পরজন্ম – সাগর চৌধুরী
বহুকাল পরে তার চোখে পানি ঝড়লো। বন্যার পানিতে যখন সব কিছু ভেসে গেল বউ,বাচ্ছা, গোয়ালের গরু আর পুকুরের মাছ । ঘড়ের রাখা ধান চালের মটকি। সব কিছু হারিয়ে নিস্ব হয়ে বাঁধের উপর বসে কাঁদলো কাশেম আলী। এতকাল পরে তার চোখে পানি।
দশ গ্রামের লোক জানে তার খবর। এই বছরও তার গরু মোল্লাগো গরুরে ঠকায়ে দিছে। এই নিয়া তিন বারের মত তার গরু প্রথম হইল৷ মিয়া বাড়ির বড় মিয়ার মেয়ের বিয়ে,
গ্রামে কারো পুকুরে বড় মাছ খুঁজে পাওয়া পাচ্ছে না। কার কাছে খবর পেয়ে মিয়া সাহেব নিজে এসে কাশেম আলীর পুকুর থেকে মাছে ধরে নিয়ে গেছে। টাকা দিতে চাইছিল;
কাশেম আলী টাকা নেয় নাই।
গত বছরের আগের বছর পুরো গ্রামে বৃষ্টি নাই, ধান রোপনের মৌসুম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে; এই জন্য দোয়া মাহফিলের ব্যববস্থা করা হইছিল। সেই শিরনীর জন্য কাশেম
আলী একাই দশ মন ভালো চাল দিয়েছিল। শিরনীর একদিন পরই বৃষ্টি হলো। সবাই দোয়া করলো।
আজ সেই কাশেম আলী; তিন দিনের না খাওয়া সরকারি বাঁধের উপর বসে আছে ত্রাণের জন্য। মেম্বার,চেয়ারম্যানের লোকজন তাদের পরিচিতদের ত্রাণ দিচ্ছে ডেকে ডেকে।
কাশেম আলীর নাম ধরে একবারও ডাকেনি। লোকজনদের ভিড় ঠেলে একবার ত্রাণের কাছে গিয়েছিল কাশেম আলী, কিন্তু তার ভাগ্যে কিছু জোটেনি। মেম্বারের লোকজন তাকে
বলেছে; নেই বাবা, দেব কোথা থেকে। অথচ এই হাসু মেম্বারই দোয়া মাহফিলের মাইকে বলছিল দশ মণ ভালো চাল দিয়েছে কাশেম আলী।
ধানের জমিতে এখন আর কোন ধান নেই। সব পানিতে ভেসে গেছে। খেতের আলে দাঁড়িয়ে কাশেম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখে যেন কি বিড়বিড় করে। তার সেই
বিড়বিড় কথার অর্থ কেউ বুঝতে পারে না।
পঁচিশ বছর আগে কাজী বাড়ির হোসেন কাজীর মেয়ে ফাতেমার সাথে তার বিয়ে হয়। ঘরে তিন তিনটা ছেলে দিছে আল্লাহ। কি তাঘড়া জোয়ান মর্দ পোলা। ঘর ভেঙে আড়ের নিচে চাপা পড়ে মা ছেলেরা এক সাথে মারা গেল। বন্যার দিন কাশেম আলীও ঘরেই ছিল কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে যায়। ছেলে গুলারে মাটিও দিতে পারে নাই। কোথায় মাটি দিব? সারা গ্রাম পানির নিচে। অনেকেরই আত্মীয়স্বজন মারা গেছে কিন্তু কাশেম আলীর মতো এই রকম ঘর কারো খালি হয় নাই।
সপ্তাহ খানেক পরে পানি নেমে যাওয়ার পর। কাশেম আলীর পড়ে যাওয়া ঘরটায় ধান,চাল, ডাল পচার ঘৃপ হয় । দেখি দেখি করে সবাই দেখতে আসে আর আফসোস করে ।
কাশেম আলী কান্ধে আর কান্দে। তার এই সাজানো সংসার আজ শুধু চোখের জল হয়ে ঝড়ে।
মাঠের পানি শুকিয়ে যায় কিন্তু কাশেম আলীর চোখের পানি শুকায় না। আত্মীয়স্বজনরা আসে এই কথা সেই কথা বলে শান্তনা দেয়। পাড়াপড়শীরা তাকে নানা রকমের সান্ত্বনা
দেয়। কিন্তু কোন কিছুতেই তার মনে শান্ত্বনা পায় না। বুক চাপরায় আর বলে কোথায় আমি যামু; আল্লার দুনিয়ায় আমার কি আর যাবার জায়গা আছে?
