ভেঙে পড়েছে বরিশালের চিকিৎসাসেবা

PicsArt_07-13-08.29.44.jpg

জনবলসংকটে ভেঙে পড়েছে বরিশালের চিকিৎসাসেবা
১ কোটি মানুষের জন্য শয্যাসংখ্যা মাত্র ২২২০, আইসিইউ শয্যা আছে ২২টি

বিশেষ রিপোর্টঃ বরিশাল বিভাগে ৬টি জেলায় চিকিৎসক, টেকনিশিয়ানসহ জনবলের তীব্র সংকট। এছাড়াও সংকট রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। চিকিৎসাসেবা বলতে গেলে ভেঙে পড়েছে। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পর্যায়ে উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ওয়ার্ড পর্যায়ে হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত চিকিৎসার বেহাল অবস্থা। এসব যেন দেখার কেউ নেই।

বরাদ্দকৃত জনবলের অর্ধেকের চেয়ে কম জনবল দিয়ে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ সহ ৬টি জেলা, উপজেলাসমূহ, ইউনিয়ন সাব সেন্টার ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিউিনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা চলছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও এসব ব্যবহারের জনবল না থাকায় সব বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে।

বরিশাল বিভাগের ৯৮ ভাগ হাসপাতালেই এই অবস্থা। এক বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের উপরেই পুরো ৬টি জেলার চিকিৎসাসেবা নির্ভরশীল। এই হাসপাতালে বরাদ্দের অর্ধেকেরও কম জনবল রয়েছে। চিকিৎসকরা বলেন, শুধু করোনাকে সামাল দিতে গিয়ে আমাদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এই বিভাগের এক কোটি মানুষের জন্য মাত্র ২২টি আইসিইউ বেড রয়েছে, তাও এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ৫২৩টি রয়েছে একই হাসপাতালে করোনার জন্য আইসোলেশন বেড।

এই বিভাগে করোনা শনাক্তের হার ৪৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এই সীমিত জনবল দিয়ে শুধু করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতেই চিকিৎসকক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মচারীদের অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। উপরন্তু নেই তেমন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। করোনার চিকিত্সার বাইরে রয়েছে বিপুল সংখ্যক কিডনি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, নিউরোলজিসহ বিভিন্ন ধরনের রোগী। করোনার চিকিৎসার পর তাদের চিকিত্সা দেওয়া ডাক্তারদের পক্ষে অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। এই বিভাগের রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। চাহিদার তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা সীমিত হওয়ায় সাধারণ বেডে রেখে কোনরকমে চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। এই অব্যবস্থার কারণে বরিশাল বিভাগে মৃত্যু ও সংক্রমণ হার বাড়ছে বলে চিকিত্সকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর বরিশাল বিভাগে প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

গত ২৪ ঘন্টায় একদিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ১২শ’৬৫ জনের মধ্যে ৫৭৫ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। বেশিরভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত।

আক্রান্তের হার ৪৫ দশমিক ৪৫। এরমধ্যে বরিশাল জেলায় সর্বোচ্চ ৩৬৩ জনের মধ্যে ২১৬ জনই আক্রান্ত। এ জেলায় আক্রান্তের হার ৫৯ দশমিক ৫০। পটুয়াখালীতে ৯১ জনের মধ্যে ৪৯ জন। আক্রান্তের হার ৫৩ দশমিক ৮৫। ভোলা জেলায় ১২৬ জনের মধ্যে ৩৭ জন।

আক্রান্তের হার ২৯ দশমিক ৩৭। পিরোজপুর জেলায় ২৭৮ জনের মধ্যে ৯৪ জন। আক্রান্তের হার ৩৩ দশমিক ৮১। বরগুনা জেলায় ১৪৫ জনের মধ্যে ৬৬ জন। আক্রান্তের হার ৪৪ দশমিক ০৩। ঝালকাঠী জেলায় ২৫৮ জনের মধ্যে ১১৩ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের হার ৪৩ দশমিক ০৮ ভাগ।

এদিকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইটি পিসিআর ল্যাবে বিগত ২৪ ঘন্টার রিপোর্টে শনাক্তের হার ৬৪ দশমিক ৩৬ ভাগ। ১৮৮টি নমুনার মধ্যে এই ল্যাবে ১২১ জনের করোনা পজিটিভ আসে। ২৪ ঘন্টায় শের-ই-বাংলা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের আইসোলেশনে থাকা এ যাবত্কালের সর্বোচ্চ ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ হাসপাতালের আইসোলেশনে মোট ৬১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ২৩ জনের করোনার রিপোর্ট অপেক্ষমান রয়েছে। এছাড়াও আক্রান্ত হয়ে বিগত ২৪ ঘন্টায় বরগুনায় ২ জন এবং ঝালকাঠীতে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৫২ জন। এরমধ্যে শের-ই-বাংলা মেডিকেলেই মৃত।

বিগত সময়ের চেয়ে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি চিকিত্সা সেবার মান। দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিশেষায়িত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের সর্বত্রই সংকট।

