সময়গুলো খেয়ে ফেলে গুলিস্তান। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি ফ্লাই ওভারের উপরে। আজও তেমনি বসে আছি। আজ বৃহস্পতিবার। সকল চাকরিজীবী আজ বাড়ি ফিরবে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কারো হাতে প্যাকেট, কারো পিঠে প্যাকেট, কারো হাতে লাগেজ।
চোখে মুখে নব উদ্দীপনা। আপনজনকে কাছে পাওয়ার আনন্দ। কারো জন্য হয়তো তার সন্তান অপেক্ষা করছে, কারো জন্য হয়তো তার মা অপেক্ষা করছে, কারো জন্য বোন, কারো জন্য প্রিয়তমা স্ত্রী অপেক্ষা করছে। আবার এমনও হতে পারে কারো জন্য তার প্রেমিকা অথবা প্রেমিক অপেক্ষা করছে।
অপেক্ষা যেই করুক অপেক্ষা তো করছে কেউ।
কারো জন্য অপেক্ষা যেমন আনন্দের তেমনি কারো অপেক্ষার মানুষ হওয়া আরো আনন্দের।
সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গুলিস্তানের যাত্রীরা অনেকেই নেমে পড়েছে। কিন্তু দূরের যাত্রীদের উপায় নেই, বসেই থাকতে হচ্ছে। আমিও তেমনি বসে আছি। কিছুক্ষণ গেলে দাঁড়াই, বাসের ভেতর সিট ধরে ধরে হাঁটি,মাঝে মাঝে গা ছমছম করে ওঠে। যাত্রী কেবল আমি আর পেছনে আর একজন ভদ্রলোক। আমি ভাবছি ভদ্রলোক কিন্তু আদতে ভদ্র কিনা জানি না। আপাতত ধরে নিচ্ছি ভদ্রলোক। তিনিও ঝিমুচ্ছেন। ড্রাইবার বড়বড় চোখ করে পেছনে তাকালেই আমার কলিজা হিম হয়ে যায়। ভয় তাড়ানোর জন্য একা একাই বকবক করছি, এতো এতো ফ্লাইওভার হলো তবুও এ ঢাকা শহরের জ্যাম গেলো না। আজ মনে হচ্ছে পুরো শহরই থেমে আছে।
আমি আছি বি আর টিসির দোতলা বাসে। দোতলায় কোন লোক আছে কি না জানি না। ভয় বাড়ছে। পাশের বাসের লোকদের দেখলাম কেউ ঝিমুচ্ছে,কেউ হাই তুলছে,কেউ মোবাইল ফোন ব্রাউজ করছে। আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। জানালায় চোখ রেখে আরো দূরের দৃশ্য দেখছি আর ভাবছি, মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা,ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হওয়া – এক গভীর রহস্য। যে রহস্য আজো উন্মোচন হয়নি বলেই মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাস বিভিন্ন বিষয়গুলো এসেছে।
এই জন্ম এবং জন্মানো কারো হাতে নেই। মানুষ যা করে তা আপন ক্রিয়া। এই ক্রিয়াই বা কেন প্রয়োজন,কেনই দেহাভ্যন্তরীণ জারন-বিজারণ,শিরা-উপশিরায় এতো প্রবাহ, কেন বিপরীত মেরুতে এতো আকর্ষণ!
কেন নারী অপেক্ষা করে পুরুষের জন্য
কেন পুরুষ অপেক্ষা করে নারীর জন্য?
এ অপেক্ষার রসায়নরহস্য আজো কেউ খুঁজে
পেয়েছে? পেলে বোধ হয় রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগের কারণ নিরাময় করতো। একবার ভেবে দেখা যাক রোগের কারণ নির্মূল করলে কী কী রোগ আবার নতুন করে বাসা বাঁধতে পারে?
প্রথমতঃ মানুষের এ সভ্যতা খুব দ্রুতই ধবংস হয়ে যেতো। যদি নতুন করে মানুষ না জন্মাতো তবে এই ভোগবাদী দুনিয়ার কোন রঙই থাকতো না। এই যে বাসে বসে আছি, এতো যে মানুষ ছুটোছুটি করছে নিজ গৃহে ফেরার জন্য তা কী থাকতো? গুলিস্তানের এ জ্যামও থাকতো না।
দ্বিতীয়তঃ ভোগ না থাকলে মানুষ নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠতো না। গ্রহ-নক্ষত্র,ধাতু- অধাতু, মৌলিক-যৌগিক পদার্থ নিয়ে কখনো ভাবতোই না।
আদম-হাওয়ার গন্ধম খাওয়া হতো না। আজকের পৃথিবীর রূপ দেখা হতো না।
তার মানে দাঁড়ালো নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণই এ পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু!
