জেলা প্রশাসক পোস্টিং নিয়ে বিস্তর অভিযোগ

Ban_Govt4.jpg

জেলা প্রশাসক পোস্টিং নিয়ে বিস্তর অভিযোগ
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা, নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি অনেকের

বিশেষ প্রতিবেদকঃ সাম্প্রতিক ডিসি পোস্টিং নিয়ে প্রশাসনে নানামুখী সমালোচনার ঝড় বইছে। বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অভিযোগকে সামনে এনে ডিসি পোস্টিংয়ের পূর্বাপর নানা ঘটনার পোস্টমর্টেম চলছে।

মাঠ প্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিয়ে প্রকৃতপক্ষে সরকারপন্থি, পেশাদার এবং একশ্রেণির সুবিধাভোগী রঙ বদলানো আমলাদের মধ্যে চাপা অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমেই চাউর হতে শুরু করেছে।

মোটা দাগে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগের তীর প্রশাসনের প্রভাবশালী একটি গ্রুপের দিকে। যারা সব ক্ষেত্রে তাদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ধরে রাখতে পছন্দের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি পদে পোস্টিং কিংবা এক জেলা থেকে অধিকতর বড় জেলায় পদায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। মূলত প্রভাবশালী মহলের চাপে ডিসি পোস্টিং নিয়ে অন্তত এক সপ্তাহ ধরে খসড়া প্রস্তাব ঘষামাজা করা হয়। এর ফলে একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে এমন কয়েকজন কর্মকর্তার নাম বাদ পড়েছে, যারা একদিকে মেধাবী এবং অপরদিকে সরকারের খুবই আস্থাভাজন।

এমনকি শত চেষ্টা করেও সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কেউ কেউ তাদের নাম বহাল রাখতে পারেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো গণমাধ্যমে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু একটি উদাহরণ দিলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উপসচিব শাকিল আহমেদ ২৫তম ব্যাচের একজন মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা। মেধাতালিকায় যার সিরিয়াল-৭। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তার পিতা সিরাজ উদদীন আহমেদ একজন ইপিসিএস কর্মকর্তা।

১৯৭৫ সালে তিনি ছিলেন তৎকালীন বরগুনা মহকুমার প্রশাসক (ডিসি)। ওই বছর ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সংবাদ পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক তীব্র প্রতিবাদ জানান। সেদিন সামরিক সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে তিনি মহকুমায় সামরিক আইন ও কার্ফু জারি করেননি। বরং অস্ত্র হাতে নিয়ে জনগণকে এই হত্যার প্রতিবাদ জানানোর আহবান জানান। সাহসী এই কর্মকর্তা পিএসসির সদস্য হিসেবে সবশেষ চাকরি থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। বর্তমান সরকার তাকে এ বছর স্বাধীনতা পদক পুরস্কারেও ভূষিত করেছেন। অথচ তার যোগ্য সন্তানকেও এবার ডিসি পদে পোস্টিং দেওয়া সম্ভব হয়নি। সব দিক বিচার-বিশ্লেষণে শাকিল আহমেদ যোগ্য বিবেচিত হওয়ায় তাকে একটি জেলায় নিয়োগ দেওয়ার জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জানতে পারলে নিশ্চয় প্রধানমন্ত্রীও কষ্ট পাবেন।’

এ কর্মকর্তা জানান, ‘এভাবে আরও কয়েকজন ভালো কর্মকর্তাকে আমরা ডিসি করতে পারিনি। এছাড়া কর্মরত ডিসিদের মধ্যে যাদের পারফরম্যান্স খুবই ভালো তাদের বড় জেলায় পোস্টিং দেওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ ডিসি হিসাবে যাদের প্রাইজপোস্টিং দেওয়া হয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য নানারকম অভিযোগ রয়েছে। যেসব বিষয়ে সঠিকভাবে তদন্ত হলে তাদের পোস্টিং পাওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক খবর পৌঁছালে তিনি জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবেন না। এ বিশ্বাস আমাদের আছে।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরাসরি মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পরিচালনা ও মনিটরিং করে। বিশেষ করে ডিসি এবং ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।

অথচ ডিসি পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। নতুন ডিসি পদায়নের ক্ষেত্রে মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নাও থাকতে পারে, কিন্তু কর্মরত ডিসিদের অন্য জেলায় পদায়ন কিংবা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত নেওয়া খুবই জরুরি ছিল।’ তিনি জানান, ‘এ নীতি অনুসরণ না করায় কর্মরত ডিসিদের অন্য জেলায় পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পারফরম্যান্স রিপোর্ট মূল্যায়নে আসেনি।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি বদলি হওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘উনাদের তদবিরের চাপে তিনি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ যার বিষয়ে দুর্নীতিসহ বিস্তর অভিযোগ ছিল, শেষ পর্যন্ত তাকেও ডিসি করা হয়েছে। কিছুই বলার নেই।’ তিনি জানান, নতুন নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে দুজন কর্মকর্তার বিষয়ে প্রথমে রাজনৈতিক পরিচয়ের নেগেটিভ রিপোর্ট ছিল। পরে তাদের রিপোর্ট পজিটিভ কীভাবে হলো তা খুবই রহস্যজনক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত অবস্থায় একজনের বিরুদ্ধে তো বড় ধরনের অভিযোগ ছিল। বিদেশে উচ্চশিক্ষার ছুটিতে থাকাকালে যার বিরুদ্ধে বড় একটি অপরাধের বিষয়ও চাউর হয়েছিল। যা ওই মন্ত্রণালয়ের অনেকে জানেন। এছাড়া আরও একজনের বিষয়ে নানারকম গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনিও ডিসির খাতায় নাম লিখিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের কারণে আমরা অনেকের স্পর্শকাতর গোপনীয় তথ্য জানি। কিন্তু সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা রক্ষার কারণে সেগুলো পাবলিকলি বলতে পারি না, আবার খুবই প্রভাবশালী সিনিয়রদের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানাতে পারব না। এছাড়া আমাদের কথা তো সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। কাউকে কিছু বলা যায় না। আবার সবাই এখন সাবেক ছাত্রলীগ করা আমলা। প্রশাসনে সরকারি দলের বাইরে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অপর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই মুখ খোলা নিষেধ। কিছুই বলতে পারব না। আমরা যা জানি, আপনারাও কমবেশি তা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছেন। শুধু এতটুকু বলব-আমাদের প্রতিমন্ত্রী অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু এবার ডিসি পোস্টিংয়ে তিনিও শক্ত হাতে শেষ পর্যন্ত সব কিছু করতে পারেননি।’

