কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ায় কমছে ওএসডি, জনপ্রশাসনে ১০০ জনকে চুক্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতিধবঞ্চিতদের অসন্তোষ
বিশেষ প্রতিবেদকঃ প্রশাসনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওএসডি) সংখ্যা কমছে। এর কারণ হলো অনেকেই ওএসডি থাকা অবস্থায় অবসরে গেছেন। তাই তাদের আর পদায়ন হয়নি। বর্তমানে প্রশাসনে সহকারী সচিব থেকে সচিব ও সিনিয়র সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে কর্মরত পাঁচ হাজার ৯৬৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওএসডি) সংখ্যা ১৫০ জন।
এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে ৯ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৫৮ জন, উপ-সচিব পদে ২৫ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৩০ জন ও সহকারী সচিব পদে রয়েছেন ২৫ জন। এর বাইরে লিয়েন ও স্টাডির জন্য ওএসডি রয়েছেন আরও ১৮৫ জন।
তবে ১৬ মাস আগে গত বছরের মে মাসে প্রশাসনে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ৭৩৩ জন। এসব কর্মকর্তার মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে ওএসডি ছিলেন চারজন, যুগ্ম সচিব পদে ১৪৯ জন, উপ-সচিব পদে ৩৩৯ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ১২৪ জন ও সহকারী সচিব পদে ১২৭ জন। সেই তুলনায় প্রশাসনে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক কমেছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, রাজনৈতিক কারণে ওএসডি অধিকাংশ কর্মকর্তা অবসরে চলে গেছেন।
অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ১০ জনসহ প্রায় ১০০ কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। পদোন্নতি-বঞ্চিত করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘটনায় প্রশাসনে অসন্তোষ রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কোনো কাজ না করেও ওএসডি থাকা ১৫০ কর্মকর্তার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মাসে সরকারের খরচ প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা। তবে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা প্রতিদিনই কমে অথবা বাড়ে। কারণ শুধু যে শাস্তি হিসেবে ওএসডি করা হয় এমনটা নয়। চাকরির পদোন্নতির পর নতুন পদায়নের আগে অথবা এলপিআরে যাওয়ার আগেও ওএসডি করা হয়। তাই এ হিসাবের কিছুটা হেরফের হতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওএসডি কর্মকর্তারা বেতন, ভাতা, গাড়িসহ সব ধরনের সরকারি সুবিধাই পেয়ে থাকেন। শুধু কোনো দায়িত্বে থাকেন না। তাই তাদের অফিসের নির্দিষ্ট সময়ে সচিবালয়ে এসে হাজিরা দিতে হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে রাখা হাজিরা খাতায়। বলা যায়, লাইব্রেরিই তাদের অফিস কক্ষ।
একাধিক ওএসডি কর্মকর্তার দাবি, প্রশাসনে কিছু সময়ের জন্য ওএসডি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও সরকারের আস্থাভাজন হতে না পারাই ওএসডি হওয়ার প্রধান কারণ। প্রশাসনে দীর্ঘ সময় ধরে ওএসডি থাকায় তাদের জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করে। পদ থাকার পরও কোনো দায়িত্ব না থাকায় তারা বিষয়টিকে শাস্তি হিসেবে মনে করেন। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ কত দিন ওএসডি রাখা যাবে, তারও কোনো বিধান না থাকায় বছরের পর বছর এ দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে অনেককে।
ওএসডি হওয়া একজন যুগ্ম সচিব জানান, ঢালাওভাবে পদোন্নতির কারণে একটি পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বাড়ছে। এতে পদোন্নতি পাওয়াদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়লেও নতুন পদ অনুযায়ী তাদের কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। এতে ওএসডির সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে কাজ না করিয়ে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতিও বাড়ছে। তবে আগের তুলনায় ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, সরকারের সিনিয়র সচিব ও সচিব হিসেবে বর্তমানে কর্মরত মোট ৭৫ জন। এ ছাড়া সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১ কর্মকর্তা রয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে কেউ ওএসডি নেই। সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব-এ পদগুলোতে মোট কর্মরত পাঁচ হাজার ৯৬৯ জন। এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে ৪২৭ জন, যুগ্ম সচিব ৭১৬ জন, উপ-সচিব ১৬৩৩ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব ১৮৮৭ জন ও সহকারী সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন ১২১৪ জন কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমে জানান, ‘ওএসডি হওয়ার সঙ্গে সরকারি দলের আস্থাভাজন হতে পারা-না-পারা সম্পর্কিত নয়। প্রশাসনে ওএসডি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ওএসডি