৩৩ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; উপজেলা পরিষদ
চেয়ারম্যানের কর্তৃত্বই প্রতিষ্ঠিত
বিশেষ প্রতিবেদকঃ বিদ্যমান আইনে উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হলেন চেয়ারম্যান। তার কর্তৃত্বেই সম্পন্ন্ন হবে পরিষদের যাবতীয় কাজ। আর এসব কাজে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সরকারি সুযোগ-সুবিধাও বেশি থাকার কথা চেয়ারম্যানের।
কিন্তু ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন করে ইউএনওকে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়। আইন সংশোধনের পর ইউএনওরা চেয়ারম্যানদের উপদেষ্টা করে নিজেরাই উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটির সভাপতি বনে যান। ফলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, ‘নির্বাচিত চেয়ারম্যারা ইউএনওর অধীনস্থ কর্মচারী।’
বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের রায়ে শেষ পর্যন্ত উপজেলায় আর আমলাদের কর্তৃত্ব থাকল না।
উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, ইউএনও উপজেলা পরিষদে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকবেন না। সংশোধিত উপজেলা পরিষদ আইন ২০১১ চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি রিট পিটিশন দায়ের হয় সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে। যার একটি হচ্ছে হারুন আর রশীদ হাওলাদার বনাম রাষ্ট্র মামলা নং-৯৫৯৩/২০২০।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি সোহেল চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ ২৯ মার্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বলা হয়, সংবিধানের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদই উপজেলা প্রশাসন। অর্থাৎ এতদিন উপজেলা প্রশাসন বলে যা বলা হয়েছে, তা সঠিক ছিল না। উপজেলা প্রশাসন লেখা ঠিক হয়নি।
রায়ে আরও বলা হয়, সংশোধিত উপজেলা পরিষদ আইন ২০১১-এর ৩৩ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং ওই আইনের বিতর্কিত ধারাটি বাতিল করা হলো। অর্থাৎ ইউএনও আর উপজেলা পরিষদের আওতায় গঠিত কোনো কমিটির সভাপতি থাকতে পারবেন না।
নির্ধারিত কাজের বাইরে ইউএনও উপজেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেবেন। ২০১০ সালে জারি করা চার্টার্ড অব ডিউটিজ অনুসরণ করে হস্তান্তরিত ১৭ বিভাগের কাজ উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুমোদনে সম্পন্ন হবে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণে জুডিশিয়াল চার্জ গঠন করতে হবে।
তাছাড়া আইনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর তাদের অপসারণ, অনির্বাচিতদের ভোটে পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ না করার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। অর্থাৎ উপজেলা পরিষদের জন্য যারা নির্বাচিত নন, তাদের ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা যাবে না। উচ্চ আদালত দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. হারুন আর রশীদ হওলাদার গণমাধ্যমে বলেন, দেশের সংবিধান ও উপজেলা পরিষদ আইন অমান্য করে অফিস আদেশ, পরিপত্র ও প্রজ্ঞাপন জারি করে উপজেলা পরিষদ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। তার প্রশ্ন-জাতীয় সংসদে প্রণীত আইন বড় না পরিপত্র বড়? আইনের বিধান কি পরিপত্রে বাতিল করা যায়?
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। উপজেলা পরিষদ আইনের বেশ কিছু ধারা বিভিন্ন সময়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাতিল করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, টপ টু বটম আমলাদের মানসিকতার সমস্যা। তারা কোনোভাবেই জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্ব মানতে চান না। তারা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সেই কথা ভুলে যান। সবকিছু একক কর্তৃত্বে করতে চান। জনপ্রতিনিধিদের তারা তুচ্ছজ্ঞান করছেন। আমরা উচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ। আদালত সংবিধান ও আইন অনুসারে রায় দিয়েছেন।’
একাধিক উপজেলা চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে বলেন, উপজেলা পরিষদ বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা আইন অমান্য করা। উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ১২০টি কমিটির অধিকাংশটিতে ইউএনওকে সভাপতি এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সদস্য সচিব করা হয়েছে। কোনো কোনো কমিটিতে এমপি ও চেয়ারম্যানদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। অথচ চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করার আইনি কোনো বিধানই নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জারি করা পরিপত্রে আইন ভঙ্গ করা হয়েছে।
তারা আরও জানান, ১৩টি মন্ত্রণালয়ের ১৭টি বিভাগের উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ গঠিত কমিটিগুলোয় চেয়ারম্যানকে সভাপতি এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরপ্রধানকে সদস্য সচিব করে নীতিমালা সংশোধন করা প্রয়োজন।
চেয়ারম্যানরা আরও বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের এক আদেশে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অনুকূলে বরাদ্দ করা জিপ গাড়ি কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে নিজ উপজেলা ও জেলার বাইরে ব্যবহারের সুযোগ নেই। বিনা অনুমতিতে নিজ উপজেলা ও জেলার বাইরে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে এর দায় গ্রহণ করতে হবে এবং উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮-এর ১৩ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চেয়ারম্যানরা বলছেন, গাড়ি ব্যবহার নিয়ে তাদের জন্য সতর্ক আদেশ জারি করা হলেও ইউএনওদের গাড়ি ব্যবহারে কোনো আদেশ দেয়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ। অথচ ইউএনওদের গাড়ি আধুনিক মডেলের এবং চেয়ারম্যানদের গাড়ির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম। অবার ইউএনওর জ্বালানি তেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও চেয়ারম্যানদের ক্ষেত্রে তা বাড়ছে না। বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যানদের মনোবেদনা সীমাহীন। উল্লেখ্য, চেয়ারম্যানরা প্রতিমাসে জ্বালানি পাচ্ছেন ২১০ লিটার এবং ইউএনওরা পাচ্ছেন ২৫০ লিটার।
সরকারের তরফ থেকে আমলাদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার তাগিদ দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে চেয়ারম্যান ও ইউএনওর বনিবনা হচ্ছে না। মনোবেদনা নিয়েই অনেকটা বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে চেয়ারম্যানদের। তবে জানা যায়, তাদের দ্বন্দ্বের কারণে মাঠপর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক সব কার্যক্রমে মুখ্য ভূমিকা থাকে স্থানীয় সংসদ-সদস্যের।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বুধবার গণমাধ্যমে বলেন, আমি একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আগামী মে মাসে আমার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে আদেশ, পরিপত্র এবং প্রজ্ঞাপন জারি করে পরিষদ অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বহু কথা হয়েছে। আর কোনো কথা বলার আগ্রহ নেই।
আরও সংবাদ পড়ুন।
আরও সংবাদ পড়ুন।
প্রধান বিচারপতির নির্দেশে – বগুড়ার সেই বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিনকে প্রত্যাহার
আরও সংবাদ পড়ুন।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী হাইকোর্টে সুনির্দিষ্ট বিচারিক এখতিয়ার দিয়ে ১৬ বেঞ্চ গঠন করলেন