এস এম আশিকুজ্জামান ও তার স্ত্রী ফারজানার নামে কোনো জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, দোকান আছে কি না জানাতে গত ৩ সেপ্টেম্বর দেশের বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস ও রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। সে অনুসন্ধানের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কমিশন অভিযোগের অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়োগ দিয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক এস এম আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে সংস্থার জায়গা নিজের লোকেদের নামে দখলে রাখা, অন্যদের হাজার-হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি দখলে রাখার সুযোগ দেওয়া, টেন্ডার না দিয়ে জাহাজ মেরামত, জাহাজ ক্রয়-বিক্রয়, ওটিআর মালামাল বিক্রি, জাহাজ ভাড়া, সংস্থার বিল্ডিং ভাড়া প্রভৃতি অভিযোগ রয়েছে। তার দুর্নীতির কবল থেকে বিআইডব্লিউটিসিকে বাঁচাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাধিকবার মিছিল, মিটিং ও মানববন্ধন করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। উপায়ান্তর না পেয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে। কমিশন অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দায়িত্ব দিয়েছে। তিনি অভিযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়ে গত ২১ মার্চ বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানের দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে নথিপত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ২৭ মার্চের মধ্যে দুদকে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দুদকের চিঠিতে যে নথিপত্র চাওয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক ২০১৮ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ছাড়পত্র, নিয়োগসংক্রান্ত বিধিমালা, পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামের তালিকা, নিয়োগপ্রাপ্তদের (পদ পৃথক ভাবে) জেলা ভিত্তিক তালিকা, নিয়োগ সংক্রান্ত সব সভার কার্যবিবরণী, নোটশিটের ফটোকপি, ২০১৮ সালের নিয়োগ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে কোনো তদন্ত হয়ে থাকলে সে সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন।
এস এম আশিকুজ্জামানের এজিএম থেকে জিএম পদে পদোন্নতি সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, সহব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. ইকবাল হোসেন, চালক সজিব হাওলাদার, মেকানিক খালেদ হোসেন কিরণের নথির সত্যায়িত ফটোকপিও চাওয়া হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া (আরিচা) নৌরুটে ফেরিতে লুজ যাত্রী পারাপারের টিকেটিং এজেন্ট নিয়োগের বিধি/নীতিমালা, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ইজারা প্রদানসংক্রান্ত নথিপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি এবং এসটি জব্বার জাহাজ কী প্রক্রিয়ায় মেরামত করা হয়েছে, সে সংক্রান্ত চাহিদাপত্র, প্রশাসনিক অনুমোদন, কমিটি যাচাই প্রতিবেদন, পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি, দাখিলকৃত দর, রেজল্যুশন, তুলনামূলক বিবরণী, কার্যাদেশ, চুক্তিপত্র, নোটশিটের ফটোকপি, বিল পরিশোধের ভাউচারসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রও চাওয়া হয়েছে।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে, আশিকুজ্জামান এজিএম ফিডার পদে দুই বছর পূর্ণ না করেই ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল ডিজিএম (সাময়িক) পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। ‘সাময়িক পদোন্নতি’ বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রবিধানমালায় নেই। এরপর তিনি ডিজিএম পদে তিন বছর পূর্ণ না করেই অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপকের (বাণিজ্য, যাত্রী ও ফেরি) দায়িত্ব নেন। এ পদোন্নতিও দেশের প্রচলিত আইনে নেই।
অভিযোগে বলা হয়, আশিকুজ্জামান ২০১৮ সালের ৬ জুন পরিচালক (বাণিজ্য) হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপরই তিনি ও মহসিন ভূঁইয়া গং মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অস্থায়ী হিসেবে ৬০০ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিজনের কাছ থেকে ২-৩ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। এ ছাড়া সংস্থার বিধিবিধান অমান্য করে ৪২ বছরের ইকবাল হোসেনকে সহব্যবস্থাপক (বাণিজ্য), ৪০ বছরের সজিব হাওলাদারকে গাড়িচালক এবং ৪৫ বছরের খালিদ হোসেন কিরণকে অর্ধদক্ষ মেকানিক পদে নিয়োগ দেন তিনি।
অভিযোগে আরও বলা হয়, লুজ যাত্রী পারাপারে আরিচা ফেরিঘাট টেন্ডারের মাধ্যমে এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি বছর ফেরিঘাট টেন্ডারে ইজারা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে ফেরিঘাটের ডাক ২২ লাখ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু তা বাতিল করে ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ৯৬ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এতে সরকারের ২১ লাখ ৪ হাজার টাকা গচ্চা যায়। এ ছাড়া টেন্ডার ছাড়াই পদ্মা সেতুর পিলার মেরামতে ১০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়।
অভিযোগে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের হাতিয়া থেকে ভাসানচর পারাপারের জন্য এসটি জব্বার জাহাজটি টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়াই মেরামত করেন তিনি। ২০২১ সালের ১১ মার্চ ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয় করে পছন্দের ডকইয়ার্ডে এটি মেরামত করান। একইভাবে আইভি রহমান জাহাজটি একই ডকইয়ার্ডে মেরামত করান। এতে সরকারের বিপুল ক্ষতি হয়েছে।
অভিযোগ আছে, এমভি বঙ্গমাতা ও এমভি বঙ্গতরী নামে দুটি জাহাজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংস্থার বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এর মূল দায়িত্বে ছিলেন। টেন্ডারে একটি কোম্পানিকে জাহাজ তৈরির ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয় এবং এর জন্য ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু জাহাজ পাওয়া যায়নি। আশিকুজ্জামান প্রায় ১৫ বছর ধরে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রভাবশালী হওয়ায় সংস্থার জমি দখল, বিভিন্ন কেনাকাটা, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিসহ সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব রয়েছে। আর এসব খাত থেকে অবৈধভাবে আয় করে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
দুদক সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এস এম আশিকুজ্জামান ও তার স্ত্রী ফারজানার নামে কোনো জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, দোকান আছে কি না জানাতে গত ৩ সেপ্টেম্বর দেশের বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস ও রেজিস্ট্রি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। সে অনুসন্ধানের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
চলতি মাস থেকে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির আরেকটি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
আরও সংবাদ পড়ুন।
ঘুষ নিয়ে ধরা খেয়েও কয়েক দফা পদোন্নতি; বিআইডব্লিউটিএ এর ঘুসের নিয়ন্ত্রণ করে কে?
আরও সংবাদ পড়ুন।