কবি আমিনুল ইসলাম – সময়ের নির্ভীক পথিক
কবিরা স্বপ্নবান মানুষ। তারা স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখান। সে স্বপ্ন ব্যক্তির, সে স্বপ্ন জাতির,সে স্বপ্ন বিশ্ববাসীর। কবির চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখে আর দশজন। যার স্বপ্ন নেই, তিনি আর যাই হোন- কবি হতে পারেন না। স্বপ্ন মানে শুধু সুখকল্পনা নয়; স্বপ্ন হচ্ছে ভবিষ্যৎ পথচলার প্রত্যাশা ও দিশা। স্বপ্ন হচ্ছে নির্মাণের আর পুনর্নিমাণের প্রেরণাভূমি। স্বপ্ন হচ্ছে জীবন ও জগতকে দেখার ও গড়ে তোলার বীজতলা। এই প্রেরণাভূমি এই বীজতলায় মাটি জোগান দেয় অতীত, জল ও বীজ দেয় বর্তমান, আর আলো দেয় ভবিষ্যৎ। স্বপ্ন বাস্তবতার হুবহু ছবি নয়; স্বপ্ন বাস্তবের সাথে সম্পর্কহীন কোনো ইউটোপিয়াও নয়। বাস্তব আর অবাস্তবের সুসংমিশ্রিত উপাদানে তৈরী স্বপ্নের শরীর ও মন। মানুষের সব স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হয় না; কখনো কখনো স্বপ্নের ঘরে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে দুঃস্বপ্ন। কখনো বাস্তবের পাথর- দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় স্বপ্ন। কখনো আকাশচারী স্বপ্নের পাখি ঝড়ের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে ভগ্নডানায়।
কিন্তু স্বপ্ন দেখা শেষ হয় না। কারণ, স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। ফলে দগ্ধীভূত স্বপ্নের ছাইভষ্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো আবার জন্ম নেয় নতুন স্বপ্ন। মানুষের জীবন ব্যক্তিপর্যায়ে এবং সমষ্টি পর্যায়েও- স্বপ্ন দেখা , স্বপ্নভঙ্গ আর নতুন করে স্বপ্নে পাওয়ার দোলাচলে দোলায়িত অস্তিত্ব।
আমিনুল ইসলামও একজন স্বপ্নবান মানুষ। কারণ তিনি কবি। তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন, বুক ভরা বেদনা । তার স্বপ্নের ধরন কেমন? একবিংশ শতাব্দীর একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তার দেখার জগৎ প্রসারিত বিশ্বময়। তার স্বপ্নের সিলেবাসও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বিশ্বায়নের এ যুগে তিনি একইসাথে একজন ব্যক্তিমানুষ এবং সমষ্টিমানুষ; তিনি একইসাথে একই জাতীয়তাবাদী মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মানুষ। তিনি একইসাথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কোটরে নির্বাসিত একজন অন্তর্মুখী মানুষ এবং বহির্জগতের সবার সাথে মিলেমিশে থাকা একজন হাটবাজারের মানুষ। তিনি রাজধানী শহরের বসবাস করেন, চাকরিবাকরি করেন, ফলে মিশতে হয় বহুমানুষের সাথে। আবার তিনি আড্ডা, সমিতি, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। অবসর সময়ে আপনাতে আপনি বুঁদ হয়ে থাকা তার অন্যতম স্বভাব। তার মানে অনেক বৈপরীত্বের মাঝে তার বসবাস। এমন মানুষের জীবনে অনিবার্যভাবেই নানাবিধ টানাপোড়েন। তার অনুভূতি ও অনুভব, স্বপ্ন ও কল্পনা-এসবের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্ব বিরাজমান। আর দশজন মানুষের মতো তারও অনেক স্বপ্ন বা অধিকাংশ স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই রয়ে যায়। সেসব বাস্তায়িত হয় না।
আমিনুল ইসলামের একটি কবিতার এবং কবিতার বইয়ের নাম ‘জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার’। ‘জলচিঠি নীল স্বপ্নের দুয়ার’ নামকরণটি তাৎপর্যপূর্ণ। স্বপ্নের চিঠি আর তার গন্তব্যের মধ্যে ব্যবধান এক আকাশ। তবু সে চিঠি সেখানে পৌঁছাতে চায়। হয়তো পারে হয়তো পারে না। প্রথমত কবিতাটি এক আশ্চর্য স্বপ্নভঙ্গের। কী সেই স্বপ্ন? তা কি ব্যক্তিক না সামষ্টিক? তার জবাব ঐ কবিতায় নেই। তা পাঠককে কল্পনা করে নিতে হয়। অথবা খুঁজে দেখতে হবে গ্রন্থের অন্যত্র। আমাদের বোধ-চেতনা জলবায়ুর মতো বদলে যাচ্ছে । অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো ধূসরিত, বেদনার বালুচরে জেগে ওঠে অবাঞ্ছিত ঝোপ-ঝাড়। চেতনার গভীরে নীলজল কোনো কাক্সিক্ষত ছবিই আঁকে না কিংবা আঁকতে পারে না অথবা অদৃশ্য-অশরীরী ছায়ার নিষ্ঠুরতায় বাঁধা পড়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। মুখে বিষাদের ছায়া অথচ চোখের কোণে আশার ঝিলিক । সেই ঝিলিকে থাকে আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার নিবিড়তা। মানুষ-প্রকৃতি-নিসর্গ কেউ কারো থেকে আলাদা নয়। তাই প্রকৃতি যখন বিষণ্ন মুখে তাকায় মানুষ কী করে স্থির থাকে! প্রকৃতির বিষণ্নতার জন্য তো দায়ী অমানবিক বিষয়-আশয়। এখানেই কবি মন চিৎকার করে – রুদ্র রুক্ষ চিন্তার লোলুপ দরজা ভেঙে বের করতে চায় জীবনের গূঢ় অর্থ। আমিনুল ইসলাম এমনই চিন্তার ধারক ও বাহক । তাঁর কাছে জীবন মানে নদী । নদী কারো একার নয়। যে জীবন খেয়ে-পরে জাবর কাটে, মানুষ-সমাজ- রাষ্ট্রের কল্যাণে কারো কাজে লাগে না- সে জীবন তো নিতান্তই আধ-খাওয়া সিগারেট। জীবন-স্বপ্ন-বাস্তবতা ত্রিমাত্রিক সরল রেখায় অবস্থান করলেও স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায় । সে স্বপ্নের ভিত্তিমূল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ ক্যানভাসে কবি আমিনুল ইসলাম সিদ্ধহস্ত অর্ঘ্যকমল । কবিতার শব্দ চয়ন-বিন্যাস, বিষয় প্রকরণ , বর্ণনাশৈলী, উপমায় মিথ-ইতিহাস -ঐতিহ্যের ব্যবহারে ভিন্ন স্বাদ-ভিন্ন মেজাজ কবিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যম-িত করেছে। কবিতার অঙ্গনে তাঁর নিজস্ব জগৎ নতুন আবরণে আবৃত। প্রেমচেতনা-পরাবাস্তবতা বিষয়ক কবিতার উপস্থাপনায় তিনি অনন্য। আধুনিক ইলেকট্রোনিক জীবনের গতিতে দ্রুত প্রবেশরত ভিনদেশী প্রতিশব্দের ব্যতিক্রমী ব্যবহার তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা এবং এখানে তিনি সার্থক ও ঈর্ষণীয়।
মাল্টিকালার স্বপ্নের ফুটবল নিয়ে খেলতে খেলতে
কিপার-হীন পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়েও
পেলের পায়ে শেষ পর্যন্ত গোল হবে না
হে প্রভু, এও কি সম্ভব?’
[সে এক অদ্ভূত ব্যর্থতা, জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার]
আমিনুল ইসলাম একজন আগাগোড়া প্রেমিক কবি। আমিনুল ইসলাম হালকা প্রেমিকের মত প্রেমকে সাতরাস্তার মোড়ে উলঙ্গ না করে বরঞ্চ তার অস্তিত্বে সৌন্দরর্যর পোশাক পরিয়ে দিয়েছেন। নিজের চারদিকে অদৃশ্য আবরণে নতুন রহস্য সৃষ্টিতে দেখিয়েছেন কৃতিত্ব। ভৌগোলিক সীমারেখা ছাপিয়ে কখনো বোখারা-সমরখন্দ, কখনো সিন্ধুপারে আবার কখনো ইস্তাম্বুল-আংকারায় খুঁজেছেন প্রিয়তমাকে সাবিহা, সুরি প্রভৃতি নামের যুবতীর মাঝে । তিনি মিশরের সৌন্দর্যের রানি নেফারতিতিকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন ‘ নেফারতিতির সঙ্গে’। তাঁর কবিতায় এসেছে ইটালির সুন্দরী যুবতী সোফিয়া, ভারতের সেরা সুন্দরী নায়িকা মধুবালা। আবার স্বদেশের জোয়ানা, সুমনা, সুজাহা, পপি, রুমি, সানজিদা, ম্যারিনা , শাহানা ইত্যাদি নামের নারীও হয়েছে তার প্রেমের কিবতার নারী। তিনি স্বদেশকে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন বিশ্বপ্রেমিক। কোনো কূপম-ূকতা বা অনুদার আঞ্চলিকতা তাকে আটকাতে পারেনি। প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,‘ এই দেশে এইড সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তব-গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’[অভিনন্দনের জবাব] আমিনুল ইসলাম প্রেমভাবনার কবিতার মাঝেও আমরা একজন বিশ্বনাগরিকের দেখা পাই। তুর্কি নারী সুরিকে নিয়ে লেখা তার কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘ভালোবাসা এমনই হয়! এই নিয়ে আাজও বহু বিতর্ক।
থাক্ না বিতর্ক; সে তো বিভেদকামীদের ম-ূকমনের
জলঘোলা করার কুয়ো; ভালোবাসা খোঁজে ঐক্যের আকাশ;
তাই বিতর্কেও ঝড়েও সে বন্ধ করে না আন্তঃভৌগোলিক
ডানা। আমার ডানায় মিশে আছে তোমার ডানার ছন্দ
আর বুকে যে উষ্ণতা- তারও কোনো জাতভূগোল নেই।
যদি কান পাততে-আমার ফুসফুসের স্রোতেলা বাণী
উম্মে কুলসুমের গান হয়ে মাতিয়ে দিতো তোমার রক্ত।’
[ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া, জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার]
আমিনুল ইসলাম শব্দের অভিনব ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু শুধুমাত্র শব্দের খেলাই কবিতার দেহ নয়। কবিতার দেহে থাকে বোধ চিন্তার খোরাক। থাকে প্রাণ। নদী যেখানে সাগরে মিশে তার নাম মোহনা। এখানে ব্যক্তি কবি আর প্রেমিক কবি একাকার। ব্যক্তি কবি নদী হলে প্রেমিক কবির প্রেমসাগর । সাগর-নদী এক হয়ে হয়েছে চাঁদের মোহনা। একের ভেতর বহু। অনেকের কবিতাকে মনে হয় কেবল শব্দের জঞ্জাল, আবার অনেকের কবিতাকে মনে খসখসে,শুকনো খড়। চুলায় দিলেই নিঃশেষ। ভাবনার অবকাশ থাকে না। ডাইমেনশন থাকে না। সোজা মানেই সোজা। অনাবৃত। আমিনুল ইসলামের কবিতায় থাকে ঢাকনা, থাকে খোলস। ঢাকনা খুললেই ভিন্ন কিছু। খোলসের ভেতর কী জানতে হলে খোলস তুলে নিতে হবে। বোধের অরণ্যে যেতে হলে পায়ে পায়ে হাঁটতে হবে।
‘তাদের হতাশ মুখের ছবি আজও আমার
ডিএসএলআর চোখে স্টিল ফটোগ্রাফ হয়ে আছে।
বুয়েট এবং মেডিকেল কলেজের ছেলেমেয়েরা,
যারা আমাকে চিনে,
আজও আমার দিকে মার্কিনী চোখে তাকায়।’
[অবুঝের সমীকরণ, জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র]
কবিরা সাধারণত লিখে থাকে কাজল চোখ, হরিণচোখ কিন্তু কবি লিখলেন মার্কিনীচোখ। এ চোখের রহস্য কী? মার্কিনরা দুনিয়া জুড়ে মাতব্বরি করছে লোভে, আধিপত্য বিস্তারে। ঠিক তেমনি কবির সহপাঠিরা যারা অংকে সমঝদার হয়ে বুয়েটে-মেডিকেলে চান্স পেয়েছে তারা এখনো অংকে কাঁচা কবিকে দখল করতে চায়, প্রয়োজনে যুদ্ধ বাঁধাতে চায়। আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। উপমার এমন আধুনিকতা আধুনিক কবিদের কবিতার আদি-অন্ত কোথাও চোখে পড়েনি। ‘দুঃখের পহরী,’ ‘ভিটেমাটিহারা শোক’, প্রাচ্যের শরীরে’,‘পড়শি ভূগোল,‘ভেড়া জ্ঞান’ নেকড়ে-ভূমি’,‘ ‘নগ্ন সাফল্য’, ‘সংখ্যালঘু বৃক্ষরাজি’,‘মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে’,‘সুদখোর ভবিষৎ’ এধরনের উপমায় থাকাচাই মুন্সিয়ানা । কবির অন্য একটি কবিতায় উপমার ব্যঞ্জনায় মুগ্ধতা আনে। ‘হাঙরশাসিত আটলান্টিক’, সিংহশাসিত আফ্রিকা’, এশিয়ার রজনীগন্ধা’,ক্যারেবীয় সমদ্রগুল্মের গড়ায়’, ফুলকুঁড়ির ঘ্রাণমাখা দ্বিধায়’, কিশোরীর স্বপ্নতাড়িত লজ্জায়’ প্রভৃতি উপমা অভিনব-সুন্দর। আমিনুল ইসলামের প্রতিবাদের-বেদনার কবিতার ভাষা সাংকেতিকতা, পরিহাস, স্যাটায়ার, শ্লেষ প্রভৃতি কাব্যালংকারে সমৃদ্ধ। তিনি বাহ্যত সহজ ভাষায় কথা বলেন কিন্তু সেই আপাত সহজতার আড়ালে থাকে শাণিত বক্তব্য। তার জোছনার মতো সহজতা রচনা করে রাখে কুয়াশামাখা আড়াল।‘আমাকে গ্রহণ করো’ কবিতায় কবি প্রেমিকাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে মানুষ হিসেবে তিনি বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু আসলে সেটি প্রেমের কবিতার আড়ালে যুদ্ধবাজ, মিথ্যাচারী, ক্ষমতালোভী, প্রেমবৈরী মানুষ ও রাষ্ট্রগুলোর মুখোশ উন্মোচন। এখানে ভাষা নয়, প্রেম শব্দটিকেই তিনি আড়াল হিসেবে ব্যবহার করেছেন সূক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার সাথে।
‘আমি মধ্যপ্রচ্যের সিএনএন বা ফক্স নিউজের
রিপোর্টার ছিলাম না কোনোদিন
কোনোদিন চাকরি করিনি কোন দেশের গোয়েন্দা বিভাগে,
আমাকে বিশ্বাস করো।
আমিনুল ইসলামের কবিতায় উপমা এসেছেন ভিন্নভাবে এবং অভিনবত্ব সহকারে। যেমন- ‘বৈশ্বিক ডানার দিনে বেড়াহীন আকাশ মিডিয়া’,সিন্দুকভরা সম্ভাবনা’,‘নিজেরা আর ধানের গোছার মতো যুথব্ধ নয়’ ‘স্বাধীন গেরস্তালী’, ‘নেফারতিতির আলো’, টাইবাঁধা প্রাণ’, ‘মন্ত্রপুত কর্পুর গন্ধ’, ‘নন্দিনী ভাবনা ’, ‘অনুরাগের গন্ধঘন চিন্ময় বাগান’ বৈদগ্ধের রেণুমাখা আধভেজা ঠোঁট’,‘ফ্রয়েডীয় রাস্তার বেণীমাধব মোড়’ ‘প্রেমের সাম্রাজ্যে কুতুবমিনার’ ‘ঢেউ ঢেউ চুম্বন’, ‘ মেরুনরং সময়’, চাঁদের ফাইল’,‘সাগরের সমকামী ঢেউ’,অকূল গাঙের চুল’,চূড়ান্ত প্রেমের পোশাকে আবৃত’, ‘ আম-অধরা মানবী’, ‘জাদুবাস্তবতার তেল’, ‘অভিচারী রঙের জাগলারি’, ‘মাঝটাকের মতো আড়ালিত মরুভূমি’, ‘কৈশোরের ক্লাসমেটের মতো নীলাকাশের নীলিমা’-এমনি অসংখ্য মনকাড়া , মনে নাড়া দেয়া উপমায় ভরপুর তার কবিতা। আর উপমা হচ্ছে কবিতার প্রাণ। কবিতার প্রাণ থেকে পাঠক চুষে নেবে শিল্পরসের নির্যাস। আমিনুল ইসলামের প্রতিটি কবিতাই উপমায় অনন্য এবং ব্যতিক্রম।
আমিনুল ইসলামের অন্যতম শক্তি হচ্ছে মুগ্ধতার ঐশ্বর্য। তিনি শব্দের সাথে শব্দের অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়ে রচনা করেন অনিঃশেষ মুগ্ধতার নান্দনিক বাগান। ‘সুবহে-সাদিক মাখা দিগন্ত ,‘বৃষ্টির ভর্তুকি আর মৌসুমের বরাদ্দ’ ‘বৃষ্টির ড্রেজারে পথ কেটে হয়ে উঠেছে ডাকাতিয়া নদী’ ‘জোয়ার ভাটার অভিজ্ঞ হেডমিস্ট্রেস কীর্তনখোলা’ ‘লায়েক পতিত জমি’ অক্সিজেন মাখা আলো’‘কুয়াশার কামিজ পরা ঘোলাপের বাগান’রোদলা স্টেশন’ ‘ স্বপ্ন-পাহারাদার’ ‘ সিংহ-সম্পাদিত শেওড়া পাড়ার সবুজপাতা দৈনিকের পাতায় ’পাঁচতারা বটগাছ, নিশকুটুম’ ‘সমুদ্রের চুম্বন’, ‘ তিরিশের কোমরে উত্থান-উদাসীন যৌবন’, ‘স্বপ্নের হার্ডডিস্ক’, ‘লে-অফ ঘোষিত কবিতার কারখানা’, ‘প্রকৃতির তামাদি আইন’, ‘ওপেন মার্কেটের ফোরকালার নগ্ননাভি’, ‘আচরণবিধির কাঁটাতার’, ‘সত্যবাদিতার সিলেবাস প্রতিবাদের পরিধি’, ‘ট্যাক্টফুলনেসের টাইয়ের ভারে ন্যুজ প্রশাসন’, ‘টমাহকশাসিত উদ্ভ্রান্ত পৃথিবী’, ‘ফোরকালার আদিমতা’, তিলাঘুঘুর অন্ত্যমিল কবিতা’, ‘অনুবাদযোগ্য নীরবতা’,‘চকলেট-অধরেরর মিষ্টি মালিকিন’ -এ রকম চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শব্দ তুলে এনে জুতসই পেরেক মারতে পারা সাধক কবি হচ্ছেন আমিনুল ইসলাম। তার এক একটি কবিতা যেন এক একটি সময়ের দলিল। এক একটি চিত্রকল্প যেন একটি একটি বাগান। ‘পাঁচ ছয়’ শীর্ষক কবিতায় কবি নিজেই প্রশ্ন করেছেন:‘ আচ্ছা, যুবতী চাঁদের গন্তব্য কী? / অথবা চাঁদের দুধে চোখ দিয়ে উত্তাল যে সমুদ্র,তার?’ তারপর কসমোপলিটন শহর, শুক্লাপক্ষের অধরে কিংবা কৃষ্ণপক্ষের নাভিতে , সকালের শিশির সিক্ত খাড়ি পেরিয়ে কবি পৌঁছে গিয়েছেন সেই এক মিনিটে যেখানে পাটিগণিত চলে না চলে হাওয়ায় উদোম ছয়ের নাভিতে কালো তিল খোঁজার আহ্নিকগতির ট্রেন, যে ট্রেন ধরতে ফেল করলে গন্তব্য ভুল ঠিকানায় হয়! তিনি কথায় যাদুতে সৃষ্টি করতে পারেন অভিনবত্ব এবং অনিঃশেষ মুগ্ধতার ঐশ্বর্য। চেনা জিনিস নতুন রূপ-রস-প্রাণের ঐশ্বর্য নিয়ে উপস্থিত হয়পাঠকের কাছে। আরেকটি উদাহরণ:
‘যারা বিবেচক- যারা সৎ ও সংসারী
তারা কেনে মেপে কাঁচা মরিচের ঝাল
আমি গাঁজাখোর হাটভাঙ্গা হাটুরিয়া
ঘরে ফিরি চুমে বয়েসী চাঁদের গাল।
মাতাল হরফে এঁকে দিয়ে যাই আমি
সাঁঝের উরুতে অবৈধ আলোর উল্কি
মর্নিং শিফ্টের ভিজিটিং প্রফেসর
বলে দেবে এই আলোআঁধারির ভুল কি।
সুখের শরীরে বারোয়ারী এঁটো ঘ্রাণ
আমি চুমে যাই বেদনার গোল নাভি
তুমি দেখাওনি ব্যালান্স সীটের ভাঁজ
আমিও চাইনি ব্যাংক-রিজার্ভের চাবি।’
[এই তো জীবন, শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ]
বর্তমান সময়ে পত্রিকার পাতা খুললেই যার লেখা এবং যার সম্পর্কে লেখা বেশি চোখে পড়ে তিনি কবি আমিনুল ইসলাম। এসময়ে এত মোহময়তাভরা এত প্রাণপ্রাচুর্যময় কবিতা আর কোনো কবি লিখছেন কি না, তা চোখে পড়ে না। এত আলোচনাও চোখে পড়ে না আর কোনো কবির কবিতা নিয়ে। আমিনুল ইসলাম উৎকৃষ্ট মানের কবিতা লিখে চলেছেন বিরামহীন। একদিন ঠিকই তিনি পৌঁছে যাবেন কবিতার জলচিঠি হাতে নিয়ে সার্থকতার নীলস্বপ্নের দুয়ারে।
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা শিল্পী।