রাজউকের পূর্বাচলে প্লট বিক্রির নামে প্রতারণার টাকায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১০তলা ভবন গড়ে তুলছেন মোবারক হোসেন ও মুক্তা আক্তার দম্পতি। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিটিটিসির তদন্তে উঠে এসেছে,এমন ভয়াবহ দুর্নীতি’র খবর।
অপরাধ প্রতিবেদকঃ ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ইছাপুরে একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিস্ময় আর ঘোর যেন কাটছেই না কিছুতেই। কারণ, এর আগে ইছাপুরে ১০ তলা ভবন কেউ নির্মাণ করেননি। যা স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়েছে।
১৭ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণাধীন ভবনটির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা মোবারক হোসেনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার। ছয় বছর আগেও বালুর ব্যবসার আয়ে সংসার চলত মোবারকের।
মুক্তার কোনো আয় ছিল না। এত অল্প সময়ের মধ্যে দুই কোটি টাকায় জমি কিনে ভবন নির্মাণ, দুই কোটি টাকা দামের দুটি গাড়ি এবং দুটি বালুবাহী নৌযানের (বাল্কহেড) মালিক হয়েছেন এই দম্পতি। বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে পূর্বাচলের একটি প্লটে তাঁরা শুরু করেন রেস্তোরাঁ ব্যবসা। মোবারক–মুক্তা দম্পতির এই উত্থানের হিসাব মেলাতে পারছিলেন না স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, প্লট জালিয়াতি–সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে জানা গেছে, মোবারক ও মুক্তা দম্পতির আরও সম্পদ রয়েছে। তাঁরা এগুলোর মালিক হয়েছেন মাত্র ছয় বছরে। ভুয়া মালিক সাজিয়ে প্লট বিক্রির নামে প্রতারণা করতেন। এভাবে তাঁরা পূর্বাচলে ৯টি প্লট বিক্রির নামে তাঁরা ৮৪ কোটি টাকা নিয়েছেন। এসব কাজে তাঁদের সহযোগিতা করেছেন মো. ওবায়দুল্লাহ নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক অফিস সহকারী। জমিসংক্রান্ত সব নথি তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন মোবারক। বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য রাজউকের কর্মকর্তা পরিচয়ে তাঁকে বিভিন্ন সময় ক্রেতাদের কাছে নিয়ে যেতেন তিনি।
কর্মকর্তারা জানান, মোবারক ও মুক্তা দুবাইয়ে স্থায়ী আবাস গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ জন্য তারা ঘন ঘন দুবাইয়ে যেতেন এবং কয়েক মাস পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতেন। তবে দুবাইয়ে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করার আগেই তাঁদের জালিয়াতি ধরা পড়ে। ইতিমধ্যে মোবারকের স্ত্রী মুক্তা আক্তার এবং তাঁদের গাড়িচালক তুষারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যেভাবে প্রতারণা
মোবারক–মুক্তা দম্পতি প্লট বিক্রির নামে যাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ইয়ুথ গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তাঁর স্বজনেরা রয়েছেন।
এই গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আকবর হায়দার তাঁদের মালিকানার প্লট বিক্রি করে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গত ২৭ জুলাই ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা করেন। তাতে মোবারক, তাঁর স্ত্রী মুক্তা আক্তার, শ্বশুর নজরুল ইসলাম ও গাড়িচালক তুষারকে আসামি করা হয়।
এই মামলায় গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার ভাটারা থেকে মুক্তা ও তুষারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ইয়ুথ গ্রুপ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নামে জমি কেনায় মধ্যস্থতা করেছিলেন মোবারক। ধীরে ধীরে পরিবারটির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং তিনি তাঁদের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সালে পূর্বাচলে আরও কয়েকটি প্লট বিক্রি হবে জানালে সেগুলো কেনার আগ্রহ দেখান আকবর হায়দার। কয়েক জনকে বিভিন্ন প্লটের মালিক সাজিয়ে কাফরুলে ইয়ুথ গ্রুপের অফিসে নিয়ে যান মোবারক। আকবর হায়দার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় প্লট দেখা এবং রাজউক থেকে নথি সংগ্রহ করে মালিকানা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেন মোবারককে। তিনি সব ঠিক আছে জানালে দাম ঠিক করে সেগুলো কেনার ব্যবস্থা করা হয়।
ভুয়া মালিক সাজিয়ে রাজধানীর পূর্বাচলে প্লট বিক্রি করে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মোবারক হোসেন ও মুক্তা আক্তার নামের এই দম্পতি। মুক্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর মোবারক ভারতে পালিয়ে গেছেন।
মোবারকের ওপর আস্থা রেখে ইয়ুথ গ্রুপের অফিসেই জমি রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করা হয়। কমিশন দিয়ে রূপগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে কর্মকর্তাদের নিয়ে এসেছেন বলে জানান মোবারক। তাঁরা জমিদাতাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি সংগ্রহ, টিপ সই ও স্বাক্ষর নিয়ে নিবন্ধনের সব কাজ শেষ করেন। পরে সেই জমির নামজারির দায়িত্বও নেন মোবারক। জমির নিবন্ধন ও নামজারির সব নথিপত্রও সরবরাহ করেন তিনি।
ছয় বছর পরে ওই জমিতে গিয়ে জানা যায়, আকবর হায়দাররা যেসব জমি কিনেছেন, সেগুলোর প্রকৃত মালিক জমি বিক্রি করেননি। রাজউক ও ভূমি অফিসেও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁদের কেনা জমির নামজারি হয়নি। তাঁরা যাঁদের কাছ থেকে জমি কিনেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন সাজানো মালিক। তাঁদের এনআইডি ও ছবি সবই ছিল ভুয়া। জমি কেনার যেসব নথি মোবারক সরবরাহ করেছিলেন, সেগুলো তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেন, পূর্বাচলের বিভিন্ন প্লটের বরাদ্দপত্র, অফিস আদেশ, মালিকানা সনদ, বিক্রির অনুমতিপত্রসহ সব নথি নিজেই তৈরি করতেন মোবারক ও তাঁর সহযোগীরা। নথিগুলো দেখে কেউ বুঝতেই পারবেন না, সেগুলো নকল। মোবারকের ফাঁদে পা দিয়ে জমির ক্রেতারা রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ না নিয়ে বিপুল অর্থ খুইয়েছেন।
সরেজমিনে যা জানা গেল
সম্প্রতি ইছাপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ইছাপুর মধ্যবাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন বালু নদীর পাড়ে ১৭ শতাংশ জমিতে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবন মালিক মুক্তা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে, আর তাঁর স্বামী মোবারক ভারতে পালিয়ে গেলেও ভবন নির্মাণকাজ থেমে নেই। নির্মাণাধীন ১০তলা ভবনটির ৮তলার অবকাঠামো উঠে গেছে। কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিককে সেখানে কাজ করতেও দেখা যায়। বিল্লাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি ভবন নির্মাণের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন।
মোবারকের এক প্রতিবেশী বলেন, হঠাৎ করে মোবারক এত সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে এলাকায় আলোচনা ছিল। কেউ বুঝতে পারছিলেন না এই অল্প সময়ে কীভাবে তিনি এত অর্থ–বিত্তের মালিক হলেন।
রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ইছাপুর এলাকায় মোবারকই প্রথম ১০তলা ভবন নির্মাণ করছেন। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করছিলেন তিনি। এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানেও অর্থ সহায়তা দিতেন মোবারক।
স্থানীয় পুলিশ জানায়, মোবারক রেস্তোরাঁ ব্যবসার আড়ালে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। হোয়াইট হাউস নামের ওই রেস্তোরাঁয় গত বছরের ১৮ জুন ভোরে অভিযান চালিয়ে মাদক, জুয়া ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযানে দেশি-বিদেশি মদ, বিয়ার, জুয়া খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তখন সেটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
রাজউক কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা
রাজউকের অফিস সহকারী মো. ওবায়দুল্লাহ প্লট বিক্রির নামে প্রতারণায় সহযোগিতা করেছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রাজউকের অফিস সহকারী মো. ওবায়দুল্লাহ প্লট বিক্রির নামে প্রতারণায় সহযোগিতা করেছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরেজমিনে ইছাপুর এলাকায় জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতাকারী তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, ওবায়দুল্লাহ রাজউকের অফিস সহকারী। ইছাপুর এলাকায় যাঁরা জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা করেন, তাঁদের সবার সঙ্গেই ওবায়দুল্লাহর সখ্য আছে। তাঁরা তাঁকে ‘ওবায়দুল কাকা’ সম্বোধন করেন। পূর্বাচলের কোনো প্লটের নথির প্রয়োজন হলে প্রায় সবাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্লট কেনাবেচায় মধ্যস্থতার পাশাপাশি নিজেও এই ব্যবসা করেন ওবায়দুল্লাহ।
ওবায়দুল্লাহর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ইয়ুথ গ্রুপের উপপরিচালক জয় মিত্র বলেন, প্লট কেনাবেচার সময় কয়েকবার ওবায়দুল্লাহকে ইয়ুথ গ্রুপের অফিসে নিয়ে এসেছিলেন মোবারক। তখন তাঁকে রাজউকের কর্মকর্তা বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বিভিন্ন নথি দেখে ঠিক আছে বলে জানিয়েছিলেন।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, মোবারক পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলে নথিপত্র কীভাবে জাল করেছেন, কাদের ভুয়া মালিক সাজিয়েছেন, সব কিছু জানা যাবে।