ছায়াসঙ্গী – এম এ সিরাজী

PicsArt_04-19-12.15.43.jpg

ছায়াসঙ্গী – এম এ সিরাজী

১৯৭৩ সালের পৌষ মাসের বিকেলে আমার ভাই এই পৃথিবীতে এসেছিল। কতই বা তখন আর আমার বয়স? আড়াই অথবা তিন ছুঁই ছুঁই। কিন্তু ঐদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। দাদী যখন আমাকে নিয়ে মায়ের সামনে আসলেন, আমি দেখলাম মায়ের কোল অন্য একটি শিশু দখল করে আছে। দৃশ্যটা আমার খুব একটা পছন্দ হলো না। হয়তো মায়ের কোল থেকে শিশুটিকে সরানোর জন্যই তার দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু ভাইটি যখন আমার একটা আঙ্গুল তার তালুবদ্ধ করল, আমার ভেতর কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করা শুরু করল। এতো আমার ভাই, তার জন্য আমি আমার মায়ের কোলের দাবী না হয় একটু ছেড়েই দিলাম। অবশ্য তখন ভাইয়ের পাশে বেশি থাকার সুযোগ পেলাম না। ছোটচাচী এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমাদের যৌথ পরিবারে বসবাস। বাবা চাচা সবাই এক সাথেই থাকেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়টাতে যখন গোটা দেশ সবকিছু নতুন করে শুরু করছে, বাবা চাচারাও প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন ব্যবসা বাণিজ্য আবার চালু করার। ভোর হতেই তারা বের হয়ে পড়েন আর ফেরেন এশার নামাজের পর। আমার দাদাই তখন ঘরের সব বাচ্চাদের পড়ালেখার দেখ-ভাল করতেন। দাদাজানের পাঠশালা শুরু হতো ফজরের সাথে সাথে। নামাজ পড়ানোর পর দাদাজান আমাদের নিয়ে বসতেন। প্রথমে তিনি নিজে কোরান তিলাওয়াত করতেন আমরা সবাই শুনতাম। তারপর কেউ হয়ত আমরা আলিফ, বা, তা, সা সুর করে পড়তাম, কেউ হয়ত আমপারার সবক নিতাম। সকালের এই পাঠ শেষ হতো দাদাজানের নীতিবাক্য পাঠের মাধ্যমে। দাদাজান আমাদের শেখাতেন গুরুজনকে শ্রদ্ধা করার গুরুত্ব। কখনও বা বলতেন মিলেমিশে থাকার সুখের কথা। একদিন দাদাজান বললেন, বাবা হচ্ছে সন্তানের বটবৃক্ষ। এই বৃক্ষের ছায়াতে সন্তান বেড়ে উঠে। আমি সাথে সাথে দাদাজানকে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম, ‘দাদাজান, তাহলে ভাই ভাইয়ের কাছে কি?’ দাদাজান উনার কথার মাঝে কথা বলাতে একটু বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘এক ভাই আরেক ভাইয়ের ছায়াসঙ্গী। সবসময়ের সাথী।’ দাদাজানের ঐ একটি কথাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। এরপর থেকে আমি সবকিছু ফেলে সারাদিন আমার ভাইয়ের সাথে থাকা শুরু করলাম। ঠিক ভাবে বলতে গেলে পাহারা দিতে শুরু করলাম। সারাক্ষণ তটস্থ থাকতাম ভাইয়ের কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না। ভাই একটু কান্না করলেই মা আর দাদীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম আমার প্রশ্নবাণে। ‘মা, ভাই কান্না করে কেন?’, ‘ও দাদী, ভাই ঘুমায় না কেন?’ আমার এইসব প্রশ্নবাণে প্রথম প্রথম মা কিছু না বললেও, পরে নিয়মিত বকা আর কানমলা আমার কপালে জুটত। যদিও ব্যথা পেতাম কিন্তু খারাপ লাগতো না, ভাইয়ের জন্যই তো!

ভাইয়ের জন্মের ১৪ দিনের মাথায় দাদাজান দুইটা খাসী কুরবানি দিয়ে ভাইয়ের নাম রাখলেন “হাসান ঊল করিম”। তবে আমি আজীবন তাকে ডেকে এসেছি ছোটভাই বলে। ছোটভাইও কিভাবে কিভাবে মুখে বোল ফোটার সময় থেকেই আমাকে ডাকতো মিয়াভাই বলে। আমার এই ছোটভাই আস্তে আস্তে আমার সব কাজের সঙ্গী হয়ে গেল। যা কিছু করতাম এক সাথে করতাম। একটা কমলাও যদি খেতাম তার অর্ধেকটা দিতাম ছোটভাইকে। ছোটভাইও মিয়াভাই বলতে পাগল। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমাদের পাশের বাড়ির এক কাকা মারা গেলেন। দাদাজান আমাকে ডেকে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। আমাকে নিয়ে জানাজায় যাবেন। আমাকে যেতে দেখে ছোটভাই কান্না শুরু করল সে ও যাবে। মা প্রথমে রাজী হননি। পরে ছোটভাই এর কান্না দেখে দাদাজান তাকে সাথে নিলেন। ছোটভাই এর আগে কখনো জানাজা-দাফন দেখেনি। জানাজা শেষ করে যখন কবরে মাটি দেয়া শুরু হলো, ছোটভাই আমাকে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘মিয়াভাই, কবরে দেখি হারিকেন দিতে ভুলে গেছে। লাশ অন্ধকারে ভয় পাবে না?’
‘আরে, কবরে হারিকেন দেয় না, লাশ ভয় পাবে না।’
ছোটভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ মিয়াভাই আমি মরলে তুমি আমার কবরে হারিকেন দিও, আমি অন্ধকারে ভয় পাই।’
ছোটভাইয়ের মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আমার অন্তর কেঁপে উঠল। এর উত্তর আমি তাকে দিতে পারলাম না। তার কাঁধে হাত রেখে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মরতে তো একদিন সবারই হবে। আল্লাহ যেন আমার হায়াতও আমার ছোটভাইকে দিয়ে দেয়।

