মাঠ পর্যায়ে ইউএনওরা বেপরোয়া – প্রায়ই ঘটছে অসৌজন্য মূলক আচরণের ঘটনা
বিশেষ প্রতিবেদকঃ ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার সামনে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি ভেঙে ফেলেছেন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের এ ঘটনার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ইউএনওকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।
আরও সংবাদ পড়ুন।
এর ঠিক এক দিন আগে বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতার দাপটে বেপরোয়া ইউএনওদের অসৌজন্যমূলক আচরণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করা এবং মাস্তানদের মতো আচরণের অভিযোগও রয়েছে কোনো কোনো ইউএনওর বিরুদ্ধে। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সেটা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে।’
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আবাসিক যুব স্বাধীন সমাজ ক্লাব। শুক্রবার ছিল ফাইনাল খেলা। এতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণের আগে তিনি দুই দলের বিতর্ককে কেন্দ্র করে ট্রফি দুটি আছড়ে ভেঙে ফেলেন।
আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ইউএনও মেহরুবা ইসলাম আলীকদমের জনগণকে অসম্মান করেছেন।’ তাকে আলীকদম থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ঘটনাটি দুঃখজনক। কোনো কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ করার কথা নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার বগুড়া সদরের ইউএনও সমর পালের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেনকে লাঠি দিয়ে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। আলমগীর জানান, ‘ইউএনও তাকে ডেকে নিয়ে তার কক্ষে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন। এ সময় তাকে দু’জন আনসার সদস্য ধরে রেখেছিলেন। তার বাম হাত ভেঙে গেছে।’
এর আগে গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে উপহারের ঘর নির্মাণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু। কথা বলার প্রথম থেকেই ইউএনও সাংবাদিককে গালিগালাজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি ওই সাংবাদিককে ‘বেজন্মাও’ বলেন।
এ ঘটনার একটি অডিও প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ঘটনার তিন দিন পর ওই ইউএনওকে ওএসডি করা হয়। সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনওর ভাষা ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি নোটিস জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য ফরিদপুরের বোয়ালমারীর ইউএনওকে হাইকোর্টে তলব করা হয়।
গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করারও অভিযোগ ওঠে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানজনক ভাবে নাম ধরে ডাকা, সরকারি ত্রাণের কম্বল দেওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ সহ ইউএনওর বিভিন্ন অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে লালমনিরহাটের আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দুইজনকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরিতে আপত্তি জানালে ইউএনও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার’ কথা জানানোর পাশাপাশি জমি খাস করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন বলে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে।
ওই বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে সরকারি হটলাইন ৩৩৩-এ কল করে ত্রাণ চাওয়ার পরে জরিমানার মুখে পড়েছিলেন একজন সাহায্যপ্রার্থী। দরিদ্র না হয়েও ত্রাণ চেয়েছেন এমন অভিযোগে ১০০ জন দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে হয় তাকে। এ নির্দেশ দিয়েছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা আছে। তবে শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই। অবশ্য নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়। যেখানে অসদাচরণ বলতে অসঙ্গত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে।
এ আচরণবিধি এবং চাকরিবিধি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিয়েই কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়ে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, ইউএনওদের আচরণ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, তারা যেসব জেলায় যাবেন, সেখানকার সব কর্মকর্তার সঙ্গে বসে তাদের আচার-ব্যবহার কেমন হবে সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এমন নির্দেশনার পরও সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার অকর্মকর্তাসুলভ আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ বছরে প্রশাসনের প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জমা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত পাঁচশর মতো বিভাগীয় মামলা দায়ের হলেও এগুলোতে একশর মতো কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড ও লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির একেবারেই কম।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। কিন্তু দুঃখজনক হলো, দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে তাতে ইউএনও, ডিসিসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। তাই তাদের স্যার না বললে তারা মন খারাপ করে খারাপ আচরণও করেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটার অবসান হওয়া দরকার। তারা যেন জনগণের সেবকের ভূমিকা পালন করেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কারও সঙ্গে অসদাচরণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘কোনো কর্মকর্তা আচরণবিধি ভঙ্গ করলে বা কারও সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগী মামলা করা যাবে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায় বলা আছে, তাকে কর্মকর্তাসুলভ ভদ্র আচরণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা, সবার কাছ থেকে একই ধরনের আচরণ আশাও করা যাবে না। তবে আচরণবিধি যাতে সবাই মেনে চলেন এ জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বাড়াতে হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী বিধিমালায় বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি নির্ধারিত আছে। সেখানে অসদাচরণকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। কেউ অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অন্য কোনো অপরাধ করলে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারিত হবে। কোনো অভিযোগ এলে তাকে নোটিস, তদন্ত, বিভাগীয় মামলা সব নিয়ম আছে। কেউ শাস্তি পেলে এর বিরুদ্ধে আপিলও করা যায়।’
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সেটা দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত হবে। কর্মকর্তারা যাতে আচরণবিধিমালা মেনে দায়িত্ব পালন করেন সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। দুর্ব্যবহারও এক ধরনের দুর্নীতি। আইনের মধ্যে থেকে সাধ্যমতো সেবা দিতে হবে। কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে, তার আচরণ সরকারের আচরণ।’ তিনি বলেন, ‘সারা দেশে ৪৯২টি উপজেলায় ইউএনওরা কর্মরত। তাদের সবাই খারাপ নন। হাতে গোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তারপরও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ কাম্য নয়।’