সত্যি তো সে আর কোথায় যায়? এই দুনিয়ার কোথাও গেলে কি তাদের পাওয়া যাবে?
মসজিদের ইমাম সাহেব তার কাছে আসে, তাকে কত রকম হাদিস কুরআন পড়ে বুঝায়। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এই পৃথিবী থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায়। যারা আল্লার নেক
আমল করেছে তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ নজর থাকে।
নামাজের আগে আগে সে চলে আসে কাশেম আলীকে নিয়ে যাবার জন্য। তারা দুজন নামাজের জন্য দাড়ায়। নামাজ শেষ করে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে কান্দে কাশেম
আলী। তাদের সব গুণা মাফ করে দাও; আল্লাহ। তাদের জান্নাতবাসী করো আল্লাহ। দিনের পর দিন যায়; শুকনো ডালে আবারো কচি পাতা গজায়। ফলের গাছগুলোতে
আবারো ফুল আসে; আম কাঁঠাল গাছে মুকুল আসে। ফল ধরে। গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় কাশেম আলী।
আফসোস লাগে ছেলে পেলে গুলা গাছে উঠে এসব ফলফলাদি খেত। বাড়ির বাহির থেকে সে এলে ফতেমা পাকা ফল তার সামনে দিয়ে বলতো ছেলে গুলা গাছের থন পাড়ছে। ফাতেমার হাতের সব কিছুই ভালো লাগতো তার। তার হাতে কি স্বাদ ছিল।
ছেলেগুলো ছিল পীঠাপিঠি। দেখতে প্রায় একই রকম। বলিষ্ঠ দেহ আর খুব দুরন্ত। সারাদিন পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। এই মাতামাতির একটা কারন ছিল ছেলেগুলার
কোমরে ঘন্টি বাধা ছিল। যখন দৌড় দিত সবগুলো একসাথে দৌড়াত আর কেমন একটা শব্দ হতো। এই শব্দে মাঝে মাঝে কাশেম আলী বিরক্ত হয়ে মাইর দিত। ছেলেদের কান্নার
শব্দ শুনতে পেলে যেখানেই থাকতো ফাতেমা হা হা করে দৌড়ে চলে আসতো; এসে বলতো ওরা কি বুঝতে পারে কেনটা ভুল? ছেলেগুলাকে খুব আগলে রাখতো ফতেমা ।
খুব ছোটবেলায় ফাতেমার বাবা মারা গেছে, সে বলতো এরাই আমার বাপ। শনিবার আর বুধবার গ্রামের হাট বসে। প্রতি হাটবারেই ফাতেমা এটা ওটা আনার জন্য ছেলেদের কাছে বলে দিত। বাপ আর ছেলেরা হাট থেকে বাড়ি ফিরতো । নুন, তেল, জাল আরো কত কি বাজার থেকে নিয়ে আসতো। রাতের বেলা রান্না হতো ছেলেরা মায়ের
সাথে রান্নাঘরে চুলার চার পাশে বসে থাকতো। রান্না হলে এক সাথে খেতে বসতো। এখন হাটবার এলে কাশেম আলী একাই হাটে যায়, পাড়া প্রতিবেশী কেউ যদি সাথে যেতে চায়
তবে এক সাথে যায়। সন্ধ্যার আগে আগেই আবার ফিরে আসে সে, ভিটায় বাতি জ্বালাবার তো আর কেউ নেই। তাই তাকেই ফিরতে হয় সন্ধ্যা বাতি দেবার জন্য।
কাশেম আলীকে দেখতে বোন সহ বোন জামাই আসে। তাদের ঘড় বাড়িও পানিতে ডুবে গিয়েছিল। ভাইয়ের এই কষ্টে দুঃখে তারাও যেন একাকার। দিন কয়েক থেকে যায়
