চাকরি নিয়ে দুই কথা – খালেদ মুহিউদ্দীন

PicsArt_03-21-08.42.31.jpg

চাকরি নিয়ে দুই কথা – খালেদ মুহিউদ্দীন

আমরা যারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছি, বেড়েছি তাদের সবার গল্প কি মোটের উপর একইরকম না?

অল্প রোজগেরে একজন বাবা, কম পড়ালেখা জানা একজন মা, দুই বা তিনজন নানা-দাদা-দাদী-নানী, দুই তিন বড়জোর চার ভাই বোনের একটা সংসার। বয়স পাঁচ পেরোতেই আমরা জানি সব খেলনা আমার জন্য না, ঝলমলে জামাটি দোকানে সাজিয়ে রাখার জন্যই, ২০ তারিখের পরের দিনগুলো মুখ বুজে খেয়ে নেবার, মা মানে ছোপ ছোপ হলুদ আর কালিঝুলি মাখানো একজন, বাবা মানে কমদামী সিগারেট ফুঁকে দামি কথা বলা একজন। সাথে থাকবেন একজন কমবয়সে স্বামীহারা খালা, বিবাহ উপযোগী একজন ফুফু আর চালিয়াত ধরনের এক দুইজন তুতো ভাই বা দুলাভাই এইতো!

গল্পে ফিরে আসি, আমাদের বাবা বলিয়ে কইয়ে হলে গল্প করবেন যে, ছেলেবেলায় কত কষ্ট করে কত মাইল হেঁটে স্কুলে গেছেন, ছোটবেলায় কত ভাল ছেলে আর মনোযোগী ছাত্র ছিলেন, কেমন করে ভাগ্য দোষে কেরানি বা টাইপিস্টের চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তার, কাছের মানুষদের হিংসা আর ষড়যন্ত্র শেষ করে দিয়েছে সব। এখন জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই শুধু আমাদের মানুষের মত মানুষ হতে দেখা ছাড়া। যদিও তা দেখে যেতে পারবেন কিনা তা ভাল বলতে পারেন না। খানিক কাশি আর অনেকখানি দীর্ঘশ্বাস।

মা জানাবেন, কিচ্ছু বুঝতে না বুঝতেই বিয়ে হয়ে গেছিল তার। স্কুল থেকে ফিরে কোঁচড়ের ছোট আম ভর্তা করতে না করতেই শাড়ি পরিয়ে একজনের সঙ্গে রিক্সায় তুলে দেওয়া হল। উনি তার বাবা বা স্বামীর নিন্দা মন্দ করবেন না, দোষ দেবেন না, দোষ খালি তার ভাগ্যের। অনেক শখ ছিল তার পড়ালেখা করে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবেন। এখন জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই শুধু আমাদের মানুষের মত মানুষ হতে দেখা ছাড়া। যদিও তা দেখে যেতে পারবেন কিনা তা ভাল বলতে পারেন না।রান্নাঘরের খুন্তি কড়াই একটু বেশি শব্দ হতেও পারে, একটু সুর অসুরের গুণগুণের মাঝামাঝি।

তো আমরা জানব, আমাদের মানুষের মত মানুষ হতে হবে। সেটি কিরকম? এক কথায় বলতে গেলে একটা পার্মামেন্ট চাকরি যেখানে পেনশন আছে আর ঢাকায় একটা বাসা। সরকারি চাকরিই সবচেয়ে ভাল কারণ তা কখনো যাবে না, মানে চাকরি খাওয়ার সাধ্য কারো নেই। মুখ বুজে অংক বিজ্ঞান গিলে যদি ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় তবে চাকরির বাজার খুব সহজ, জেনারেল লাইনের ভরসা নাই। ইঞ্জিনিয়ারদের আবার বেতনটাই সব নয় আরও নানা সুযোগ সুবিধা আছে। অথবা ডাক্তার হতে পার। রোগী দেখলেই টাকা, অমুক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ দিনে ১০০ রোগী দেখে তমুক হৃদরোগ ২০০ –৫০ টাকা করে ভিজিট। কবিতার মত করে বলা উচিত সিমেন্টের গাঁথুনি দিয়ে দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে আমাদের মগজে মননে।

