বিদেশি পন্য আমদানিতে পাচার ৩৫০০ কোটি টাকা; শহীদুলের পেটেই ১৪শ কোটি

বিদেশি পন্য আমদানিতে পাচার ৩৫০০ কোটি টাকা;
শহীদুলের পেটেই ১৪শ কোটি

অপরাধ প্রতিবেদকঃ বৈশ্বিক মন্দাভাবের কারণে আর্থিক সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। এ অবস্থার মধ্যেও পণ্য আমদানিসহ নানা উপায়ে বিদেশে অর্থপাচারে জড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। গুরুতর এসব অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংসহ একাধিক আইনে মামলা হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু থেমে নেই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ টাকা-পাচার কার্যক্রম।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ছাড়াও প্রতারণা ও ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ ধারায় দেশের ২৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে ৯৫টি মামলা করেছে সরকারের একাধিক সংস্থা।

শিল্পের যন্ত্রপাতি, মালামাল ও কাঁচামাল আমদানিসহ বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে দেশ থেকে এসব টাকা পাচার হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দায়ের করা এসব মামলার মধ্যে তদন্ত শেষ হয়েছে ১৭টির। যার মধ্যে ১৪টি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে আদালতে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে দুটি মামলায়; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমতিক্রমে আদালতে চার্জশিট অথবা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের কার্যক্রম চলমান রয়েছে একটি মামলার। বর্তমানে তদন্ত চলছে ৫৬টির। চলমান মানিলন্ডারিং অভিযোগের অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে ২২টি। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

জানা গেছে, শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপ হচ্ছে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা। আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশ খরচ হয় মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আনতে।

উদ্যোক্তারা যাতে শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত হন, সে জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ন্যূনতম শুল্কহার আরোপ করেছে সরকার।

বর্তমানে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কহার গড়ে ১ শতাংশ।

কম বা শূন্য শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানিতে আন্ডার এবং ওভার ইনভয়েসিং বেশি হয়। ফলে পণ্য আমদানির ছদ্মাবরণেই অর্থপাচার হচ্ছে। এ ছাড়া এসব পণ্যের বিপরীতে বেশি অর্থেও এলসি খোলা যায়। মূলত এসব কারণেই পাচারকারীরা এ পথ বেছে নিচ্ছে। ফলে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামেই টাকা পাচার বেশি হচ্ছে। স্বনামধন্য কিছু ব্যাংকের কিছু শাখায় শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমদানি করা শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কিছু কনটেইনারে যন্ত্রপাতি মিলছে না; পাওয়া যাচ্ছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। কারণ বাস্তবে কোনো যন্ত্রপাতিই আসেনি। অনেক এলসি রয়েছে অনিষ্পন্ন। টাকা পাচারের এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশি-বিদেশি চক্র।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে বেশ কিছু মামলার তদন্ত চলছে। শিল্পের যন্ত্রপাতি, মালামাল ও কাঁচামাল আমদানির আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগে মামলাগুলো দায়ের হয়। এসব মামলায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থার সঙ্গে কিছু মামলার যৌথ তদন্ত কার্যক্রম চলছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশ অনুমোদন ক্রমে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধানের আওতায় রয়েছে ৪১ মামলা। এর মধ্যে চলমান মানিলন্ডারিং অনুসন্ধানের সংখ্যা হলো ২২টি। যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে, সেগুলো হলো, মেসার্স আসাদী স্টিল এন্টারপ্রাইজ, নীরব ট্রেডিং, এমএস শিপিং লাইন, এইচওপি ওয়াইআইচি, ফুজিয়ান এক্সপোর্ট ইন্ড্রা., ফু-ওয়াং বোলিং অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড, গ্লোবাল আউটার ওয়্যার লিমিটেড, এলএসআই ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মেসার্স মুনাভি টেক্সটাইল কমপ্লেক্স লিমিটেড, বেজ ফ্যাশন লিমিটেড, ভিশন ২১ ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, মেসার্স বিএইচকে টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মেসার্স হাসি টাইগার কোম্পানি লিমিটেড, হেলিকন লিমিটেড, মাহিন ডিজাইন বিডি, এইপিজে নারায়ণগঞ্জ, ক্রয়ডন-কাউলুন ডিজাইনস লিমিটেড এবং ট্যাং ফ্যাশন লিমিটেড।

মামলার তদন্ত অনুসন্ধান শেষে মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের হয়েছে ছয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে (সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, এসবি এক্সিম বাংলাদেশ, সাদিয়া সেন্টার, মাল্টিমোড, এমটি এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস ও এসআর ট্রেডিং)।

এ ছাড়া আরও তিনজনের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানে নেমেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে জনৈক চিত্ত রঞ্জন বড়ালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

অনুসন্ধান শেষে এনবিআরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে (এমারজান অ্যাপারেলস লিমিটেড, মেসার্স জায়েন্ট গার্মেন্টস ইন্ডা. (প্রা.) লিমিটেড, লিডস করপোরেশন লিমিটেড এবং চীনা নাগরিক জহি ফাঞ্জি ও লিউ রংজহেঙ)।

অনুসন্ধান শেষে পদ্মা এগ্রো ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে; যেটির যৌথ অনুসন্ধান/তদন্ত পরিচালনা করার জন্য বিএফআইইউয়ের সঙ্গে সমন্বয় কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। যৌথ অনুসন্ধান/তদন্ত বিষয়ে বিএফআইইউ কর্তৃক যৌথ অনুসন্ধান/তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান ও এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে (এঅ্যান্ডবি আউটার ওয়্যার লিমিটেড, আইরিশ পাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড এবং জনৈক মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম)। একই অভিযোগে মামলা দায়ের হওয়ায় চিত্ত রঞ্জন বড়ালের বিদেশি তথ্যের বিষয়ে অনুসন্ধান নথিভুক্ত করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে মটোমেট্রিক্স কোম্পানি লিমিটেড-এর মামলা। অর্থাৎ মোট মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান চলমান রয়েছে ৩২টি অভিযোগের।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক ৯৫টি মামলায় পাচার করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬৭৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড জালিয়াতিতে মোট মামলা হয়েছে ২১টি। এসব মামলায় পাচার হয়েছে ২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা; মামলাগুলো সম্প্রতি সিআইডি কর্তৃক দুদকে পাঠানো হয়েছে।

মোট ৭৪টি মামলায় ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাচারের তদন্ত চলছে; দুদক, সিআইডি এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক যৌথ তদন্ত কার্যক্রম চলছে ২টি মামলার।

এসব মামলায় ১২৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি, অর্থপাচার সংক্রান্ত একটি (এগ্রো বিডি) ও টেরাকোটা টায়েলস রপ্তানিতে অর্থপাচার সংক্রান্ত ১টি (এসবি এক্সিম) প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়; যৌথ তদন্ত শেষে নাসির গ্রুপের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগে দায়ের করা মামলার বিষয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও সিআইডি।

তদন্ত শেষে আদালতে ১৪টি মামলায় চার্জশিট এবং দুটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে বেনাপোল বন্দরে বৈদেশিক মুদ্রা আটক সংক্রান্ত ১টি, মিশওয়্যারী গার্মেন্টস, আশিয়ানা, কেপরি অ্যাপারেলস লিমিটেড, টিএএম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও কেপ্রি গার্মেন্টস লিমিটেড ৫টি (বন্ড সংক্রান্ত), আপন জুয়েলার্সের ৫টি মামলা, বিমানবন্দরে অবৈধভাবে স্বর্ণের চোরাচালান ১টি, এসএ ওয়ার্ল্ড মিরপুর, এসএ ওয়ার্ল্ড লালমাটিয়া ২টি (আটক সংক্রান্ত) মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়।

এ ছাড়া অডি আরও ৮ গাড়ি ১টি ও মেসার্স যারা এক্সেসরিজ ইন্ডা, লিমিে ডের বিরুদ্ধে দায়ের করা এক মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আদালতে।

অ্যাপারেল অপশন ও নীনাদ ট্রেডের বিরুদ্ধে ৯৩ লাখ টাকা পাচারের দুই মামলার চার্জশিট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

রিচ অ্যান্ড রিলাক্স, আয়মান টেক্সটাইল, সাদ ফ্যাশন, নাব ফ্যাশন ও ডেকো ফুডস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা পাচারের ৫টি মামলার তদন্ত শেষে এনবিআরের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। ডংজিং ও পুষ্পিতার বিরুদ্ধে ৯৯ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে দুটি মামলা ফের তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। ৬০ লাখ টাকা প্রতারণা সংক্রান্ত একটি মামলা এনবিআরের অনুমতিক্রমে সিআইডিতে পাঠান হয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দারা জানান, ভুয়া নাম, ঠিকানা ও দলিলের মাধ্যমে চারটি প্রতিষ্ঠান খুলে যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিয়ে উচ্চ শুল্কের মদ, সিগারেট, এলইডি টিভি, গুঁড়া দুধ, ফটোকপি মেশিন ইত্যাদি পণ্য এনে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচারের মূল হোতা শহীদুল আলম।

২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে শহীদুল ও তার সহযোগীরা মেসার্স অ্যাগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি, হেনান আনহুই অ্যাগ্রো এলসি, হেব্রা ব্র্যাঙ্কো এবং চায়না বিডিএল নামে চারটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খুলে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনেন।

প্রতিষ্ঠান চারটি ২৯টি চালানে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ১ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা পাচার করেছে। এর মধ্যে হেনান আনহুই অ্যাগ্রো ৪৩৯ কোটি টাকা, মেসার্স অ্যাগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি ৪৩২ কোটি টাকা, হেব্রা ব্র্যাঙ্কো ২৯১ কোটি টাকা এবং চায়না বিডিএল ২৩৪ কোটি টাকা পাচার করেছে। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৯ সালে পল্টন থানায় এ পাচারের বিষয়ে মামলা হয়। প্রায় দুই বছর চেষ্টার পর গত ১৩ আগস্ট ইতালি যাওয়ার পথে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জালে ধরা পড়েন চক্রের হোতা শহীদুল আলম।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য এনেছে এবং টাকা পাচার করেছে। প্রায় দুই বছর চেষ্টার পর এ চক্রের মূল হোতা শহীদুল আলমকে আটক করা গেছে। অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top