ভাইয়ের সাথে। তাদেরও তো ঘড় সংসার আছে। বাড়িতে ছেলে পেলে আছে। গরু বাছুর আছে। মাঠে নতুন ধান লাগাবার মৌসুম যায় যায় করছে। কিন্তু ভাইয়ের এই সময়ে
কিছুতেই বোনের মন সায় দিচ্ছে না; যে সে এক বার ছেড়ে যায়। ঐ দিকে তার নিজের সংসার।
বুধবারের হাট শেষে বোন জামাই আর কাশেম আলী বাড়ি ফেরে। ফেরার সময় কথায় কথায় বলে বসে ভাইজান -‘হালের গরু না কিনলে আর নয়’। কাশেম আলী বলে ট্যাহা নাই তো কি করমু? ট্যাহা জোগার হউক তারপর দেহি কি করা যায়।
কথা বলতে বলতে বোন জামাই বলে উঠে ‘বড় দেরি হইলো; আপনের বোন আজ রাগ করবো। কিন্তু ভাই
জান এই যে রাইত বিরাইতে আসতাম যাইতাম এই জন্যে ভাবিসাবের কোন সুময় রাগ করতে দেহি নাই। মানুষটার রাগ বলতে কিছু আছিল না। একদম মাটির মানুষ ছিল। হের
মত মানুষ আমি এই জীবনে দেহি নাই। এত সুন্দর সোনার সংসার আল্লাহ কি কইরা ভাইংগা দিল।
সামনের দিকে হাঁটছে আর কাশেম আলী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। সত্যি তো ফাতেমা মারা গিয়ে কাশেম আলীরে নিঃস্ব করে দিছে। চোখের পানি মুছে আর হাঁটে কাশেম আলী।
রাতের বেলা বোন কাশেম আলীরে বলে,‘অনেক দিন তো ভাইজান আছিলাম এবার আমার সংসারডা তো শেষ হইয়া যাইতেছে। কিন্তু কেমন কইরা যাই, এখানে আপনে একা
কে আপনের জন্য রান্ধে বারে কে আপনারে শান্তনা দেয়? তার চেয়ে আপনেও….
এই কথা শোনার সাথে সাথে কাশেম আলী বলে-‘না না এইটা কেমন কইরা হয়। আমার ভিটা ছাইরা কেমন কইরা আমি যাই। তাছাড়া তোমরা তো আইজ হোক কাল হউক
চইল্যাই যাইবা। আমার খালি ভিটাতে আমাকেই থাকতে হইব।
বোন জামাই দেখলো খানিকের মধ্যেই কাশেম আলীর চোখগুলা কেমন যেন জ্বলে উঠলো। সে চুপ করে থাকে। সে বুঝতে পারে না। এই লোকটার কিসের ভিটে? যার বউ বাচ্চা
কেউ নাই, একলা একটা মানুষ সেই লোকটা কেমন কইরা বলে আমার ভিটে। আরে কয়দিন আর বাঁচবো হে? হাড়ে দুর্বা ঘাস গজাবে তবু সে ভিটে ছাড়বে না।
বোন জামাই মনে মনে গালি দেয়, বুড়ো গোয়ার।
বোন জামাই অসন্তুষ্ট মনে গালি দিতে দিতে ঘুমাতে যায়। কাশেম আলী ও ঘুমাতে যায়।
বিছানার পাশের কুফি নিভিয়ে মনে মনে বলে, এইটা হতে পারে না। তিন পুরুষের ভিটা ছাইড়া কিছুতেই যাইতে পারে না। কারো কাছে সে করুণার হাত পাততে পারে না। মরলে
সে মরুক। এখানেই মরুক।
সকাল বেলা বোন; বোন জামাই তাদের বাড়ি ফিরা যায়। কাশেম আলী বোনের কান্না দেখে বলে-দিন কয়েক পরে আবার আহিস, আমারে দেইখ্যা যাইস।
বোন জামাই মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলে ‘নিজের সংসার ফালাইয়া কয়দিন আইয়া বইয়া থাহুম এইহানে?