শুধু শাস্তির জন্য করা হয়, তা নয়। এলপিআর ও পদোন্নতিসহ নানা কারণে হয়ে থাকে। তারপরও সরকার সব সময়ই সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় পদায়নের চেষ্টা করে। এ ছাড়া কিছু কর্মকর্তাকে নানা কারণে রিজার্ভও রাখতে হয়। এটা সব সরকার আমলেই হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার দ্বিতীয় বছর পর্যন্ত ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২৫০ জন। আর বিএনপি সরকার আমলে ২০০৫ সালে ওএসডি করা হয়েছিল ৩৭২ জনকে। ওই সরকারের শেষ সময়ে অর্থাৎ ২০০৬ সালের অক্টোবরে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। তবে সবচেয়ে কম ওএসডি ছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মাত্র ৫৮ জন।
এদিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় ৯২টি পদে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব সম্পদ বড়ুয়া, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস। সব মিলিয়ে বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও দূতাবাসে প্রায় ১০০ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে চাকরি করছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কেউ কেউ চার বছর ধরে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকের আবার এক বা একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার পরও বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঘটনায় অসন্তোষ তৈরি হয়েছে পদোন্নতি-প্রত্যাশী কর্মকর্তাদের মধ্যে।
একাধিক কর্মকর্তার দাবি, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়াই ঢালাও পদোন্নতির ঘটনা বারবার ঘটছে। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদ ১১১টি হলেও অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২৭ জনে। এতে পদোন্নতি পেয়েও অধিকাংশ কর্মকর্তা আগের পদেই চাকরি করছেন।
এ পরিস্থিতির মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। পদ ছাড়া ঢালাও পদোন্নতির কারণে জনপ্রশাসনে যেখানে নিয়মিত কর্মকর্তারা পদ পাচ্ছেন না সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে সংকট আরও বাড়ছে। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
একই সঙ্গে নিয়মিত কর্মকর্তা থাকার পরও চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ায় বছরে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, সবার আশা থাকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিব হওয়া। কিন্তু সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়তে থাকায় অনেকেরই সচিব পদে পদোন্নতি স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি।
আরেকজন অতিরিক্ত সচিব জানান, বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে থাকলেও এখন সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে।তিনি জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়মিত চাকরি শেষ করে অবসরে যাবেন দুই সিনিয়র সচিবসহ ১০ সচিব। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ আরও তিন সচিবের। ফলে প্রশাসনের শীর্ষপদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিবসহ ১৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিবের পদ খালি হচ্ছে। তবে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য তৎপরতা শুরু করেছেন।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান গণমাধ্যমে বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে প্রশাসনে নানা সমস্যা তৈরি হয়। যারা পদোন্নতি-প্রত্যাশী তারা পদোন্নতি-বঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ হন, ব্যথিত হন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলের কমিশনের সুপারিশ ছিল শুধু কারিগরি পদে যাকে ছাড়া একেবারে চলবে না-এমন কর্মকর্তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হলে তা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহা নষ্ট করে দেয়, হতাশা সৃষ্টি করে। তাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করে যাদের পদোন্নতি দেওয়ার যোগ্য, তাদের পদোন্নতি দেওয়া উচিত।’
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, ‘দেশের চলমান উন্নয়ন ধরে রাখতে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট কাজে বিশেষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরই ওই পদে মেয়াদ বাড়ানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষায়িত পদে এবং যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল সংকট রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় উপযুক্ত সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং জনসাধারণের মধ্য থেকে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জনস্বার্থে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।’