও আশা করি ওর ভালো কিছু হোক। ও ভালো থাকুক।
সাগর চৌধুরী
প্রকাশক ও সম্পাদক।
গীতিকার
বাংলাদেশ বেতার।
বাংলাদেশ টেলিভিশন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।