এই ছোটভাইয়ের সাথে আমার যে কত স্মৃতি আছে তা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। একবার বিজ্ঞানের স্যার বললেন আলু থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। আমি আর আমার ছোটভাই মিলে মজুদের সব আলু কেটে নষ্ট করে ফেললাম বিদ্যুৎ এর নেশায়। সেইবার দাদাজান না থাকলে মায়ের হাত থেকে রক্ষা পেতাম না। দাদাজান মায়ের হাত থেকে রক্ষা করে আমাদের বুঝিয়েছিলেন, কৌতূহল থাকা ভালো, কিন্তু তার কারণে যেন কারো কোন ক্ষতি না হয় তার দিকে আমাদের সচেতন থাকা জরুরী। দাদাজানের এইসব কথা কত যে অমূল্য ছিল তা এখন আমি অনুধাবন করতে পারি।

কালে কালে কত বেলা বয়ে গেল। বয়স আজ আমার প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বাবা চাচাদের ব্যবসা এখন আমি আর ছোটভাই সামলাই। একসাথেই থাকি আমরা সবাই। বিপদে-আপদে সবাই সবার সঙ্গী। এইতো মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমার ওপেন হার্ট সার্জারী হলো। ভাই আমার একটি সেকেন্ডের জন্যও আমার পাশ থেকে সরেনি। সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থেকেছে আমাকে নিয়ে ঠিক যেমনটা আমি থাকতাম তার জন্মের পরপর। হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর আমাকে আর অফিসের কোন কাজ করতে দেয়নি। নিজেই সব সামলাচ্ছে। আমি বাসায় আসার কয়েকদিন পরেই করোনা হানা দিল। সবাই আমাকে নিয়ে বেশ সতর্ক। ডাক্তার বলে দিয়েছে কোন ভাবেই অসতর্ক হওয়া চলবে না। মাত্র অপারেশন হয়েছে, করোনা আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি। ছোট ভাইয়ের কড়া নির্দেশ পরিবারের কেউ যেন অযথা ঝুঁকি না নেয়। আমাকে বাসায় রেখে সে চলে গিয়েছিল ফরিদপুরে ব্যবসার একটা কাজে। এর মাঝেই করোনার আগমন। ছোটভাই আমাকে বললো, ‘মিয়াভাই আমি তো চলে আসবো ভাবছিলাম, কিন্তু কয়েকদিন ধরে একটু জ্বরজ্বর লাগছে, আমি বরং কয়টা দিন অপেক্ষা করি।’ ছোটভাইয়ের জ্বরের কথা শুনে আমি শান্ত থাকতে পারলাম না। অনেক জোর করলাম কিন্তু শুনল না। আমি মাত্র অপারেশান থেকে উঠেছি। ছোটভাই কোনভাবেই ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ভাই আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল যে সামান্য জ্বর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মন থেকে দুশ্চিন্তা গেল না। সেদিন সকাল থেকেই আমার মনটা কেমন করছিল। ছোটভাইকে সকাল থেকে ফোন করছি, কিন্তু ধরছে না। মন অজানা আশংকায় দুরুদুরু করছে। হঠাৎ ছোটভাইয়ের বড় ছেলে রুমে এসে হাউমাউ
করে কান্না শুরু করল, “চাচা! বাবা নেই।”
ভাতিজার উচ্চারিত এক একটা শব্দ যেন আমার হৃদয়ে একটা একটা পেরেক ঠুকে দিলো। আমার ছোটভাই আর নেই! আমি কিছু বলার আগেই আমার বড় ছেলে বলে উঠল, “চাচা তার শেষ ইচ্ছা লিখে রেখে গেছেন, বলেছেন মিয়াভাই যেন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কবরের কাছে না যায়।”

ছোটভাইয়ের শেষ ইচ্ছার কথা শুনে আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। ছোটভাইকে কি আমি শেষবারের মত দেখবনা? নিয়তির নিষ্ঠুর খেলায় আসলেই আমি যেতে পারি নি আমার ছোটভাইকে মাটি দিতে। সবাই আমাকে বলল, পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এখন আমার উপর।

আমার কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে আমার সন্তান কে? কে দেখবে আমার ভাতিজাদের কে? যত প্রবোধই দেয়া হোক এই দুঃখ আমি কোথায় রাখব? সারা জীবন যার ছায়াসঙ্গী ছিলাম আমি, মৃত্যুতে আমি পারলাম না তার সাথী হতে। এই দুঃখ আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন। থেকে থেকে আমার ছোট ভাইয়ের মায়া ভরা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছোটভাই আমার অন্ধকারে ভয় পায়, আমি তার কবরে হারিকেন রাখতে পারলাম না।

আল্লাহ যখন আমার হায়াত তোকে দেয় নি, আমার সব ভালো কাজ তোর নামে লিখে দিক। সেটাই হয়তো তোর কবরের হারিকেন হবে।

এম এ সিরাজী
(মুশফিকুল আনোয়ার সিরাজী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে (সানওয়ে, মালয়েশিয়া ক্যাম্পাস) মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষণারত আছেন।

তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী, গবেষক ও কথা সাহিত্যিক। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার “রমিজের ২৯ দিন” (২০২০)। ফ্যান্টাসি থ্রিলার “মর্গানাইট” (২০২১)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top