আসমত সাহেবের নতুন চাকুরি। পোস্টিং সিলেট। নতুনবউ ঘরে রেখে চলে যেতে হলো কর্মস্থলে। দিনশেষে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে খালিপায়ে হাঁটতে বের হয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের পাশে চলে এলেন। প্রকৃতির নানান উপচারের ভেতরও তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। দেখলেন ঝিকঝিক করে ট্রেন আসছে, চোরাকারবারিদের সুবিধার্থে ওই পয়েন্টে ট্রেন স্লো চলে। তিনি কোনকথা চিন্তা না করেই চেপে বসলেন ট্রেনে। ট্রেন চলে এলো আখাউড়া। রাত নিশি। চারদিকে জোনাকী পোকার মিছিল চলছে। সেই আলোয় তিনি দেখেন মরিয়মের মুখ। স্টেশন থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে সুবহি সাদিকের পরে মরিয়মের বাপের বাড়িতে হাজির হলেন। কিন্তু গায়ে গেঞ্জি, পরণে লুঙ্গি খালি পায়ে শ্বশুরবাড়ি কী ভাবে যাবেন? তাই সদর দরজা বাদ দিয়ে উলটো পথে মরিয়মের ঘরের জানালায় খটখট শব্দ করলেন।ভয়ে মরিয়মের কলিজা খাঁচা ছাড়া হবার দশা, রীতিমতো মূর্ছা গেলো যেন মরিয়ম। তখন গ্রামে ডাকাতি হতো এ ভাবে। মরিয়ম ডাকাত ভেবে অজ্ঞান। আসমত সাহেব ফিসফিস করে বললেন, চিল্লাইস না বউ, আমি তোর স্বামী। শব্দটি কানে যাবার সাথে সাথে মরিয়ম ভীমরতী খেলো যেন। দাঁড়ান, আইতাছি। এতো রাইতে কোথা থেইকা আইলেন? হারিকেনের আলো একটু বাড়িয়ে দরজার চিটকিনি খোলার সাথে সাথে তার দাদা জানতে চাইলো,মরি, এতো রাইতে সদর দরজা খুলতাছ কেন?
মরিয়ম কোন উত্তর দেয়নি। আসমত ঘরে ঢুকেই মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুম্বনে ডুবিয়ে দিলো। অবস্থা দেখে তার দাদা ঘুমের ভাণ করে পড়ে রইল। আসমত মরিয়মকে জড়িয়ে চারপা দুপা করে ভেতরে চলে গেলো। তার দাদা হো হো করে হেসে বললো, এইদিন আমাগোও ছিলো!
আসমত সে যাত্রায় পনের দিন অফিসে আসেনি। প্রতিদিন তাকে নিয়ে তার কলিগেরা রসালো আলাপ করতো, আজকের দিনের মতো মোবাইলফোন ছিলো না বলেই রক্ষা না হয় আসমতের কী হতো ভাবা যায়!
ভাবনায় ছেদ পড়লো, পাশের গাড়ির এক যাত্রী ফোনে কথা বলছে, আসছি মৌরি, এই তো বাস জ্যামে, পৌঁছাতে দশটা বাজার কথা কিন্তু মনে হচ্ছে অনেক রাত হবে।
-তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে নাও।
-একাই খাবা, কী করবা! দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, -তাতে সুবিধা, খাবার হজম হয়ে যাবে।
তারপর উচ্চহাসির শব্দে সবার ঘুম ভেঙে গেলো,লোকটি হাসছে আর বলছে, আসছি সোনাবউ। বাবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।তার জন্য জামা কিনেছি,কমলা কিনেছি,চকলেট কিনেছি।
-তোমার জন্য?
– তোমার লিপস্টিক, কাজল, চুড়ি কিনেছি।
তারপর হাসির শব্দ। লোকটির চোখে মুখে কী এক আনন্দের ঝিলিক দিয়ে গেলো, যেম অমৃতালোকের স্পর্শ পেয়ে জেগে ওঠেছে তার স্বর্গীয় প্রেমসুধা! হাসি হাসি মুখ করেই পরখ করছে গাড়ি ছাড়তে আর কতোক্ষণ!
চারদিকে সবার ফোন একটু পর পরই বাজছে।
কেউ বলছে, মা এইতো আসছি, তোমার ঔষধ কিনেছি। কেউ বলছে আব্বা চিন্তা করবেন না,গাড়িতে উঠেছি, বোনের বিয়ের জন্য সব কিনেছি। আপনি ঘুমান। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, অনেক রাত হবে।
একজন আবার রেগে আগুন- ওই মাতারি, এতোবার ফোন দেস ক্যান? তোরে না কইছি আইতাছি, এতো খিতখিতি ক্যান, আইয়া লই তোরে যদি টাইট না দিছি!
তার কথা শুনে আশেপাশের লোকেরা মিটিমিটি হেসে উঠলো।
রাত বাড়ছে, সবার চোখ ঢুলুঢুলু। তবুও আশার শেষ নেই!
