আমি মা,আমি চাই না আমার সন্তানের মৃত্যুদণ্ড হোক –
শাহানা সিরাজী
যে দিন দেখলাম ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সেদিন থেকে মাথায় একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
ধর্ষক পুরুষ – সে আমার বাবা,ভাই পুত্র সন্তান
ধর্ষিতা – আমি, আমার মা, বোন, কন্যা।
আমরা তো পস্পরের। আমার চোখের সামনে আমার বাবা,আমার পুত্র আমার ভাই ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আমার কেমন লাগবে!
আসুন আমরা ব্যাপারটির গভীরে প্রবেশ করি-
নারী-পুরুষ ভিন্ন দে্হসৌষ্ঠব নিয়ে জন্ম নেয়ার কারণ কেবল বংশবৃদ্ধির জন্যই। অন্যথায় পুরুষ যে আলো বাতাসে বেড়ে ওঠে একই আলো বাতাসে নারীও বেড়ে ওঠে। তবু পুরুষের ক্ষমতার কাছে নারীকে স্তিমিত থাকতে হয়!
এই ক্ষমতা কে দিলো?
এই ক্ষমতা দিয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা,আমাদের সামাজিক চেতনা, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্কুর আমাদের গৃহ। আমাদের মা, দাদি, নানী, চাচী, ফুফু অর্থাৎ নারীই।
এ নারীই তার পুত্র সন্তানকে শেখায় সে পুরুষ তার দাপট থাকতে হবে,কন্যাকে শেখায় গৃহকর্ম, সহিষ্ণুতা। কথায় কথায় কন্যার চলাচলে বাঁধা পুত্রের অবাধ স্বাধীনতা, কন্যা সন্তানকে জাস্ট ভোগ্যপণ্য হিসেবে গড়ে তোলা, পুত্র সন্তানকে ভোগ করার জন্য গড়ে তোলা। পরিবার থেকে এই বৈষম্য নিয়ে কন্যা সন্তান পা রাখে আঙিনায়। পুত্র সন্তান দখল করে আঙিনার আধিপত্য।
বোনের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে করতে মায়ের উপর,সেই দাদীর উপর আধিপত্য বিস্তার শেখে।
সম্মান ব্যাপারটিই তারা রপ্ত করে না। পারিবারিক এ শিক্ষা নিয়ে তারা যায় স্কুলে। প্রাক থেকেই স্কুলেও সেই পুরুষ- নারী বৈষম্য শেখানো হয়। যেমন আমরা শেখাই- পরিবারে মায়ের কাজ বাবার কাজ আলাদা করো।
মেয়ে শিশুরা মুখ কাচুমাচু করে মায়ের কাজ ঘর ঝাড়ু,বাচ্চা পালন,বাবার জন্য রান্না করা ইত্যাদি আমাদের সোসাইটিতে যা হয় তাই লিখে। ছেলে শিশুরা মহা আনন্দে টাকা আয় করা বাজার করা ইত্যাদি উল্লেখ করে আর মুখ টিপে হাসে, তোরা ঘর ঝাড়ু দিস আমরা টাকা আয় করি। এখান থেকেই মগজে পাকাপোক্ত হলো নারী মানে অন্যের উপর নির্ভরশীল, অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থাকা কখন দুমুঠো খাবার আসবে! যে অন্যের মুখাপেক্ষী সে কী কিরে স্বাধীনতা ভোগ করবে!