চাকরি-চাকরি মানে সোনার হরিণ। চাকরি মানেই জীবনের সার্থকতা। চাকরি পেলে তুমি মানুষের মত মানুষ! চাকরি পেলে তবে তুমি গাড়ি ঘোড়া চড়বে, মেলাবে ছোটবেলায় লেখাপড়ার স্বপ্ন। চাকরি পেলে সবাই তোমাকে স্যার ডাকবে নইলে অপরিচিত চ্যাংড়াও তোমাকে তুমি ডাকবে, মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট আনার ফরমায়েস দেবে। চাকরি পাওনি বলে বেলা বোস ফোন ধরতে পারবে না। চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বা মর্যাদা কম ছিল বলে মেয়েদের পড়ালেখার প্রতি বাবামার উৎসাহ ছিল কম।

রাজনীতিতেও আমাদের আগ্রহ চাকরির কারণে। আমরা যে কী পরিমাণ চাকরি ভালবাসি তা আমাদের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দেখলেও বুঝতে পারবেন। নেতা হাসলে তারা হাসেন, চুপ করে থাকলে মুখে দেন তালা। রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মত এত লয়াল চাকরিজীবী আপনি আর কোথাও পাবেন না। লয়াল না হলে বা কাজে না এলে আপনাকে হুদা মান্না হয়ে গাইতে হবে সবাই তো সুখী হতে চায় তবু..। এইচ টি ইমাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সবচেয়ে তালি পান এই বলে যে, ছাত্রলীগের লোকজনকে চাকরি দেওয়া হবে কারণ তাদের দিয়ে নির্বাচন করিয়ে অনেক সুফল পাওয়া গেছে। রাজনীতিবিদেরা মানুষের জন্য কাজ করেন। কী করেছেন জানতে চাইলে বলেন, প্রথমত অন্তত পাঁচশ লোককে চাকরি দিয়েছেন।

আমাদের বাবা মা বা শিক্ষকেরা ছেলে মেয়েকে পরীক্ষায় নকল করতে সাহায্য করেন, কারণ কোনোভাবে একটা সার্টিফিকেট বাগানো গেলে নেতার কাছে গিয়ে চাকরির জন্য ধরে পড়া যাবে। আর নকল করবেই বা না কেন? চাকরি করতে গেলে এইসব বই পুস্তকের কথা কোনটা কাজে লাগে? আমাদের শিক্ষকদের তাদের নিজেদের ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন পর্যন্ত করতে দেই না। কারণ আমরা মনে করি পরীক্ষা পরিচালনা করতে দিলে কী কেলেঙ্কারিটাই না জানি তারা করবেন।

অতএব, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য একটি চাকরি বাগানো। সবার মুখে স্যার শোনা। সরকারের পুলিশ খারাপ, আমলা ঘুসখোর, সচিবেরা নির্লজ্জ বেহায়া, ডাক্তারেরা কসাই শুধু সরকারি চাকরিটা ভাল।

সাংবাদিকদের কথা দিয়ে শেষ করি। অনেককেই বলতে শুনি অনেকদিন বেতন পান না বা বেতনে ঠকায়। তারপরও কেন করেন ভাই? কী করব চাকরি তো করতে হবে। হা ভাই আমাদের সবার বেলাতেই তাই। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে চেয়ার পেতে বসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে হক না হক কথা বলা বা ছবি তোলার আগে একটু ভাল করে দেখেন। দেখেন পুরো দেশ আর আমাদের সবার ছবি তোলার মত লেন্স বা ক্যামেরা আপনার আছে কিনা?

খালেদ মুহিউদ্দীন
সিনিয়র সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top