একা ঘর, একা উঠোন, একা রান্নাঘরের মেঝে, একাটা হাঁড়ি, একটা পাতিল আর অল্পকয়টা বাসন কোসন নিয়ে কাশেম আলীর সংসার। নিজে রান্ধে নিজে বাসন কোসন
ধোঁয়। নিজেই সংসারের কাজকর্ম করে।
মাঠে যায় জমি জিরেত দেখে। নতুন ধান বোনে;ধানের চারা নিজের ক্ষেতে রোয়। কাজের ব্যস্ততায় আবার ক’টাদিন সরগরমে কাটে তার সময়।
নতুন ধান কাটার সময় বোন; বোন জামাই তার বাড়িতে আসে। ভাগনি ভাগনেরা আসে,আসে আরো আত্মীয়স্বজন। ঘড় ভর্তি লোকজন। বাড়ি ভর্তি পারা প্রতিবেশীরা এসে ভিড়
জমায়। এইসব লোক জনের দেখভাল করা, তাদের খাবার দাবারের আয়োজন করা, পুকুর থেকে মাছ তোলা সবই তো কাশেম আলীর দেখতে হয়। নিজের কথা ভাবার, নিজের
ছেলে; বউর কথা ভাবার সময় কই তার। হাজার কাজের ভিড়ে কাশেম আলী ব্যতিব্যস্ত থাকে। কাজের মাঝেই সময় ফুরিয়ে যায়। ফুরিয়ে গেলেই শেষ হয়ে যায়, সময় ধরে
রাখার ক্ষমতা কারো কি থাকে ?
দিন শেষে সবাই ফিরে যায়। কাশেম আলী আবার একা হয়ে যায়। একা হয়ে যায় তার ঘর। শূন্য হয় তার উঠোন।
মাঠের নতুন ফসলের দিকে তার নজর পড়ে। ধানে পোকায়
ধরেছে বাজার থেকে ওষুধ এনে ধানের উপর ছিটায়। পানির জন্য মেশিন বসায়। ক্ষেতে সার ছিটায়। আরো কত কি?