আমরা এই শিক্ষাই দিতে পারতাম সংসারে বাবা-মা মিলে কী কী কাজ আমরা করি? তাহলে উভয়ই যে গুরুত্বপূর্ণ তা শিশুরা বুঝতে পারতো। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই সাত আট বছর থেকেই নারী পুরুষ উভয়ের ভেতর অপজিট সেক্সের প্রতি আকর্ষণ আসে। কারো হয়তো আর একটু পরে আসে( পুরুষদের সাথে কথা বলে দেখে পড়ে জেনেছি)
এ সময় নারী-পুরুষের শ্বাশত সম্পর্ক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়া খুব জরুরী। আট নয় বছরে যদি বুঝে যায় নারী পুরুষ আলাদা কেউ নয়।সবার অধিকার সমান। হাইস্কুলে কলেজে এসে সে ধারণাকে আরো পোক্ত আরো বিস্তৃত করা হয় তাহলে নারী নয় পুরুষ নয় আমরা সহযাত্রী, আমরা মানুষ এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা শিক্ষা ব্যবস্থা। একই কারণে মানসিক সমস্যা। নারী দেখলেই লোলুপের মতো তাকানো যাবে না, জোর করে যা ইচ্ছা কথা বলা কিংবা করা রীতিমতো অভদ্রতা নয় অন্যায়ই।
আমি প্রায় আমার শিক্ষার্থীদের বলি আমাকে দেখলেই দাঁড়িয়ে যান,এটা ভয় থেকে? নাম্বার কম পাবেন তা থেকে? নাকি ভালোবেসে সম্মান করে?
প্রথম দুটো যদি সঠিক হয় তাহলে প্লিজ দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ আপনি লিখবেন আমি নাম্বার বসাবো। যদি ভালোবেসে হয় তাহলে মোস্ট ওয়েলকাম।
অনেকেই বলেন যদি ওদের নিমন্ত্রণ রক্ষা না করি তারা কী বলবে? আমি অবাক হই,যদি মন থেকে ওখানে যেতে সায় না আসে ক্লিয়ার বলো, যাবো না। ভালো লাগে না। কিন্তু কী বলবের জন্য গিয়ে কাজ কী? এটা প্রকৃত তুমি নও!
গাছে কাঁঠাল পেকে সুগন্ধ বের হচ্ছে। গাছের মালিক তুমি নও, গাছের যত্ন করোনি কিন্তু তোমার খাবারের লোভ হচ্ছে। তুমি খাচ্ছো না কারণ যদি কেউ দেখে ফেলে! তাহলে সালিশ বিচার হবে,হায়!হায়! ইজ্জত নষ্ট!
এখানে তোমার ইচ্ছা বারিত হলো সামাজিক ভাবে অপদস্ত হওয়া দিয়ে। কিন্তু যদি এমন হতো আমি কেন খাবো,ওটা আমার নয়। তাহলে সেটা হতে প্রকৃত তুমি, ওটাই হতো প্রকৃত মূল্যবোধ!
আইন দিয়ে ধর্ষককে রোধ করা যাবে না। ধর্ষককে রোধ করতে হবে মগজে জ্বালাই করে। তাহলে কোন নারী রাস্তায় ঘাটে বাসে ট্রামে অপদস্ত না হয়ে বরং সম্মানীত হবে।
সূর্যরশ্মি হাত দিয়ে ধরতে পারে না কেউ কেবল অনুভব করতে পারে। শিক্ষাটাও তাই। শিক্ষার প্রভাব সুদূর প্রসারী। টট আইন প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা দরকার। যৌনতা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এর জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন। এর সাথে সমাজ ব্যবস্থা,বংশ উৎপাদন সর্বোপরি মানসিক এবং শারীরিক প্রশান্তির ব্যাপার রয়েছে। জোর করলে এর কোনটাই পাওয়া যায় না বরং অন্যায় হয়ে গেলো। সে যেই করুক,নারী কিংবা পুরুষ! এ শিক্ষা কুঁড়ি থেকেই দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন যে তারা তলে তলে সবই করবে প্রকাশ্যে যৌনতা শব্দটি মুখে আনতেও লাল হতে যায়! আবার প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ ভালোবেসে যদি একসাথে থাকতে চায় সেটাও গ্রহণ করবে না। কিন্তু কবুল নামক শব্দের দোহাই দিয়ে প্রেমহীন,ভালোবাসাহীন,জোর জবরদস্তির দিন কাটাবে। সেটাও যে অন্যায়, সেটাও যে ধর্ষণ তা মানবে না।
সামাজিক ব্যাধি মানুষের অন্তরে, মনে,চিন্তায়,মগজে। এ ব্যাধি মগজ থেকে দূর না করলে আইন দিয়ে কোন অন্যায় রোধ করা যাবে না।