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘তবে একটা অনুরোধ থাকবে এবারের ডিসি পোস্টিং রিভিউ করা দরকার। আগামী ৪ ডিসেম্বরের পর থেকে অনেকে যোগদান ও দায়িত্ব হস্তান্তর শুরু করবেন। তার আগে গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক মহলের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। কারা, কীভাবে কাদের স্বার্থে ডিসি পোস্টিংয়ে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের নাম রাখতে বাধ্য করেছেন। সব জানা যাবে।’

এদিকে ডিসি পোস্টিং নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কয়েকজন পেশাদার ও সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসন এখন যেভাবে চলছে- সেভাবে চললে সরকারের আরও অনেক ক্ষতি হবে। ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। তারা মনে করেন, হয় একেবারে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দলীয় সরকার স্টাইলে প্রশাসন চালাতে হবে, না হলে শতভাগ পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এর বাইরে ‘আমাদের লোক’ খোঁজার জন্য যাদের প্রেসক্রিপশন ফলো করা হচ্ছে তাতে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে আরও বাড়বে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্টা প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। আজকে যারা আমাদের লোক, কালকে তারা অন্যদের লোক হয়ে যাচ্ছে। এটা বোঝার জন্য দার্শনিক কিংবা বড় পলিটিশিয়ান হওয়া লাগবে না। চোখের সামনে অনেক উদাহরণ রয়েছে।’

বর্তমান সরকারের সময়ে মাঠ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন, এমন একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের জমিকে খাস দেখিয়ে শিপইয়ার্ড কোম্পানির নামে লিজ দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যারা এলআর ফান্ডের টাকা নয়ছয় করেছেন, ব্যাংকে জমা না রেখে নগদে নিয়ে নগদ খরচ করেছেন, লবিং রক্ষার জন্য রীতিমতো লবিস্ট নিয়োগ করেছেন, মাঠ প্রশাসনের কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তাকেও এডিসি রেভিনিউ পদ দিয়েছেন, যাকে আবার ঘন ঘন ঢাকায় পাঠিয়ে লবিং ঠিক রেখেছেন, যিনি ইতোমধ্যে লবিং মাস্টার্স হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, তিনি কী করে আবার ডিসি পদে প্রাইজপোস্টিং পেলেন!’ এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘প্রকৃত সত্য জানতে হলে কিছু ঘটনার গভীরে যেতে হবে। তদন্ত করে জানতে হবে ২১ ব্যাচের কয়েকজন ডিসিকে কারা বেশি সময় ধরে বড় বড় জেলায় বহাল রেখেছেন। এখন আবার ২২ ব্যাচের বিশেষ গ্রুপকে প্রমোট করছেন। কোন সেই ‘মিনি পাওয়ারফুল গ্রুপ’ যারা পাওয়ার হাউসগুলোতে বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। পেছন থেকে সিনিয়রদের কারা তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এ সিন্ডিকেট ভাঙতেই হবে। না হলে প্রশাসন ও সরকারের আরও ক্ষতি হবে।’ তিনি জানান, ‘প্রত্যেকের আমলনামা তৈরি হচ্ছে। সময় এলে সব বের হবে। সব চাটার দল, সব বেইমান। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। অথচ কোনো কারণে সরকার বিপদে পড়লে এদের একজনকেও পাওয়া যাবে না। আমরা যারা ভেজালমুক্ত আওয়ামী পরিবারের সন্তান, সব ঝড়-ঝাপটা আমাদের ওপর দিয়েই যাবে।’

প্রসঙ্গত, গত ২৩ নভেম্বর ডিসি পদে বড় ধরনের রদবদল করা হয়। যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ২১ ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে সেখানে ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ থেকে ১৭ জনকে নতুন পদায়ন এবং কর্মরত ডিসিদের মধ্যে ৬ জনকে অন্য জেলায় পোস্টিং দেওয়া হয়।

আরও সংবাদ পড়ুন।

জেলা প্রশাসক পদে রদবদল;২৩ জেলায় নতুন ডিসি

আরও সংবাদ পড়ুন।

সকলের সম্পদের হিসাব জমা বাধ্যতামূলক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top