বরিশাল বিভাগের কোটি মানুষের জন্য ৩৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৬টি জেলা হাসপাতাল ও ৩৩৬ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের জন্য মোট মঞ্জুরীকৃত ১১২৯টি চিকিত্সক পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছে ৬০৫ জন। শূন্য রয়েছে ৫২৪টি পদ। বরিশাল জেলায় মঞ্জুরীকৃত ২২২ পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছে ১৪৪ জন। এ জেলায় ৭৮টি শূন্য পদের পাশাপাশি সদর (জেনারেল) হাসপাতালটি কাগজে কলমে ১শ’ বেডে উন্নীত হলেও সে তুলনায় চিকিত্সক আছেন খুবই কম। ৫০ বেডের জন্য ৩৩ জন চিকিত্সকের স্থলে রয়েছেন মাত্র ২৩ জন। শূন্য রয়েছে ১০টি পদ। পটুয়াখালী জেলায় ১৬৫ পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন ৯৩ জন। শূন্য রয়েছে ৭৩টি পদ। এ জেলার ২৫০ বেড’র হাসপাতালে ৫৮ পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১১ জন। সেখানকার ৪৭টি পদই শূন্য পড়ে আছে।

ভোলা জেলায় ১৮৭ পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন ৯১ জন। শূন্য রয়েছে ৯৬টি পদ। ভোলার ২৫০ বেড’র হাসপাতালের ২২ পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন ১০ জন। শূন্য রয়েছে ১২টি পদ।

পিরোজপুরে ১৭২টি পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন ৮৯ জন। শূন্য রয়েছে ৮৩টি পদ। সেখানকার ৫০ বেড’র হাসপাতাল কাগজে কলমে ১শ’ বেডে উন্নীত হলেও চিকিত্সক পূর্বের ৫০ বেডে’র ৩৩ জনের মধ্যে ১১ জন কর্মরত রয়েছেন। সেখানকার ২২টি পদই শূন্য রয়েছে। বরগুনা জেলার ১২৫টি পদের মধ্যে ৬৩ জন কর্মরত রয়েছেন। শূন্য রয়েছে ৬২টি পদ। এ জেলার ১শ’ বেডের হাসপাতালে ৪২টি পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬ জন চিকিত্সক। শূন্য রয়েছে ৩৬টি পদ।

ঝালকাঠী জেলায় ১০৩টি পদের অনুকুলে ৬৫ জন কর্মরত রয়েছেন। এ জেলায় ৩৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়াও টেকনোলজিস্ট ২৭৪টি পদের অনুকুলে কর্মরত রয়েছেন ১১২ জন। শূন্য পদ রয়েছে ১৬২টি। তৃতীয় শ্রেনীর জনবলের ৪ হাজার ১৬৩ জনের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৩ হাজার ১৫ জন। শূন্য পদের সংখ্যা ১১২৮টি। চতুর্থ শ্রেনীর ১২৪১টি পদের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৭৯৫ জন। শূন্য পদের সংখ্যা ৪৪৫টি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়নে কর্মরত সহকারী সার্জনদের মধ্যে অধিকাংশকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে।

এ সংকটের মধ্যেই বিভাগের ২ হাজার ২২০ বেডে চিকিত্সা চলছে রোগীদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগের কার্যালয় সূত্র জানায়, উপজেলাগুলোতে ৩১ বেড’র হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই ৫০ বেডে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে জনবল কাঠামো ৩১ বেড’র অর্ধেকও নেই এসব হাসপাতালগুলোতে। এছাড়াও পিরোজপুর ও বরিশালের সদর হাসপাতাল কাগজে-কলমে ১শ’ বেডে উন্নীত হলেও জনবল রয়েছে পূর্বের ৫০ বেডের অর্ধেক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা ও উপজেলায় যেসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসাপাতাল রয়েছে সেখানে চিকিত্সকের পদের প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য রয়েছে। একই সঙ্গে নার্স ব্যতিত সকল টেকনোলজিস্ট সহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর জনবল কাঠামোতেও সংকট রয়েছে।

তিনি জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য বিভাগে ৫২৩টি আইসোলেশন বেড এর ব্যবস্থা থাকলেও আইসিইউ রয়েছে শেবাচিমে ২২টি। এছাড়া বিভাগের কোথাও বেসরকারিভাবে আইসিইউ কিংবা আইসোলেশন বেড ব্যবস্থাপনা নেই বলে জানান তিনি।

বিভাগের জেলা-উপজেলা এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে জনবল কাঠামোর এ তীব্র সংকটের মধ্যে সাধারণ রোগীদের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে আসতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক করোনা সংক্রমন বরিশালজুড়ে দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার থেকে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় সাধারণ জখমি, সর্দি বা কাশির রোগী, অর্থাত্ যেসব চিকিত্সা জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে সম্ভব সেইসব রোগীদের বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এ বিষয়টি জানিয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় থেকে সকল জেলা সিভিল সার্জন, সকল জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি প্রেরণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top