বিচারক মোসাম্মাৎ কামরুন্নাহার ফৌজদারি মামলা পরিচালনার ক্ষমতা হারালেন
আদালত প্রতিবেদকঃ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন দিয়েছিলেন বিচারক মোসাম্মাৎ কামরুন্নাহার। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরেও কেন ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন দিয়েছিলেন সেজন্য তাকে তলবও করা হয়েছিলো।
কিন্তু করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত বছরের এপ্রিল মাসে তাকে আর আপিল বিভাগে হাজির হতে হয়নি। সেই মামলাটির পুনরায় তলব আদেশে গতকাল সোমবার আপিল বিভাগে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন রেইনট্রি ধর্ষণ মামলায় বিতর্কিত পর্যবেক্ষণ দেওয়া ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর সাবেক এই বিচারক। স্থগিতাদেশ থাকার পরেও কোন এখতিয়ারবলে ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন দেন আপিল বিভাগের বিচারপতিদের প্রশ্নের জবাবে তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হন।
এরপরই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এক আদেশে ওই বিচারকের ফৌজদারি মামলা পরিচালনা সংক্রান্ত বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়া হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন, বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
আসলাম সিকদার (৪২) প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে। সেই সুবাদে তার সঙ্গে এক নাট্যশিল্পীর পরিচয়। ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট আসলামের দিলু রোডের অফিসে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন। পরে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি আসলামের জামিনের উপর আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেয়।
এই স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করে তাকে জামিন দিয়ে দেন জজ কামরুন্নাহার। বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনা হলে গত বছরের ১২ মার্চ মাসে তাকে তলব করে। কিন্তু করোনার কারণে গত দেড় বছরেও তাকে আর হাজির হতে হয়নি।
এরই মধ্যে সম্প্রতি রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলায় বিতর্কিত এক পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে ওই বিচারক। তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। পাশাপাশি তলব সংক্রান্ত ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’ মামলাটি শুনানির জন্য গত ১৫ নভেম্বর আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় আনা হয়। এরপর তাকে পুনরায় তলব করা হয়।
সেই তলব আদেশ অনুযায়ী গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় আপিল বিভাগে হাজির হন তিনি। ভার্চুয়ালি শুরু হয় আপিল বিভাগের কার্যক্রম। এর আগে প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মী, আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দেওয়া হয়। এমনকি ভার্চুয়ালিও গণমাধ্যমকর্মীরা এই মামলার শুনানি প্রত্যক্ষ করতে পারেননি।
পরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকার এক নম্বর ক্রমিকে থাকা মামলার শুনানি শেষে কামরুন্নাহারের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সিজ (জব্দ) করা হয়েছে মর্মে আপিল বিভাগ আদেশ প্রদান করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় পরবর্তীতে প্রকাশ করা হবে।
নাট্যশিল্পী ধর্ষণ মামলায় আসলামকে খালাস দেয় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এর বিচারক শামসুন্নাহার। এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে গত ২০ জানুয়ারি খালাসের নথি তলব করে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আসলামকে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গত ২০ জানুয়ারি এই আদেশ দেন।
প্রসঙ্গত, রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়ে গত ১১ নভেম্বর আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন কামরুন্নাহার। একইসঙ্গে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা না হলে মামলা না নেওয়ার বিষয়ে পুলিশকে সুপারিশ করেন।
এ নিয়ে বিচারাঙ্গন সহ দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠে। মানববন্ধন করেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। এরপরই তাকে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে যুক্ত করা হয়। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে প্রকাশ্য আদালতের দেওয়া সেই পর্যবেক্ষণ লিখিত রায়ে অন্তর্ভুক্ত করেননি ওই বিচারক।