সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা গেল কোথায়!

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা গেল কোথায়!
মাত্র ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই থৈ থৈ বন্দরনগরী

বুরো অফিস চট্টগ্রামঃ মাত্র ৪৪ মিলিমিটার মাঝারি বৃষ্টি ঝরেছে গতকাল রোববার বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। আর তাতেই হাঁটু থেকে কোমরপানিতে তলিয়ে গেছে নগরের অধিকাংশ এলাকা। অথচ এ নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে ১১ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকারি তিনটি সংস্থা।

সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব প্রকল্পে গত তিন বছরে ব্যয়ও করেছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি।

চট্টগ্রামের মেয়র অবশ্য বলছেন, শিগগিরই নগরবাসীর মুক্তি মিলবে জলাবদ্ধতা থেকে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই মুক্তি সহজে আসছে না।

জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দায়ী করছেন খালের মধ্যে দেওয়া বাঁধকে। তিন দিন আগে তিনি মন্তব্য করেন, ‘একটু ধৈর্য ধরতে হবে নগরবাসীকে। তবে প্রকল্পের প্রয়োজনে খালের মুখে দেওয়া বাঁধ এখনই অপসারণ করতে হবে। তা না হলে এই বর্ষাতেই গলাপানিতে ডুববে চট্টগ্রাম।’

তবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলছেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেটির তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। সিডিএ কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। খালের মুখের যে বাঁধের কথা বলা হচ্ছে, তা আগেই কেন মনিটর করা হয়নি? বর্ষার আগেই কেন তা অপসারণ করা হয়নি? আসলে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজে নেই সমন্বয়হীনতা। তাই আসছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল।’

সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী বলছেন, ‘হঠাৎ অতিবৃষ্টি হয়েছে। তাই কোথাও কোথাও সাময়িকভাবে পানি জমেছে। তবে নালা ও খালের প্রশস্ততা বেড়েছে, তাই পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। খালের বাঁধগুলোও কেটে দিয়েছি। আটকে থাকা পানি সরাতে কুইক রেসপন্স টিম ও ইমার্জেন্সি টিম কাজ করছে।’

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প ও দুই হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিস্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

২০১৭ সালের আগস্টে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। এটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।

২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল খালের আবর্জনা অপসারণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে নগরের ৩৫টি খাল থেকে তিন হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ৫৪টি ব্রিজ-কালভার্টের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে পাঁচটি খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। খালগুলোর পাশে ১৭৬ কিলোমিটার প্রতিরোধ দেয়ালের মধ্যে ৫৮ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পাহাড়ি বালু আটকানোর জন্য ৪২টি সিলট্র্যাপের মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে মাত্র ১৫টির। খালের দু’পাড়ে ৮৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কথা থাকলেও কাজ শেষ হয়েছে মাত্র দেড় কিলোমিটার। প্রকল্পে অগ্রগতি হয়েছে কেবল অর্ধেক! অথচ ব্যয় হয়ে গেছে এক হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।

২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল দুই হাজার ৩১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর শুরু হয় প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পের আওতায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ৮ দশমিক ৫৫ কিলোমিটার সড়কসহ বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে।

ইতোমধ্যে সাতটি স্লুইসগেট নির্মাণকাজের ৮০ শতাংশ ও তিনটির ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি দুটির কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে। এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসে। অথচ অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ আর ইতোমধ্যে ব্যয় হয়েছে ৬৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ বলেন, ‘১২টি স্লুইসগেটের মধ্যে পাঁচটির অবকাঠামো কাজ শেষ হয়েছে। এখন পাম্প ও গেট বসানোর কাজ বাকি আছে। এগুলো ইউরোপ থেকে আমদানি করা হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এগুলো আসতে দেরি হচ্ছে। তাই বর্ষায় গেটগুলো চালু করা সম্ভব হবে না।’

এক হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিলে ওই বছরের ২৪ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। প্রায় সাত বছর পেরোলেও এর কাজ শুরুই করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। ইতোমধ্যে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো মেয়াদও শেষ হবে চলতি মাসে। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি এখনও শূন্যের কোটায়। অথচ জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ৯১১ কোটি টাকা। পাঁচটি লটে ভাগ করে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখনও অনুমোদন মেলেনি তিনটি লটের। দুটি লটের অনুমোদন মিললেও এখনও ভূমি বুঝিয়ে দেয়নি জেলা প্রশাসন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা ব্যয় হবে জমি অধিগ্রহণে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের ২০৮ কোটি ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ১০৬ কোটি টাকা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয়ের কথা ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয়ের সামর্থ্য নেই। জেলা প্রশাসনকে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা একসঙ্গে দিতে না পারায় ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াও থমকে আছে। প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা সরকারি তহবিল থেকে দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রকল্প সংশোধন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিস্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রকল্পের আওতায় ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর বসানো হবে। কর্ণফুলী নদীতীরে নির্মাণ হবে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল। ইতোমধ্যে মাত্র তিনটি রেগুলেটরের কাজ চলছে। বন্যা প্রতিরোধ কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে এর মধ্যেই ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক কর্নেল কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থিকসহ নানা সংকটে পুরোদমে কাজ করা যায়নি। প্রকল্পের অগ্রগতি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে।’

মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাতেই নগরের মুরাদপুর, ষোলশহর, চকবাজার, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, কাতালগঞ্জ, চাক্তাই, বাকলিয়া, ডিসি রোড, রহমতগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহর ও চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সরেজমিন দেখা গেছে, কাপাসগোলায় ছিল হাঁটুপানি, মুরাদপুরে ছিল প্রায় কোমরপানি। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

কাতালগঞ্জের বাসিন্দা ডা. সীমান্ত ওয়াদ্দেদার বলেন, ‘বৃষ্টিতে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছি। বাসার সামনে কোমরপানি। তাই কর্মস্থলে যেতে পারিনি।’ বহদ্দারহাট স্বজন সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী ফরিদুল আলম বলেন, ‘সড়ক থেকে কয়েক ফুট উঁচু মার্কেট, তবুও এর নিচতলা তলিয়ে গেছে।’

কাপাসাগোলা আবদুল হাকিম সওদাগর লেনের বাসিন্দা ডা. এসএম জসিম উদ্দিন বলেন, ‘বাসার সামনে কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমরপানি জমে গেছে।’ নগরের একটি বই বিপণি কেন্দ্রের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কোমরপানি মাড়িয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়তি ভাড়া গুনে রিকশায় করে কাজে এসেছি।’

টানা দু’দিনের বৃষ্টিতে নগরীর নিম্নাঞ্চলে হাসপাতালেও জমেছে হাঁটুপানি। আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলায় জমেছে হাঁটুপানি। জরুরি বিভাগও তলিয়ে গেছে পানিতে। জলাবদ্ধতার কারণে হালিশহরের মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল এবং সাউথ পয়েন্ট হাসপাতালে আসা রোগীদেরও পোহাতে হয় ভোগান্তি। মা ও শিশু হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন শিপিং কর্মকর্তা আবদুল আহাদের স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দিনভর পানিতে সয়লাব ছিল মা ও শিশু হাসপাতাল।’

তাহলে সরকারের এতগুলো টাকা কোথায় গেল? কতটুকুই বা সুফল পেল এখানকার স্থানীয় লোকজন?
প্রশ্ন এলাকাবাসীর!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top