২৩৯ কোটি নয়ছয় বিএসএমএমইউতে

Picsart_24-03-16_16-10-12-649.jpg

বিশেষ প্রতিবেদকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) দেশের প্রথম চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির আটটি খাতে ২৩৯ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার ৬৫৯ টাকা লোপাটের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। অগ্রিম অর্থ নিয়েও গবেষণার কাজ করা হয়নি। গৃহীত অর্থ ফেরতও দেওয়া হয়নি। 

এ ছাড়া বিভিন্ন খাতের অনিয়মের মধ্যে রয়েছে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে উচ্চ দরদাতার মাধ্যমে ইএসডব্লিউএল মেশিন নেওয়া, ইউজার ফি নিয়ে অনিয়ম, উৎসে আয়কর কর্তন না করা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৭ লঙ্ঘন করে কেন্দ্রীয় তহবিলে অতিরিক্ত টাকা স্থানান্তর না করা, রি-এজেন্ট সামগ্রী ক্রয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি অর্থ-ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। অনিয়মে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়ম কমছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সালের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, অডিটে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়ম ও বিধি-বিধান লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও আর্থিক বিধি-বিধান পরিপালন করা হয়নি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাবিষয়ক ১৬টি গবেষণা কাজের জন্য ১৬ জন গবেষককে ৬০ শতাংশ অগ্রিম হিসেবে ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বিল, ভাউচার, গবেষণা সূচি ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০ মাস পেরিয়ে গেলেও অগ্রিম সমন্বয় করে পরবর্তী কিস্তি নেওয়া হয়নি। অগ্রিম গৃহীত অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি। 

বিষয়টি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে ২০২২ সালের ২৯ জুন প্রতিষ্ঠান বরাবর এআইআর পাঠানো হয়। ৬ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব বরাবর তাগিদপত্র এবং ১৬ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) পাঠানো হলেও নিষ্পত্তিমূলক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। 

সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে উচ্চ দরদাতার মাধ্যমে ইএসডব্লিউ মেশিন সরবরাহ নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এক্সট্রাকরপোরিয়াল শক ওয়েভ লিথোট্রিপসি (ইএসডব্লিউএল) মেশিন সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে দুজন দরদাতা দরপত্র দাখিল করেন। আনিফকো হেলথ কেয়ার উদ্ধৃত দর ৩ কোটি টাকা এবং সানি ট্রেডিং এজেন্সির উদ্ধৃত দর যা সর্বনিম্ন দরদাতার চেয়ে ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা বেশি ছিল।

আদায় করা ইউজার ফি থেকে প্রাপ্য কমিশনের অতিরিক্ত নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। নিরীক্ষাকালে ক্যাশবই, আয়-ব্যয় বিবরণী এবং বিল-ভাউচার যাচাইয়ে আদায় করা ইউজার ফি থেকে প্রাপ্য কমিশনের অতিরিক্ত নেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য টিকেট ফি, ভর্তি ফি, বিছানা ও কেবিন ভাড়া, চিকিৎসা সেবা ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত আরোপিত আদায়যোগ্য সব আয়কে ইউজার ফি বলা হয়। ইউজার ফির নিট লভ্যাংশের ৩০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও টেকনোলজিস্ট-টেকনিশিয়ান এবং কর্মচারীদের মধ্যে কমিশন হিসেবে বণ্টনের নির্দেশ রয়েছে হাইকোর্টের। তা না করে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ কমিশন বণ্টন করা হয়েছে। 

ব্যক্তিগত প্রফেশনাল সার্ভিসের ওপর কমিশনবাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে উৎসে আয়কর কর্তন না করায় সরকারের ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৯৪ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। নিট মুনাফার ৩০ শতাংশ হারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও টেকনোলজিস্ট-টেকনিশিয়ান এবং সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রফেশনাল সার্ভিসের জন্য প্রদেয় কমিশনের পরিমাণ ৯৬ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৯৪৪ টাকা। এ কমিশনের ওপর ১০ শতাংশ হারে আয়করের পরিমাণ ৯ কোটি ৬৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৯৪ টাকা। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেশনাল সার্ভিস কমিশনের ওপর কোনো আয়কর কর্তন করা হয়নি। 

আপত্তি করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক বলে মনে করে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক দফতর। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৭ লঙ্ঘন করে বিভাগের নিজস্ব তহবিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অতিরিক্ত টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে স্থানান্তর না করে অনিয়মিতভাবে ৮০ কোটি ৯৮ লাখ ৭৩ হাজার ৬১৭ টাকা সংরক্ষণ করা হয়েছে। 

আদায় করা ইউজার ফি থেকে প্রাপ্তব্য কমিশনের অতিরিক্ত গ্রহণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ৭৩ লাখ ৩০ হাজার ৩১ টাকা। অতিরিক্ত টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিলে ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিরীক্ষার সুপারিশে আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আপত্তি করা টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বিধি ও হিসাব রক্ষণ পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রবিধান ২০১৭-এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কোটেশন পদ্ধতিতে রি-এজেন্ট সামগ্রী ক্রয়বাবদ সীমাতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় ২৭ কোটি ৪৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৯ টাকা। কোটেশন পদ্ধতিতে ১১টি বিভাগের জন্য রি-এজেন্ট সামগ্রী কেনা হয়েছে। পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ৬৯ (১) অনুযায়ী কোটেশন পদ্ধতিতে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে অনধিক ৩ লাখ টাকার উল্লেখ রয়েছে, তবে বছরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবে। এক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রতিপালন করা হয়নি। 

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ইতিমধ্যে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব অনিয়মে ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে। রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় উচ্চমূল্যে যন্ত্রপাতি ক্রয়, ইউজার ফি নিয়ে অনিয়ম, কর ফাঁকি দেওয়া এ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা করি। তবে এ ধরনের অনিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেবে এটি প্রত্যাশা করা যায় না। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনিয়মে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এ ধরনের প্রতিবেদন হবে, কিন্তু দুর্নীতি ও অনিয়ম কমবে না।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের  (বিএসএমএমইউ) উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) ও কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, অডিট আপত্তি না দেখে কিছু বলতে পারছি না। প্রতিবেদন দেখে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে তিনি জানান।

আরও সংবাদ পড়ুন।

সারাদেশে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধের নির্দেশ – স্বাস্থ্যমন্ত্রী’র

আরও সংবাদ পড়ুন।

শিক্ষা-সেবা-গবেষণায় প্রাধান্য দেবে বিএসএমএমইউ – উপাচার্য ডা. দীন মো. নূরুল হক

আরও সংবাদ পড়ুন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনিয়ম ও দূর্নীতি; ২২ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার

আরও সংবাদ পড়ুন।

বিএসএমএমইউ উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ

আরও সংবাদ পড়ুন।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়ে হতবাক স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সহ কর্মকর্তরা

আরও সংবাদ পড়ুন।

সারাদেশে অবৈধ এক লাখ ফার্মেসি বন্ধ করা হবে – ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক

আরও সংবাদ পড়ুন।

স্বাস্থ্য বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ – দেশের স্বার্থ নয় দলীয় স্বার্থে হচ্ছে নিয়োগ

আরও সংবাদ পড়ুন।

স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি – হাইকোর্ট

আরও সংবাদ পড়ুন।

ডাক্তারা শুধু টাকা কামাতেই ব্যস্ত – শেখ হাসিনা

আরও সংবাদ পড়ুন।

হৃদরোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশ স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top