সনদ স্বাক্ষরের জন্য ভাতা নেন উপাচার্য এমএ মাননান

সনদ স্বাক্ষরের জন্য ভাতা নেন উপাচার্য এমএ মাননান

ডিগ্রিধারীদের সনদে স্বাক্ষর করা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের দৈনন্দিন কার্যাবলির মধ্যেই পড়ে। যদিও কাজটির জন্য আলাদা করে পারিশ্রমিক নিচ্ছেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য। ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের সনদপ্রতি ৬ টাকা করে স্বাক্ষর ভাতা নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমএ মাননান। এটিকে নজিরবিহীন বলছেন উচ্চশিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা।

২০১৩ সালের মার্চে বাউবির উপাচার্য পদে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এমএ মাননান। দায়িত্ব গ্রহণের পর সনদ স্বাক্ষরের জন্য একটি ভাতা চালু করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সদ্য বিদায়ী এ প্রধান নির্বাহী। দুই মেয়াদে শুধু সনদ স্বাক্ষর বাবদই ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ভাতা নিয়েছেন এ উপাচার্য। এজন্য একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। সেখানে উপাচার্যের পাশাপাশি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও এ শাখার অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা রাখা হয়। নীতমালা অনুযায়ী, সুবিধাপ্রাপ্যরা ৩০ শতাংশ সনদ নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে স্বাক্ষর করবেন। আর ৭০ শতাংশ সনদ স্বাক্ষর করার বিপরীতে ভাতা গ্রহণ করবেন।

তবে সনদে স্বাক্ষর করা বাবদ ভাতা গ্রহণের বিষয়টিকে খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক বলে দাবি করেন অধ্যাপক এমএ মাননান। গনমাধ্যমে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর দেখলাম পাঁচ লাখের বেশি সনদ স্বাক্ষরের জন্য পড়ে রয়েছে। এছাড়া প্রতি শিক্ষাবর্ষে ডিগ্রি পর্যায়ে প্রায় চার লাখ সনদে সই করতে হয়। কোনো উপাচার্যের পক্ষে অফিশিয়াল কাজ করে এত সনদে সই করা সম্ভব নয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা আমাকে জানালেন, সনদ নিয়ে তাদের ওপরও বেশী চাপ যাচ্ছে। তাদের জন্য একটি সম্মানীর ব্যবস্থা করে দিলে সনদ জটিলতা সমাধান হওয়ার কথা বলেন। এরপর এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করে সেটির অনুমোদন করা হয়। টাকার পরিমাণও বেশি না। প্রতি সনদে ৬ টাকার মতো। এটা খুবই যৌক্তিক ও স্বাভাবিক। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এটি রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন প্রথা চালু রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে সনদে স্বাক্ষর বাবদ উপাচার্যের ভাতা নেয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যদিও শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সে হিসেবে সবচেয়ে বেশি সনদে স্বাক্ষর করতে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেই।

দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে গত মার্চে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। সম্প্রতি জার্মানির হাউডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশ চেয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। সনদে স্বাক্ষর বাবদ একজন উপাচার্যের ভাতা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে গন মাধ্যমে
তিনি বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে এ ধরনের কোনো ভাতা গ্রহণ করিনি। যদি স্বাক্ষরের জন্য ভাতা নিই, তাহলে সরকার আমাকে এ পদে নিয়োগ দিল কেন? আমার তাহলে কাজটা কী? দায়িত্ব ছাড়ার পর আজও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের প্রায় ৬০০ সনদে স্বাক্ষর করেছি। কারণ এটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মশিউর রহমান। তিনিও সনদ স্বাক্ষরের জন্য কোনো ভাতা নেন না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আগের উপাচার্যও এ কাজের জন্য কোনো ভাতা নেননি, আমিও নিচ্ছি না। তবে আগে একসময় এ সংস্কৃতি ছিল বলে শুনেছি।

এছাড়া অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এমন কোনো ভাতা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ ধরনের কোনো রেওয়াজ চালু নেই। এদিকে ডিগ্রিধারীর সনদে স্বাক্ষর বাবদ বাউবি উপাচার্যের ভাতা গ্রহণের বিষয়টি নজরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনেরও (ইউজিসি)। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির বাজেট পর্যবেক্ষণে এ ধরনের ভাতা বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগে প্রদানকৃত অর্থ ফেরতের নির্দেশনাও দেয় ইউজিসি। যদিও নির্দেশনার আলোকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি বাউবি কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য ও খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, সনদে স্বাক্ষর করা উপাচার্যের স্বাভাবিক কাজের মধ্যে পড়ে। এখানে সৃষ্টিশীলতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিষয় নেই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ ধরনের ভাতা নেন বলে আমার জানা নেই। নীতিমালা প্রণয়ন করে যেকোনো বিষয়কে বৈধতা দেয়ার সুযোগ নেই। আমি বলব, উপাচার্য একাডেমিক ও প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে সনদে স্বাক্ষরের জন্য ভাতা নিতে পারেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top