ভোটের ঢামাঢোল চারদিকে। অবরোধের ভেতর রাস্তায় এতো জ্যাম, ভয় পাচ্ছি দুষ্কৃতিকারীরা যদি আগুন দেয়! বাসের হেলপার আগেই বাসেএ সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। পৌষের এই শীতেও দরদর করে ঘামছি। এই শহর তার বাসযোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। ভাঙাচোরা লক্কর ঝক্কর গাড়ি তো আর এসি নয় তার ভেতর দরজা জানালা সব বন্ধ। সাফোকেশনে মনে হচ্ছে মরে যাবো।
ভাবতে না ভাবতেই হলমার্ক্সের সামনে উৎসবের একটা গাড়িতে আগুন দিয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঘরে ফেরা মানুষের ভেতর আতঙ্ক এবং প্রাণ বাঁচানোর জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেলো। সব বাস দরজা জানালা খুলে দিয়ে পালান পালান চিৎকার করছে। ড্রাইভার, হেল্পার সবাই জান বাঁচানোর জন্য দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের সারির বায়া থেকে কেউ বের হতে পারছে না। বাসগুলো একটার সাথে একটা লাগানো। আমার গাড়িতে আমরা দুইজন যাত্রী ভয় শঙ্কা সব ভুলে খুব আপন হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক আমাকে গাড়ি থেকে নামানোর জন্য পথ খুঁজছে। আমি বললাম, আপনি বেরিয়ে যান। আমার জন্য অপেক্ষা করার কেউ নেই। তাই মরলেও সমস্যা নেই,আপনি চলে যান। আমরা দুজন দুজনের এতো আপন হয়ে গেলাম যে দুজনই দাঁড়িয়ে আছি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কোন দিক থেকে আসবে? সব রাস্তাই ব্লক।
একটার পর একটা গাড়িতে আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। লোকটা থরথর কাঁপছে। আমাকে জোর করে ধরে জানালা ভেঙে নিচে ফেলে দিলো।কিন্তু পাশের গাড়ির জন্য আমি আঁটকা পড়লাম। এবার ভদ্রলোক নিজেই ঠেলে ঠুলে ঠেসে ধরে বাস থেকে বের হয়ে শূন্যে আটকা পড়লো। তারপর বুদ্ধি করে পাশের গাড়ির জানালা ধরে উপরের দিকে উঠে
নামার উপায় খুঁজতে লাগলো। আমাকে কী ভাবে শাড়ির আঁচলে বেঁধে টেনে উপরে তুলে ধপাস করে পাশের গাড়ির বিপরীত পাশে রাস্তায় ফেলে দিলো তা আমার পুরোপুরি মনে নেই। শুধু দেখলাম,লোকটিও লাফ দিচ্ছে।
এই নাশকতায় একশ’রও বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে। মানুষের প্রাণ যেন ক্ষমতালোভীদের ক্ষমতা লাভের টোপ! মানুষ মেরে পুড়িয়ে কী ভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়,টিকে থাকা যায় তা এ ঘুমন্তনগরীর চিন্তায়ও নেই!
পরদিন পত্রিকায় শুধু মাত্র একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ এসেছে। আমি নিজেই পা ভেঙে ঘরে বসা অথচ আহতের সংখ্যা উল্লেখ করেনি!
এই যে ছায়া-প্রচ্ছায়া নাশকতা, এই যে ভুল তথ্য পরিবেশন করা, এই যে প্রাণ নিয়ে হোলিউৎসব – কেন? এর উত্তর অলসনগরীর জানা নেই। এর উত্তর আমিও জানি না।
মানুষের প্রেম, ভালোবাসা, প্রিয়জনের সাথে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিমিষেই এক ধবংসযজ্ঞের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল কেউ,তার উপর নির্ভরশীল ছিলো কেউ, তারা এখন কী করবে?
যারা ক্ষমতায় যাবে তারা হাজার কোটি টাকা বানাবে আজ যারা পুড়ে ছাই হলো, আজ যার গাড়ি ছাই হয়ে গেলো সে কী পাবে?
রাস্তায় আধমরা হয়ে পড়ে আছি, ভদ্রলোক আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিরাপদ দূরত্বে এনে রিকশায় তুলে দিয়ে বললেন,যান,ডাক্তার দেখান। চারদিকের মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে। রাস্তায় এতো ট্রাফিক না থাকলে হয়তো এতোগুলো গাড়ি পুড়তো না, এতোগুলো মানুষের কপাল ভাঙতো না! এতো অপেক্ষা নিরানন্দে কালো হয়ে যেতো না।
চারদিকে অসংখ্য ফোনের শব্দে গুলিস্তান যেন এক নরক হয়ে উঠেছে। আইতে পারলাম না বউ,মাফ কইরা দিও।আমি পুড়ে গেছি। মাফ কইরা দিও বলতে বলতে থেমে গেলো একজনের জীবন প্রদীপ।
ট্রাফিক- নাশকতা ঢাকাই জীবনের অনিশ্চয়তার উৎস। একদিন ভোট শেষ হবে। ভোট নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনার অবসান হবে।
এতোগুলো মানুষের ভস্মীভূত স্বপ্ন আর ফিরে আসবে না যেমন করে আমিও পাবো না ফিরে একটা সুস্থ পা!
শাহানা সিরাজী
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।
আরও লেখা পড়ুন।
ঘুরে এলাম বস্টন হারবার দ্য নিউ ইংল্যান্ড একুরিয়াম – শাহানা সিরাজী
আরও লেখা পড়ুন।
আরও লেখা পড়ুন।