এবার কাশেম আলীর ধান ভালো হয়। গ্রারামের সবাই বলে কাশেম আলী দান বাজাইছে। ম্যালা টেহা ধান বেইচা পাইবো। সত্যি সত্যি তাই হয়। ধানের দামে তার মনের আশা পূর্ণ
হয়। সবাই বলে চাষের জন্য বলদ কিনতে কিন্তু কাশেম আলী বুড়ো বাম হলে কি হবে বুদ্ধি আছে বটে হালের জন্য বলদ না কিনে; কিনে আনে হালের মেশিন। গ্রামের মধ্যে আবার
নাম ডাক পড়ে যায়। কাশেম আলী চাষের জন্য মেশিন কিনছে। পারা প্রতিবেশীরা তার মেশিন দেখতে বাড়িতে আসে।
মসজিদের ইমাম সাবেরে দিয়া মিলাদ পড়ায় সে। বউ-
ছেলের জন্য দোয়া করে । ফকির মিসকিনরে দান খয়রাত করে।
কাশেম আলী দেখলো কাজের চাপে সে একেবারে মেশিনে চাপা ধান হয়ে গেল। বুদ্ধি করলো কি করা যায়। একার পক্ষে এই জমি জিরেত সামলানো দায়। কাজের লোকের
দরকার। তাছাড়া ধানের মেশিন কেনার পর নিজের কাজের পরও ভারা খাটার জন্য মেশিনটা বেশ উপযোগী এবং এর ব্যাপক চাহিদাও আছে। দু’জন লোক যদি মেশিনটাতে
খাটানো যায় তবে বছরের মধ্যেই তার মেশিনটার দাম উসুল হয়ে যাবে। লাভে তার মেশিনটাও রয়ে যাবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। গ্রামের মধ্য থেকেই দু’জন লোক নিয়ে
নিল। এবার কাজের চাপ তার কমে গেল। কিন্তু পয়সা আসতে লাগলো নগদ নগদ। নিজের পুকুরগুলোতে মাছ ছেড়ে দিল মাছের মৌসুমে। দিনের বেলা মাঠে আর বিকেল
বেলা পুকুরের মাছের যত্নে লেগে গেল। মনপ্রাণ এখন তার কাজ আর কাজ। গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে লাগলো কাশেম আলীর দিন আবারো ফিরছে রে। যদিও
সবাই জানে কাশেম আলী যেখানে হাত রাখে সেখানেই সোনা ফলে। এই সোনার লোভের আশায় অনেকেই তার কাজ কর্ম এসে দেখে যায়। পুকুরের মাছ দেখে সবাই বাহবা দেয়।
আস্তে আস্তে মাছ বড় হতে থাকে । মাঠের ধানও সময় মত আসতে থাকে। বারতির উপরে মেশিন। প্রতি হাটবারে কামলার টাকা তেল খরচের টাকা দিয়ে তার অনেক টাকা লাভ
হয়। এরই মধ্যে অনেকেই দু’চার পয়সা ধার চেয়ে পায়। আবার মৌসুমের সময় ফেরত দেয়।
বছর দুয়ের মধ্যেই কাশেম আলী আগের চেয়েও অনেক টাকা পয়সার মালিক বনে যায়। মসজিদের ইমাম সাবরে দিয়ে সামনের পুকুরের গাটলাটা বাধিয়ে দেয়। মুসসুল্লিরা নামাজ
পড়তে এসে তারে প্রাণ ভরে দোয়া করে যায়।
কাশেম আলী তখন আল্লাহর কাছে শোকর করে মোনাজাত করে-‘হে আল্লাহ তোমার কৃপায় আমার এই সব কিছু। তুমি মাওলা দেওনে আলা আমি শুধু মাত্র উছিলা।
মুনাজাত করে আর কাঁদে। কাশেম আলীর কান্নায়
যেন আল্লাহর আরশ কাপে। আকাশের উপরের আকাশে যেন তার এই কান্নার শব্দ শোনা যায়।
নামাজ শেষে প্রায়ই ইমাম সাহেব তার যাবতীয় খোঁজখরব নিতেন। তারপর নানা রকম হাদিস কোরআনের আয়াত পড়ে পড়ে শোনাতেন। বোঝাতেন অনেক কিছু। একদিন
এশার নামাজের শেষে মসজিদের ইমাম সাহেব কাশেম আলীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে তার বাড়ির রাস্তার মোড়ে চলে আসে।
এরপর কাচুমাচু করে বলে ভাই সাহেব, অনেক দিন ধরে
একটা কথা বলবো বলবো করে সাহসও পাচ্ছি না, বলতেও পারছিনা। আবার ভাবছি আপনি যদি কিছু মনে করেন?
কাশেম আলী বলল, আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন ।
আপনার কি টাকা পয়সা লাগে কিছু?
