বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

বিশেষ প্রতিবেদকঃ আজ ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়।

১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। জাতি যখন বিজয়ের খুব কাছে, সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিত্সক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।

বছর ঘুরে আবারও এসেছে ১৪ ডিসেম্বর—শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতি আজ স্মরণ করবে একাত্তরে অকালে প্রাণ হারানো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। যথাযোগ্য মর্যাদায় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস-২০২১ পালনের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপলক্ষ্যে পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটিতে আরো বাণী দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের।

দিবসটি উপলক্ষ্যে সকাল ৭টা ৫ মিনিটে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে শহিদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা এবং যুদ্ধাহত ও উপস্হিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৭টা ২২ মিনিটে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে সর্বস্তরের জনগণ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসের তাত্পর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৮টায় মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল ৯টায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। ২০১৬ সালের ১১ মে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় তাদের বিচার এখনো কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। চৌধুরী মইনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে এবং আশরাফুজ্জামান খান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন। তাদের ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২।

ডিসেম্বর ১২, ১৯৭১। আর্মি সদর দপ্তর। প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বসে আছেন। তার ডাকে উপস্হিত হয়েছেন আলবদর ও আলশামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কেরা। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় গোপন শলাপরামর্শ। এই বৈঠকে চূড়ান্ত তালিকা তুলে দেওয়া হয়। প্রণয়ন করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনা। এই হত্যাকাণ্ড যে সংঘটিত হবে, অনেক আগে থেকেই তার নীলনকশা চলছিল। পরাজয় নিশ্চিত জেনে এদিনই চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের অস্ত্র নিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামে আলবদর, আলশামস বাহিনী। যদিও এর আগেই সারা দেশে শুরু হয়ে গেছে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। ১০ ডিসেম্বর এই আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে। অনেকে মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাজাকারদের সহযোগিতায় বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৪ ডিসেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে এক শ্রেণির দালালরা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করার এই নীলনকশা প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র সহায়তা নিয়ে তাদেরই ছত্রছায়ায় আধাসামরিক বাহিনী আলবদরের ক্যাডাররা এই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। ঢাকায় এই হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় এবং ক্রমে তা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষত জেলা ও মহকুমা শহরে সম্প্রসারিত হয়। হত্যাকারীরা বুদ্ধিজীবীদের গেস্টাপো কায়দায় ধরে নিয়ে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে কোনো বিশেষ ক্যাম্পে বা বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে যেত। শহরে জারিকৃত কারফিউয়ের সুযোগে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেত। তাদের ওপর চালানো হতো নির্মম অত্যাচার। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হতো।

ঢাকা শহরের দুটি বধ্যভূমির মধ্যে একটি ছিল মোহাম্মদপুরের কাছে রায়ের বাজারের জলাভূমি, অপরটি ছিল মিরপুরে। এ দুটি বধ্যভূমিতে ডোবা, নালা ইটের পাঁজার মধ্যে অসংখ্য মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্হায় পদে থাকতে দেখা যায়। এসব মৃতদেহের অধিকাংশের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল, হাত পেছন দিক থেকে বাঁধা। এসব মৃতদেহের মাথায় ও পিঠে বুলেটের চিহ্ন ছিল। আর সারা দেহে ছিল বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন। বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা আজ পর্যন্ত গণনা করা হয়নি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক গ্রম্হ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এদের মধ্যে ৯৯১ জন ছিলেন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিত্সক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন সাহিত্যিক, শিল্পী ও প্রকৌশলী। বুদ্ধিজীবী নিধনের এ তালিকায় ঢাকা বিভাগে ২০২ জন শিক্ষক ও ১০ জন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে ২২৪ জন শিক্ষক ও ১০ জন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়। খুলনা বিভাগে ২৮০ জন শিক্ষক ও ছয় জন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়। রাজশাহী বিভাগে ২৬২ জন শিক্ষক ও ১৫ জন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়। তবে এ তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম ছিল না।

এদিকে, গত বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এন এম মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশীদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুর রহমান খান, এ এন এম মুনীরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান খাদিম, মো. সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, হবিবর রহমান, সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. আবুল কালাম আজাদ। সাংবাদিক ছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, শেখ আবদুল মান্নান (লাডু), সৈয়দ নজমুল হক, এম আখতার, আবুল বাসার, চিশতী হেলালুর রহমান, শিবসদন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীন।

এছাড়া শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক পূর্ণেন্দু দস্তিদার, মেহেরুন্নেসা, দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহাসহ আরো অসংখ্য নাম। শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় পার্টি-জেপির বিবৃতি মহান শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় পার্টি-জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপি এবং দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের গভীর ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন। বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া বাণীতে নেতৃদ্বয় বলেন, ‘এ দেশে ১৯৭১ থেকে শুরু করে বিজয় পর্যন্ত পাকিস্তানিরা যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা থেকে বাদ যায়নি শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনবিদ, ক্রীড়াবিদসহ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা। এসব বুদ্ধিজীবী দেশের মানুষকে জাগরণীর গান শোনাতেন, করতেন অধিকার সচেতন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মধ্যে ছড়িছে দিতেন। এ কারণেই ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা ছিল বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের অন্যতম লক্ষ্যবস্ত্ত। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের ঠিক পূর্বলগ্নে জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা ১৪ ডিসেম্বর হানে চরম আঘাত, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী।

আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী শাহাদত বরণ করেছেন স্বাধীনতা ও বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের, তাদের কথা স্মরণ হয় বারবার, যারা এই দেশকে আলোকিত করেছিলেন তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। তারা চেয়েছিলেন একটি আলোকিত সমাজ, রাষ্ট্র এবং দেশ। তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ জাতিকে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ করেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম, তাদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত থেকে, দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত করব। আমরা বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্িত কামনা করি এবং এই শপথ গ্রহণ করি যে, এই জাতীয় বীরদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেথে দেব না।’ জেপির কর্মসূচি: শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সকাল ৬টায় জাতীয় পার্টি-জেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও সকাল ৮টায় মিরপুরের জাতীয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং সকাল সাড়ে ১০টায় রায়েরবাজার বদ্ধভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top