সেক্যুলারদেরই রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করতে হবে- সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

PicsArt_07-20-01.45.51.jpg

সেক্যুলারদেরই রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করতে হবে- সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়ার প্রতি সম্মতি জানাতে বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া এসেছে। কিছু প্রতিক্রিয়া বেশ আলোচনাযোগ্য।
একটি প্রতিক্রিয়া এসেছে, যেখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামেরা একই ধরনের কথা বলেছেন। তারা বলছেন, প্রথাগত ছাত্র রাজনীতি (মানে বাংলাদেশে যে ধরনের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি মার্কা ছাত্র রাজনীতি চলে) করতে না দিলে মৌলবাদ জেগে উঠবে বুয়েট ক্যাম্পাসে বা দেশের সর্বত্র। এই কথাটি কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন–একই ধরনের পরিবেশে মৌলবাদ তার জায়গা পেলে সেক্যুলাররা কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে পারবে না? এর অর্থ কি এই যে, ক্ষমতার কাঠামোতে বিচরণ করে রাজনীতি না করলে সেক্যুলাররা আসলে কিছু করতে পারেন না?

কথাটি বিবেচনার দাবি রাখে। ষাটের দশকে, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রীয় সব সুবিধা পেয়েও কি সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি এদেশের মানুষের মন জয় করতে পেরেছে? যে জামায়াত-শিবিরের কথা বলা হয়, জাতীয় পর্যায়ে তাদের ভোট কি কখনও তিন শতাংশের বেশি লক্ষ করা গেছে? 

আমার কেন যেন মনে হয়, সেক্যুলাররা নিজেদের শক্তি নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতার ভূমিকাটা আসলে কী? কোথায় যেন একটা বিচ্যুতি ঘটে গেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা যায়, সেই সেক্যুলাররা মৌলবাদের সঙ্গে আপস করে চলে বলেই কি সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করে মৌলবাদকে ক্ষমতাবান মনে করছে? 

সেক্যুলারদের এই মনোভাব স্বভাবে পরাশ্রিত। জামায়াত শিবির দেশের ঘৃণিত রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের বিরোধিতাই কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। অন্যান্য অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে মিলে মিশে চলে, শুধু জামায়াত বিরোধিতা করলে সেক্যুলারদের জন্য সমাজে কোনও অবস্থান আসলে তৈরি করে কিনা, সেটা ভেবে দেখা দরকার। 

সেক্যুলারদের আসলে ভাবতে হবে, তারাই কি রাজনীতির এজেন্ডা স্থির করবেন কিনা, নাকি মৌলবাদের অ্যাজেন্ডায় অবগাহন করে রাজনীতি করবেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী উদার, অসাম্প্রদায়িক কিন্তু ধর্মপ্রাণ বাঙালির একদা আশ্রয়স্থল সেক্যুলাররা কেন হাল ছেড়ে দেবেন বা উদ্যম হারাবেন?

কথা হচ্ছিল ষাটের দশকের এক ছাত্র নেতার সঙ্গে। তিনিও বললেন, একটি ভ্রান্ত ও অমূলক ভাবনা। সরকারি মদদে সব ধরনের চেষ্টা করেও ওই সময় মৌলবাদীরা কোনও সুবিধা করতে পারেনি। আপামর ছাত্র-জনতা উদার ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণেই থেকেছে সব সময়। 

এখন যারা সেক্যুলার রাজনীতি বা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির কথা বলে তারা আসলে রাজনীতি কতটা করছে সেটাই বিবেচ্য। আমাদের মাঝে এখনও যারা দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ আছেন, তাদের প্রায় সবাই স্বাধীনতার-পূর্ব কালের। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চললো, কিন্তু সত্যিকারের জাতীয় নেতা হিসেবে ভাবা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়, এমন কোনও জাতীয় নেতা কেন এই সময়টায় ছাত্র রাজনীতি থেকে ‘পয়দা’ হলো না, সেই প্রশ্ন কি করছেন, যারা বলছেন, ছাত্র রাজনীতি না থাকলে ময়দান দখলে নিবে মৌলবাদ? এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সেই সুযোগটা এসেছিল। স্বৈরাচারকে হটানোর পর এই সুযোগটা হয়েছিল। আমাদের ছাত্র নেতারা তা নিতে পারেননি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, এরশাদের পতনের অব্যাহতি পরেই মনোনয়ন বাণিজ্যসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন নব্বইয়ের ছাত্র নেতারা। মূলত ছাত্র রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয় নব্বই দশকের পর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা থেকেই। দু’টি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনই কোনও গঠনমূলক রাজনীতির জন্য আলোচনা নেই। 

যেখানে নির্বাচন করতে গেলে কোটি কোটি টাকা লাগে, পেশীশক্তি লাগে, সেখানে ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় নেতা তৈরির সম্ভাবনা থাকে না। ছাত্র নেতারা তাই শুরু থেকে লেগে পড়েন অর্থ বিত্তের দিকে। এ কারণেই সেক্যুলার রাজনীতি তার নিজের রাজনীতির  এজেন্ডা স্থির করতে পারছে না। এই দুর্বল স্বভাবের রাজনীতি চর্চায় কোনও আত্মপ্রত্যয় থাকে না। এই রাজনীতি দুর্বল, পরাশ্রিত ও প্রতিক্রিয়াজীবী।  

ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সদা প্রস্তুত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও তাদের দ্বারা লালিত-পালিত বুদ্ধিবৃত্তিক চক্র। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। কিন্তু আমরা যারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতেই হবে। এটাই সহজ কথা। তাই তারা সব দখলে নিয়ে নেবে—এই ভাবনায় না থেকে ওদের চেয়ে বেশি প্রত্যয়ের কথা সাধারণের মাঝে ছড়াতে হবে।  

সাম্প্রদায়িকতা অসহিষ্ণু ও নির্মম। সেই আচরণ  যখন মাঝে মাঝে সেক্যুলারদের কাছ থেকে আসে, তখন সহজেই অনেক সাধারণ তো বটেই, অসাধারণরাও সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সাফল্যের একটি হলো—মানুষের মনে একটি উন্নয়নস্পৃহা জাগাতে পেরেছেন তিনি।

বাঙালির উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিতে উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের বিকাশ বা উন্নয়নের ভাবনাকে সেই স্তরে নিতে হলে শাসক দলের মূল কাঠামোসহ সবাইকেই ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রত্যয়ী হতে হবে। 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top