বিভিন্ন আইনের অপপ্রয়োগ অপব্যাখ্যা চলেই আসছে। মানুষই আইন তৈরি করে মানুষই সে আইনের অপব্যাখ্যা করে। ধর্ষণ অনাদি কাল থেকেই ছিলো আছে থাকবে যদি মগজ না পালটায় অন্যায় রোধ হবে না। যেমন করে দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তেমনি করে ক্ষমতার অপব্যবহার, শিষ্টাচারের অভাব আমাদের অনু-পরমানুতে প্রবেশ করছে।
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
প্রথমতঃ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক থেকে উচ্চশিক্ষা কোথাও আসন ব্যবস্থার ভিন্নতা থাকতে পারবে না। কিন্তু নারীর জন্য আলাদা ওয়াশব্লক রাখতে হবে( কেউ কেউ বলবে সমান অধিকার তাহলে আলাদা কেন,তাদের জন্য পরামর্শ নিজের মা এবং মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন)
দ্বিতীয়ঃ মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া।
তৃতীয়তঃ নারী শিশু পুরুষ শিশু বৈষম্যমূলক ক্যারিকুলাম বাদ দিয়ে সাম্য এবং সমতা ভিত্তিক ক্যারিকুলাম প্রণোয়ন করা,
চতুর্থতঃ টট আইন ইনক্লুইড করা আপ টু ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ধাপে ধাপে।
পঞ্চমতঃ পঞ্চমত শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা,যৌন শিক্ষা, বয়ঃসন্ধির সমস্যা উত্তোরণ, যৌবনের করণীয় কাজ,
ষষ্ঠতঃ আজাইরা মুখস্ত বিদ্যা না শিখিয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
সপ্তমঃ কিশোর- যুবক আলাদা সংগঠন,সংঠনের কাজ, পাঠক ফোরাম, লাইব্রেরি মুভমেন্ট,সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ মুভমেন্ট,সামাজের সাথে প্রত্যক্ষ ইনভলভমেন্ট নির্ধারণ করে তা বলবৎ করা।
অষ্টমতঃ শিশু কিশোরদেরকে ভয় কিংবা লোভ দেখিয়ে নয় বরং মননের পরিশীলন করে কোনটি মানবতার জন্য ক্ষতিকর তা বুঝিয়ে দেয়া।
নবমতঃ রাষ্ট্র কর্ম সংস্থান করবে,সকল নাগরিককে উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত করবে, ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থ অনর্থের মূল-
সরকারি কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির এতো ঐশ্বর্য আসে কোথা থেকে তা জনগণকে জানাতে হবে কারণ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এতো বৈভবের মালিক কী করে হয় তা জানাতে হবে রাষ্ট্রকে।
শুধুমাত্র রাজনৈতিক অপপ্রভাব বন্ধ করতে পারলে দেশ থেকে দুর্নীতি, ধর্ষণ,ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন সব বন্ধ হয়ে যাবে।
তবুও আইন জরুরী। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড মানবতা বিরোধী। এই আইন দ্বারা প্রকৃত দোষীরা টাকা এবং রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে পার পেয়ে যাবে। আবার এই আইনকে মিসইউজ করে বিপরীত ঘরানার মানুষেরা অন্যায় ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
তথাপিও সাধুবাদ মানসিক শুদ্ধাচারে না হলেও যদি ভয় পায়,যদি নারীদের চলাচল মুক্ত হয় তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখকর হবে।
নারীদের আহবান জানাই- আসুন আমরা আমাদের বাবা- কাকা- জেঠা -ভাই- সন্তানদের মানুষ হতে শেখাই।
পুরুষদের আহবান করি- আসুন পস্পরকে সম্মান করি। আখেরে আপনাদেরই লাভ। নারী মাত্রই ভালোবাসার প্রতীক। আপনি প্লিজ জোর নয় ভালোবাসুন। আমরা চাই না আমাদের সন্তানদের মৃত্যুদণ্ড হোক। একজন সন্তান লালন কতো কষ্টের তা মা-বাবাই জানেন অন্য কেউ নন।
রাজনৈতিক অপপ্রভাব থেকে আমাদের সন্তানেরা মুক্ত থাকুক।সকল অন্যায় বন্ধ হয়ে যাবে।
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ)
মুন্সীগঞ্জ পিটি আই
কবি,প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক