ক্যাডার কর্মকর্তার গুরুদণ্ডের শাস্তি হয়ে গেল লঘুদণ্ড; অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার
স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং কথিত স্ত্রীর নামে ব্যাংক হিসাব খুলে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ নৈতিক স্খলনজনিত নারীঘটিত অপরাধ প্রমাণের পরও প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা গুরুদণ্ড থেকে রেহাই পেলেন। ত্রিশতম ব্যাচের অভিযুক্ত সাবেক ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজকে নবীন কর্মকর্তা হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে দেওয়া হয়েছে লঘুদণ্ড। অথচ প্রমাণিত অপরাধের জন্য কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত কিংবা যথোপযুক্ত গুরুদণ্ড প্রদান করা হবে না মর্মে ২য় শোকজ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা সাফ বলছেন, এ ধরনের অপরাধে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মতামত ছাড়া লঘুদণ্ড প্রদানের সুযোগ নেই।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগ প্রমাণের দায়ে আগামী ৩ বছরের জন্য ‘বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ’ করা হয়, যা লঘুদণ্ড। সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমের শেষ কর্মদিবস ছিল পরদিন পহেলা নভেম্বর। চাকরির মেয়াদ শেষে ২ নভেম্বর থেকে তাকে অবসর প্রদান করা হয়। এরপর ১ নভেম্বর পৃথক প্রজ্ঞাপনে তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) সদস্য হিসাবে ৫ বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পান।
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযুক্ত কর্মকর্তার ২য় কারণ দর্শানোর জবাব, নথি পর্যালোচনা ও সব বিষয় বিবেচনান্তে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও নবীন কর্মকর্তা বিধায় তাকে গুরুদণ্ডের পরিবর্তে লঘুদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ডিসি অফিসে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কর্মরত থাকাবস্থায় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সিনিয়র সহকারী সচিব আসিফ ইমতিয়াজের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর পরিচয় হয়। প্রথমে ফোনে কথা হয় আসিফ ইমতিয়াজের এক বান্ধবীর মাধ্যমে। এরপর ওই বছর পহেলা বৈশাখ তারা ঢাকায় এসে একটি শপিং কমপ্লেক্সে দেখা করেন। পরের মাসে রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে রেজিস্ট্রি কাবিন ছাড়া বিয়ে হয়। ঘরে থাকা প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় তিনি এভাবে গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ঢাকায় সাবলেট বাসা ভাড়া নিয়ে সরকারি এ কর্মকর্তা প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর বিয়ের সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। এর মধ্যে অভিযুক্ত কর্মকর্তা ইউএনও হিসাবে সুনামগঞ্জের তাহেরপুর উপজেলায় পোস্টিং পান।
এদিকে কোনো সুরাহা না হওয়ায় ভুক্তভোগী নারী এ বিষয়ে প্রতিকার দাবি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব বরাবর আবেদন করেন। এরপর প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়। প্রায় দুই বছর ধরে চলা বিভাগীয় মামলাটি অনেকগুলো শুনানি শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়।
বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে ওএসডি থাকা অভিযুক্ত সাবেক ইউএনওর বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, যা শাস্তির প্রজ্ঞাপনে বলা আছে। একটি হলো-স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সাবলেট বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে নিয়মিত যাতায়াত এবং শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগী নারীর নামে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খুলে অর্থ লেনদেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছ থেকে অন্য কাজের নাম করে তার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে তিনি গোপনে চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকায় ব্যাংক হিসাব খোলেন। যা অভিযোগকারী ভুক্তভোগী নারী জানতেন না। পরিচিত একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তায় এভাবে ব্যাংক হিসাব খুলে আসিফ ইমতিয়াজ এটিএম কার্ডের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন করেন। বিভাগীয় মামলার তদন্তে এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি কর্মচারী আইন ও বিধির বিষয়ে বিশেষ পাণ্ডিত্বের অধিকারী সাবেক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শাস্তি প্রদান সংক্রান্ত এ প্রজ্ঞাপনটিতে বর্ণিত তথ্য এবং দণ্ড অনেকটা স্ববিরোধী। বড় ধরনের তিনটি ব্যত্যয় তো একেবারে সুস্পষ্ট।
প্রথমত, নৈতিক স্খলনজনিত নারীঘটিত অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর কোনো কর্মকর্তাকে চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত, অভিযুক্ত সাবেক এই ইউএনও-কে নবীন কর্মকর্তা বিবেচনায় লঘুদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি তো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। একজন ইউএনও বা সিনিয়র সহকারী সচিব কখনো নবীন কর্মকর্তার সংজ্ঞায় পড়ে না।
তৃতীয়ত, ‘এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে যখন কাউকে দ্বিতীয় শোকজ দেওয়া হয়, তখন শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিষয়টি সচিব পর্যায়ে নিষ্পত্তি হতে পারে না। অবশ্যই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে প্রথমে পিএসসি (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) এবং সবশেষে রাষ্ট্রপতির সদয় সিদ্ধান্তের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো উচিত।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধিশাখায় দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ প্রশ্ন তুললে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিব্রত হতে হবে। সঙ্গতকারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত হবে পুনঃপর্যালোচনা করা। কেননা এ ধরনের কর্মকর্তারা চাকরিতে বহাল থাকলে প্রশাসনের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধিশাখায় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন আরও একজন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বলেন, ‘সরকার এ ধরনের নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডিত কর্মকর্তাকে দিয়ে জনগণের কী সেবা দিতে চায়। সেটিই বড় প্রশ্ন। সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য খবুই দুর্ভাগ্য হবে, যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া এসব কর্মকর্তা এভাবে পার পেয়ে যায়।’