নকল হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ
গণহত্যার শামিল, মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা
অপরাধ প্রতিবেদকঃ দেশে নকল হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। ক্যানসার, লিভার, হূদরোগ, কিডনি ও করোনাসহ প্রায় সব রোগের নকল ওষুধে বাজার সয়লাব। বাদ যাচ্ছে না আইসিইউ, সিসিইউয়ের ওষুধ সরঞ্জামও। একে গণহত্যার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষ অসুস্থ হয়ে ওষুধ সেবন করে। আর নকল ওষুধ সেবন করে মানুষ সুস্থ না হয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। মহামারিতে যে পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ খেয়ে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আইসিইউ ও সিসিইউতে চিকিত্সাধীন যে সব রোগীদের নকল ও ভেজাল ওষুধ দেওয়া হয় তাদের মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
নকল ওষুধ উত্পাদন, বিক্রি ও বিপণনে যারা জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জোর দাবি জানান তারা। তাদের মতে, এক জন খুনি এক জন মানুষকে হত্যা করে। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীরা নীরবে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। তাদের কোনো ক্ষমা নেই।
দেশে বিভিন্ন সময় অভিযানে নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীদের গ্রেফতার করেছে ডিবি, গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
কিন্তু তারপরও বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উত্পাদন ও বিক্রি। দুর্বল আইনের কারণে নকল ওষুধ তৈরিতে ভয় পায় না তারা। ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছর। তবে জরিমানার অঙ্ক নির্দিষ্ট না থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলা হওয়ার পর তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে নকল ওষুধ উত্পাদনকারীরা। তাদের টাকারও কোনো অভাব নেই।
কারণ নকল ওষুধে পুরোটাই লাভ। তাই যে কোনোভাবেই হোক তারা এক শ্রেণির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে। এ কারণে বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উত্পাদন। সম্প্রতি নকল প্যারাসিটামল খেয়ে পাঁচ শতাধিক শিশু মারা যায়। এই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিন্তু জড়িতদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত দেশি-বিদেশি নকল ওষুধ জব্দ করেছে। ফকিরাপুল থেকে তারা নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের মেয়াদ বাড়ানোর লেভেল ছাপায়। ঢাকা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সারা দেশে এ সব নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ করে আসছে এই চক্রটি।
এদিকে নকল ও ভেজাল ওষুধের বড় বাজার হলো বাবুবাজার, মিটফোর্ড এলাকাসহ সারা দেশের পাইকারি ওষুধ মার্কেট। ভেজাল ওষুধের কারবার বহুদিন ধরে চললেও দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে অভিযান পরিচালনা ও জরিমানা করা হলেও লাভ কিছু হয় না। ফলে কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর আবারও অবৈধ কারবারিদের কার্যক্রম ফের শুরু হয়।
কেমিস্ট ও ড্রাগিস্ট সমিতির এক শ্রেণির কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা পায় নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীদের কাছ থেকে।
এদিকে সার্বিক অবস্থা দেখভালের দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। অথচ এর একশ্রেণির কর্মকর্তাও নকল ওষুধ উত্পাদনকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। নিয়মিত মাসোহারা নেন তারাও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনকারীরা নীরবে গণহারে মানুষ হত্যা করে জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করলে রোগীর অরোগ্য হবে না। বরং ক্ষতি হবে নানা রকম। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন ও বিপণন করা গণহত্যার সমান। এদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।
সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন করলে রোগীর জীবন রক্ষা হয় না, বরং জীবন বিপন্ন হয়। এটা গণহত্যার সমান অপরাধ। নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদনে জড়িতদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে নকল ওষুধ বানায় না। ঐসব দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধ কিংবা খাদ্যে ভেজাল করলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, সারা বছর নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন হচ্ছে। এর ১০০ ভাগের মধ্যে এক ভাগও উদ্ধার হয় না। মনিটরিংয়ে যোগ্য মানুষ নেই। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে আসছে। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন গণহত্যার শামিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লুত্ফুল কবীর বলেন, কোভিড রোগীদের মোনাস-১০ ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয়। কিন্তু নকল মোনাস-১০-এ কোনো কার্যকর উপাদানই নেই। এই ওষুধ সেবন করে রোগীর রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। বরং আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপের দিকে গিয়ে মৃত্যু হয় রোগীর। তাই নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন গণহত্যার শামিল। এটা বন্ধ করা উচিত। নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি, বিক্রি ও বিপণনে জড়িতরাও সমান অপরাধী।
র্যাবের সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করেন তিনি। এর মধ্যে ক্যানসার, লিভার, হূদেরাগ, কিডনি, আইসিইউ ও সিসিইউয়ে ব্যবহূত ওষুধও ছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে লেভেল লাগিয়ে মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছু চক্র নিজেরাই নকল ওষুধ তৈরি করে। নিম্নমানের কোম্পানি ও নামসর্বস্ব কোম্পানিও নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন করছে। সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা জরিমানা করেন তিনি। বিশেষ ক্ষমতা আইনে বেশ কিছু মামলাও দিয়েছেন। সেগুলো বিচারাধীন।
তিনি বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উত্পাদন গণহত্যার শামিল। তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব আলীর বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।