এবার মাওলানা সাহেব হেসে জবাব দিলেন-‘না, আসলে আমার কথাটা আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।
কাশেম আলী এবার ইমাম সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি সেই ব্যক্তিগত কথা শোনার জন্য।
মওলানা সাহেব শুরু করলেন-‘মহান আল্লাহ তায়ালা একের উপর অন্যের হক দিয়েছেন। সেই হক অবশ্যই পালন করা দরকার। মহান আল্লাহ তায়ালা আপনার সব কিছু নিয়ে
গেছে আবার তিনি চাইলে সব কিছু ফিরিয়েও দিতে পারে।
কি বলুন পারে না?
কাশেম আলীর কন্ঠে দৃঢ়তা; সে বলে, অবশ্যই পারেন।
ভাই আপনার খেদমতের জন্য একজন বিবি খুবই প্রয়োজন। আমার মনে হয়েছে মহান আল্লাহর পথে সঠিক দীনি প্রতিষ্ঠার পথে নিজেকে বিলিয়ে দিতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একজন মানুষ। সেই মানুষ একজন নারী। যে আপনার সারাক্ষন পাশে থেকে আপনার ক্ষেদমত করবে।
বিয়ের কথা শোনার পর কাশেম আলী যেন কেমন একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেল। তার মুখ ভার হয়ে গেল। তার বলনে কেমন এক অস্থিরতা প্রকাশ পেল। বললো-‘কথাটা আপনার
মন্দ না; তবে, এই বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে’?
‘বুড়ো বয়স নয় আপনার। একান্ত প্রয়োজন।’
কিন্তু কে আমাকে বিয়ে করবে?
‘আমার কাছে সে পাত্রির সন্ধান আছে, বলেন তো?
এবার কাশেম আলী মুখ খোলে বলে-‘আপনী তো জানেন আমার বোন আছে তার সাথে, একবার যদি কথাবার্তা বলে নিতাম তবে ভালো হয়।
বোনের কাছে খবর কাশেম আলী নিজেই পাঠিয়েছে । না পাঠালে ও কিছু বলার ছিল না। ভাই বিয়ে করবে এটা আর বলার কি আছে। কিন্তু বোন এই কথা শোনার পর খুশি হলো।
মনে মনে ভাবলো যাক এই বয়সে ভাইয়ের একটা গতি হলো। রান্নাবান্না খাওয়া দওয়ার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। বোন ভাইয়ের বাড়িতে আসে। ভাইয়ের কাছে জানতে চায় মেয়ে
দেখার জন্য। কাশেম আলী না বলে এড়িয়ে যায়। ভাইয়ের জন্য বোন মেয়ে দেখে আসে।
ইমাম সাহেবের আপন মামাতো বোন। বছর তিনেক আগে স্বামী মারা যায়। এক মেয়ের মা। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, জামাই ব্যববসায় করে। স্বামীর জমিজমা আছে তাতে তার
একার বেশ ভালোভাবেই চলে যাবার কথা। তবে একা একা বেঁচে থাকা সবার জন্যই কষ্টের, এই কথাটাই ইমাম সাহেবের স্ত্রী ইমাম সাহেবের কাছে বলেছে। তবে কাশেম
আলী যে এত সহজে রাজি হয়ে যাবে সেটা ইমাম সাব ভাবতে পারেননি।
হাসিনা বেগম। রহিম ব্যাপারির স্ত্রী ছিল। নেহাত ভাগ্যের ফের না হলে এই বয়সে আবার বিয়ে! তবে তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে কেমন যেন একটা না মনোভাব ছিল। না বলারই
কথা। স্বামীর সংসার একা একটা বাড়ি। জমি জিরেত পুকুর সবই তার আছে। তার পর ও ইমাম সাহেবের স্ত্রী বুজিয়ে বলার পর সে রাজি হয়। সে নিজেও বুঝতে পারে একা একা
থাকার চেয়ে তার নতুন সংসার হবে। ভাবতে গেলে চোখে জল আসে হাসিনা বেগমের।
ভাইয়ের কাছে বোন এসে বলে হাসিনার কথা, জোয়ান শক্ত সামর্থ্য। দেখতে সুন্দরী, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ রোজা করে। খুব পর্দানশীল। একবার যেন ভাই গিয়ে দেখে আসে।
কাশেম আলী বোনকে জিঙ্গাসা করে-‘তোর পছন্দ হইছে? বোন মাথা ঝাকায়।
কথা পাকাপাকির পর গ্রামের সবার মধ্যে জানাজানি হয়। কাশেম আলী আবার বিয়ে করছে। গ্রামের হাটের মধ্যে এক মুখ থেকে হাজার মুখে ছড়িয়ে যায়। কেউ কেউ ভ্রূ
কুঁচকে তাকায়-কি বলছো কাশেম আলীর বিয়ে ?
কেন বিশ্বাস হয় না?
এই বুড়ো বয়সে বিয়ে?
কেউ কেউ বলে, না ঠিক আছে ব্যাটা এত কিছুর পরও নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আর বিয়ে তো সে নিজের প্রয়োজনেই করছে। এই ভাবেই গ্রামের মানুষের খুশি অখুশির মধ্যেই বিয়ে হয়। কাশেম আলী আর হাসিনা বেগমের।
ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে শুরু হয় মারাইয়ের মৌসুম। কাশেম আলীর কাজ বেড়ে যায়। দু’হাতে কাজ আর কাজ। মারাইয়ের মেশিনে ধান মারাই করে সে ধান আবার চিটা
ছড়াতে হয়।
বস্তায় বস্তায় ধান ভরে কামলাদের সাথে কাশেম আলী ব্যস্ততার সময় কাটায়। সারা শরীরে দরদর করে ঘাম ঝড়ে। ধানের কাজ যখন শুরু হয় ঘরে বাহিরে সমান তালে কাজ শুরু হয়। হাসিনারও অবসরের ফুসরত নাই । তারপরও গোমটা টেনে উঠানে উকি মারে কখন কাশেম আলীর মুখোমুখি হয়। পানির জগটা আগায়া দিয়া বলে -নেন পানি খায়া লন।
কখনো কখনো হাতের কাজ ফেলে রেখে উঠানে এসে বলে-
খাওনের কথা মনে নাই বুঝি। হাসিনার এমন কথাবার্তায় হঠাৎ চমকে ওঠে কাশেম আলী। বউয়ের আলতো শাসন মেনে নেয়।
বছর ঘুরে বছর আসে। মানুষের আপদে-বিপদে কাশেম আলী পাশে দাঁড়ায়। সাহায্য সহযোগিতা লাগলে করে। ধার দেনা হলে না করে না। গ্রামের ভালোমন্দ কাজে সবাই তাকে ডাকে।
কাশেম আলীও সবার জন্য অন্তপ্রান। তাছাড়া অনেকেই ভেবেছে কাশেম আলী বিয়ের পরে অনেক বদলে যাবে কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশী কেউ বলতে পারবে না কাশেম
আলী একটুও বদলেছে।
আবার হাসিনা তাদের সাথে খারাপ আচার-আচরণ করছে এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না। কোন কিছু চেয়ে পায়নি হাসিনার কাছে এমন কথা আজোও শোনা যায়নি।
এবারো ভোটের সময় হয়ে এলো হাসু মেম্বার আবারো এল ভোটের জন্য। কিন্তু গ্রামের সবাই বললো না, এবার কাশেম আলী ভোটে দাঁড়াবে আমরা সবাই তারে ভোট দিমু। গত
বন্যায় আমাগো ত্রাণ দেয় নাই হাসু মেম্বার। এবার আমরা সবাই কাশেম আলীরে ভোট দিমু। হে মেম্বার না হয়েও আমাদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়। হের মতো মানুষ
আমরা চাই। সমস্বরে লোকজন বলে ওঠে।
সাগর চৌধুরী
গীতিকার
বাংলাদেশ টেলিভিশন।
বাংলাদেশ বেতার।
আরও পড়ুন।
আরও পড়ুন।