কর্তব্যে অবহেলায় সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে অর্থ – হাইকোর্ট

Picsart_22-01-22_17-15-26-293.jpg

কর্তব্যে অবহেলায় সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে অর্থ – হাইকোর্ট

আদালত প্রতিবেদকঃ হাইকোর্ট বলেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ বা আদেশে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের ক্ষতিপূরণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে দায়বদ্ধ।

শুধু তা-ই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ছাড়াও তাদের পক্ষে যে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করতে পারবে।

‘মো. জহিরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য’ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে সুদসহ ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেছে, ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়ার পরই দেখা যায় যে, বিবাদীগণ ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে কালক্ষেপণ করে। এই টাকা পরিশোধে বিলম্বের দ্বারা ভুক্তভোগীদেরকে একধরনের অজানা আশঙ্কার মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখা হয়। সেজন্য ক্ষতিপূরণের মামলায় ব্যাংক রেট হারে ক্ষতিপূরণের সঙ্গে সুদ প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন। কারণ ক্ষতিপূরণ একটা দেনার মতো। একটি ঋণের মতো, যা সুদসহ পরিশোধিত হয়।

২০১৭ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে নৌকাডুবির ঘটনায় মৃত ১৮ জনের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে প্রায় ৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়ে গত বছরের ৩০ জুন এ রায় দেয় হাইকোর্ট। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি চলতি মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা হয়।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, সাংবিধানিক আইনে সরকার বা সরকারি কর্তৃপক্ষ তাদের অধীনস্হ কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের দায়িত্বে গাফিলতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে সরকার এই ক্ষতিপূরণের সমপরিমাণ টাকা দায়িত্বে গাফিলতির জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ঠিকাদারদের কাছ থেকে আইনগত পদ্ধতিতে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিবেন। এই নীতিটির ফলে সরকারি কোষাগার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিলেও দায়িত্বে অবহেলা যে সকল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী করেছে তাদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে।

রায়ে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কারণে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হলে টর্ট আইনে (পূরণযোগ্য ক্ষতি আইন) ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ ব্যক্তির ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাবলিক আইনের পাশাপাশি প্রাইভেট আইনেও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। আদালত বলেন, আদালত তার বাস্তব জ্ঞান ও সচেতনতার চোখ বন্ধ রাখতে পারে না। অপরাধীর শাস্তি ভুক্তভোগী তথা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারকে উল্লেখ করার মতো কোনো সান্তনা দেয় না। প্রতিকার হিসেবে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়াই উত্কৃষ্ট এবং একমাত্র প্রতিবিধান, যা ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্ত বা মৃত ব্যক্তির পরিবারের ক্ষতে মলম লাগানোর মতো।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের এপ্রিলে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাট থেকে প্রায় ৩৫০ জন যাত্রী নিয়ে একটি সি-ট্রাক সন্দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দেয়। সন্ধ্যায় জাহাজটি সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটের কাছে পৌঁছায়। জাহাজটি সরাসরি ঘাটে ভিড়তে না পারায় সেটি ঘাটের কিছুটা দূরে থামিয়ে যাত্রীদের নৌকায় করে ঘাটে নেওয়া হচ্ছিল।

এ রকম একটি নৌকা যাত্রী নিয়ে ঘাটে যাওয়ার সময় ঢেউ ও বাতাসে উলটে যায়। পরে কোস্ট গার্ড ও স্হানীয় লোকজনের সহায়তায় ২২ জনকে জীবিত ও ১৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত ১৮ জনের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রিট করেন সন্দ্বীপের বাসিন্দা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। সেই মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল যথাযথ ঘোষণা করে ৯টি নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট।

রায়ে বলা হয়েছে, এই ১৮ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ হরণ করা হয়েছে। এটি কাচের মতো স্পষ্ট, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিটিসি) ও চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের (সিডিসি) অবহেলার কারণেই তাদের মৃতু্য হয়েছে। এ কারণে ১৮ নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ বিআইডব্লিউটিসি ও সিডিসিকে সমান হারে চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা এই রিট মামলাটি যেদিন করা হয়েছে, সেদিন থেকে ক্ষতিপূরণের মোট টাকার ৮ শতাংশ হারে সুদও দিতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top