অগ্রিম টাকা দিয়েও টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ
বিশেষ প্রতিবেদকঃ অর্থ পরিশোধ করেও করোনার ভ্যাকসিন পাচ্ছে না বাংলাদেশ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত বছরের ৫ নভেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ৩ কোটি ডোজ টিকা রপ্তানি করবে এবং সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা পাচ্ছে না। অথচ টিকা দেবে বলে অগ্রিম দেড় কোটি ডোজ টিকার মূল্য বাবদ ৫১০ কোটি টাকা আগেই নিয়েছে সিরাম ইনস্টিটিউট।
কিন্তু গত দুই মাসে টিকার কোনো চালান আসেনি। কবে নাগাদ টিকার চালান আসতে পারে, তা কেউ বলতে পারছে না। চুক্তির পর ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে এ পর্যন্ত দুটি চালানে ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে। এছাড়া ভারত সরকার উপহার হিসেবে দিয়েছে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা। ক্রয় ও উপহার হিসেবে বাংলাদেশ ভারত থেকে পেয়েছে ১ কোটি ৩ লাখ ডোজ টিকা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজ টিকা যে সংখ্যক মানুষ নিয়েছেন, তাতে দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন করতে প্রায় ১০ লাখ ডোজ টিকার ঘাটতি রয়েছে। এতে প্রথম ডোজ নিতে পারলেও ১০ লাখ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন।
দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় এবং গত ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ। কিন্তু এরই মধ্যে দেশে টিকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার দেশের বেসরকারি একটি কোম্পানির মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি টিকা কেনার চুক্তি করেছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টিকা চেয়ে ভারতের উত্পাদক প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐ বেসরকারি কোম্পানিটি যোগাযোগ করলে তারা বলেছে, আমরা টিকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এটা এখন ভারত সরকারের বিষয়। তাদের ভ্যাকসিন প্রস্তুত আছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স পেলেই তারা আমাদের দিতে পারে। এদিকে বাংলাদেশ সরকার দেশের মানুষের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
টিকার ঘাটতি মেটাতে এখন বাংলাদেশ সরকার নানামুখী তত্পরতা চালাচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক-ভি টিকা বিভিন্ন পরীক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত। দেশে এ টিকা আনার জন্য একটি কনসোর্টিয়াম কাজ করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, রাশিয়া বলেছে, তাদের টেকনোলজি কাউকে দিতে পারবে না। বাংলাদেশের যেসব কোম্পানি ওষুধ উত্পাদন করবে তাদেরই শুধু দেবে। চীন ছয় দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে জোট করেছে। সেখানে বাংলাদেশ আছে, ভারত নেই। চীন ৬ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে দেবে। এছাড়া যত টিকা লাগবে তারা দিতে প্রস্তুত। আমেরিকার একটি কোম্পানিও টিকা দিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি বলেন, আরো ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রেখেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। এ জন্য ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি এখনো পাওয়া যায়নি। ঐ মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিলেই তারা করোনার টিকা পাঠিয়ে দিতে পারবে। তিনি বলেন, এপ্রিল-মে মাসে টিকা নিয়ে একটু ঝামেলা হবে। জুন মাস থেকে কোনো সমস্যা হবে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের আগে বাংলাদেশ করোনার গণটিকাদান কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৩ কোটি ডোজ টিকা তাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা টিকা দিতে পারছে না। এমন প্রেক্ষিতে করোনার টিকা পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে চেষ্টা করছেন, মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চেষ্টা করা হচ্ছে। রাশিয়া, চীন ও আমেরিকার একটি কোম্পানি টিকা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনার টিকা প্রাপ্তির জন্য যা যা দরকার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেশের বড় বড় কোম্পানি আছে, যারা বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করে, তারা করোনার ভ্যাকসিন বিদেশ থেকে আনার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। এ ব্যাপারে কীভাবে অনুমতি দেওয়া যায় এবং কাদের অনুমতি দেওয়া যায় সেই ব্যাপারে সুপারিশ করতে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান হলেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জন অতিরিক্ত সচিবও এ কমিটিতে আছেন। আগামী রবিবারের মধ্যে কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত লিখিত আকারে জানাবে। অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, কোভ্যাক্স থেকে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ইপিআই) ডা. শামসুল হক বলেন, সময়মতো টিকা দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন তাদের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ১০ লাখ টিকার ঘাটতি রয়েছে। এ টিকা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
করোনার টিকার প্রতিটি ডোজের দাম পাঁচ ডলার। সেখান থেকে বাংলাদেশি একটি কোম্পানি এক ডলার পাবে। ভ্যাট, ট্যাক্স ও ট্রান্সফার ফি সব ঐ কোম্পানি বহন করবে। সম্প্রতি ভারত সরকার অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করায় টিকা পাওয়া নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার।