২০২০ সালের ডিএমপি পুলিশের অপরাধ নামা; পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদের কঠোর নির্দেশ

PicsArt_01-23-12.18.30.jpg

২০২০ সালের ডিএমপি পুলিশের অপরাধ নামা; পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদের কঠোর হুশিয়ারী

আপরাধ প্রতিবেদকঃ পুলিশের নীতিনির্ধারকরা বর্তমানে যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন তার মধ্যে একটি হলো- বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ-অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা। এর পাশাপাশি রয়েছে মাদক-সংশ্নিষ্টতা থেকে পুলিশকে মুক্ত করা। এসব দুষ্টচক্র থেকে পুলিশকে দূরে রাখতে অপকর্মে জড়িয়ে পড়া সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন অনেকে। কারণ, এটা নিশ্চিত হলে বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে একটি কঠোর বার্তা যায়।

দুই লাখ ১২ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় ইউনিট হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। প্রায় ৩৫ হাজার সদস্য ডিএমপিতে নানা পদে কাজ করছেন। গত এক বছরে ডিএমপিতে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের অপরাধে জড়ানো ও শাস্তির পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ৫৬ শতাংশ গুরুদণ্ড হয়েছে প্রধানত তিন অপরাধে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, পারিবারিক সমস্যা ও অদক্ষতা। এরপরই সবচেয়ে বেশি শাস্তি হয়েছে মাদক-সংশ্নিষ্টতায় ও ঘুষ গ্রহণের কারণে।

ডিএমপির তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণে উঠে এসেছে- ২০২০ সালে এই ইউনিটের মোট এক হাজার ৯০১ পুলিশ সদস্য লঘু ও গুরুদণ্ড পেয়েছেন। তার মধ্যে লঘু শাস্তি পেয়েছেন এক হাজার ৫৯৩ জন। বড় শাস্তি হয়েছে ৩০৮ জনের। এক বছরে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মাদকে জড়িয়ে পড়া ২৬ পুলিশ সদস্যসহ ৮০ জনকে। ছোট-বড় উভয় ধরনের অপরাধে বেশি জড়াচ্ছেন কনস্টেবলরা। বাহিনীতে স্বাভাবিক নিয়মেই এই পদবির সদস্য সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। ঘুষ খেলে, মানুষের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করলে, তার যে কাজ করার কথা সেটা না করলে শুধু পুলিশে কেন, অন্য চাকরিজীবীদের জন্য যে ব্যবস্থা আমাদেরও একই ব্যবস্থা। অপরাধের ধরন অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

অনেকে বলছেন, শুধু বিভাগীয় শাস্তির ভেতর দিয়েই গুরুদণ্ড থেকে পার পাচ্ছে পুলিশ- এটা কি সত্যি? এমন প্রশ্নে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ধরনের প্রবণতা আগে ছিল। এটা সব সার্ভিসেই দেখা যেত। মনে করা হতো সাজা দিলে বাহিনীর বদনাম হবে, বাহিনীর মনোবলে আঘাত আসতে পারে। বড় ধরনের অপরাধেও যখন ছোট সাজা দেওয়া হতো, তখন আশা করা হতো ওই ব্যক্তি সংশোধন হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংশোধন হচ্ছে না। তাই এখন মাদক নিয়ে কোনো পুলিশ সদস্য ধরা পড়লে নিয়মিত মামলায়ও তাকে আসামি করা হচ্ছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, যিনি বদলি করেন তার যদি জানা থাকে এ ধরনের অপরাধে ওই সদস্য জড়িয়েছিল, তাহলে ভালো জায়গায় তার বদলি হয় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তি দেন একজন আর বদলি করেন আরেকজন।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ডিএমপিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বড় শাস্তির মুখোমুখি হন ৯৯ জন সদস্য। শৃঙ্খলা ভঙ্গের মধ্যে রয়েছে ঠিকমতো কর্মস্থলে হাজির না হওয়া, অবাধ্যতা, বাহিনীর সুনামহানি ও শোভন আচরণ না করা। এই অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে উপপরিদর্শক (নিরস্ত্র) আটজন, সার্জেন্ট একজন. উপপরিদর্শক (সশস্ত্র) ছয়জন, নায়েক দু’জন, কনস্টেবল ৮১ জন। আর ডিএমপিতে কর্মরত তবে নন-পুলিশ এমন একজন সদস্যও গুরুদণ্ড পেয়েছেন। পারিবারিক কারণে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে ৩৮ জনকে। পারিবারিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে- অনুমতি ছাড়া বিয়ে, যৌতুক দাবি, নির্যাতন ও ভরণপোষণ সঠিকভাবে না করা।

এই অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে পরিদর্শক (নিরস্ত্র) দু’জন, এসআই (নিরস্ত্র) চারজন, সার্জেন্ট একজন, এএসআই (নিরস্ত্র) তিনজন, এসআই (সশস্ত্র) একজন, নায়েক একজন ও কনস্টেবল ২৬ জন। অদক্ষতার কারণে গত বছর ডিএমপির ৩৬ সদস্য গুরুদণ্ড পান। অদক্ষতার মধ্যে রয়েছে তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি, গাফিলতি ও কাজে অবহেলা। এই ধরনের অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন পরিদর্শক (নিরস্ত্র) চারজন, এসআই (নিরস্ত্র) ১৭ জন, সার্জেন্ট একজন, এএসআই (নিরস্ত্র) পাঁচজন, এসআই (সশস্ত্র) একজন, এটিএসআই একজন, নায়েক একজন, কনস্টেবল ছয়জন। মাদক-সংশ্নিষ্টতার অভিযোগে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন ২৬ জন।

মাদক-সংশ্নিষ্টতার মধ্যে রয়েছে মাদক সেবন, কারবার, পরিবহন, মাসোহারা গ্রহণ ও ডোপ টেস্ট। এই অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৮ জন কনস্টেবল, এসআই (সশস্ত্র) দু’জন, এএসআই (নিরস্ত্র) তিনজন, এসআই (সশস্ত্র) একজন ও এসআই (নিরস্ত্র) দু’জন। উৎকোচ নেওয়ার কারণে এক বছরে ডিএমপিতে শাস্তি হয়েছে ২৩ পুলিশ সদস্যের। তাদের মধ্যে কনস্টেবল ছয়জন, নায়েক একজন, এএসআই (নিরস্ত্র) ছয়জন এবং এসআই (নিরস্ত্র) ১০ জন।

এ ছাড়া গত বছর ডিএমপিতে গুরুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ছয়জন, ক্ষমতার অপব্যবহারে ১২ জন, চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ গ্রহণ ও প্রতারণায় ২০ জন, নিয়োগের শর্ত ভেঙে চাকরিতে প্রবেশের কারণে পাঁচজন, আন্তঃবাহিনী সম্পর্কিত অভিযোগে একজনকে। আরও নানাবিধ অভিযোগে শাস্তি হয়েছে ৪২ জনের। তাদের মধ্যে ৪০ পুলিশ সদস্য ও দু’জন নন-পুলিশ। সব মিলিয়ে গত এক বছরে ডিএমপিতে যারা নানা অপরাধে গুরুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন তাদের মধ্যে বরখাস্ত হয়েছেন ৪৪ জন। অপসারিত হয়েছেন আটজন। বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে দু’জনকে, পদোন্নতি স্থগিত করা হয়েছে ৫২ জনের, পদাবনতি ঘটেছে পাঁচজনের, বেতন কাটা হয়েছে ১৮৮ জনের, জ্যেষ্ঠতা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে পাঁচজনের, ইনক্রিমেন্ট স্থগিত হয়েছে তিনজনের ও বেতন গ্রেড নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে একজনের।

ডিএমপির গত এক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্নেষণে আরও বেরিয়ে আসে, এই সময়ের মধ্যে এক হাজার ৫৯৩ জন লঘুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। যাদের লঘুদণ্ড হয়েছে তাদের মধ্যে পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ছয়জন, পরিদর্শক (শহর) ৮৬ জন, এসআই (নিরস্ত্র) ৪১৭ জন, এসআই (সশস্ত্র) ১০ জন, সার্জেন্ট ১৫ জন, টিএসআই পাঁচজন, এএসআই (নিরস্ত্র) ৬৭ জন, এএসআই (সশস্ত্র) ২৬ জন, এটিএসআই আটজন, নায়েক ৩২ জন, কনস্টেবল ৮২১ ও নন-পুলিশ সদস্য তিনজন।
পুলিশের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, ডোপ টেস্টের মাধ্যমে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মাদকাসক্তদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। বারবার বার্তা দেওয়ার পরও যারা মাদক থেকে দূরে সরে আসেননি তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ বলছে, শুধু মাদক নয়, আইনের পোশাক পরে যাতে কোনো সদস্য বেআইনি কাজে জড়িত না হন, সে জন্য বারবার কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে। কেউ ফৌজদারি অপরাধে জড়ালে তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। যদিও অনেক সময় ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, বড় অপরাধে জড়ালেও ছোট সাজায় পার পাচ্ছেন পুলিশের কেউ কেউ। অপরাধে জড়ালে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর কিছুদিন পেরোলে আবার ভালো জায়গায় পদায়ন হচ্ছে- এমন নজিরও রয়েছে।

ছিনতাই চক্রে জড়ানোর পর সম্প্রতি পুলিশের দুই সদস্যের নাম সামনে আসে। তারা হলেন এএসআই মাসুম ও সহিদ। মাসুম নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার থানায় কাজ করতেন। এএসআই সহিদ গেণ্ডারিয়া মিল ব্যারাকে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের (আরআরএফ) সদস্য ছিলেন। এএসআই মাসুম নিজের প্রাইভেটকার নিয়ে ছিনতাই করেন। মাঝেমধ্যে এই অপকর্মে সরকারি অস্ত্রও ব্যবহার করতেন তিনি।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, কনস্টেবলদের শোধরাতে হলে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাহিনীকে যেতে হবে। বিশেষ করে রিক্রুটিংয়ের সময় যাতে কোনো টাকা খরচ না করতে হয় এটা নিশ্চিত করা জরুরি; যেটা পুলিশ এরই মধ্যে শুরু করেছে। অর্থ বিনিয়োগ করে বাহিনীতে ঢুকতে হলে সেই টাকা তোলার জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তার মধ্যে থাকে। এ কারণে অনেকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। প্রশিক্ষণকালে নৈতিক শিক্ষার দিকেও আরও মনোযোগী হওয়া দরকার।

পুলিশে সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ২ লাখ ১২ হাজার। এর মধ্যে প্রায় সোয়া লাখ কনস্টেবল। বাহিনীর একটি বড় অংশ এই পদবির সদস্য হওয়ায় সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশি। তাই কনস্টেবলদের আচরণের সঙ্গে পুলিশের গোটা বাহিনীর সুনামও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ
গত বছরের শেষের দিকে ডিএমপিতে কর্মরত কনস্টেবল, নায়েক ও এএসআইদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ। ওই সময় তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পুলিশের প্রতি মানুষের অনেক প্রত্যাশা বেড়েছে। মানুষের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। তোমার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে পুরো বাহিনীর সম্মান। রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ডিএমপিতে কর্মরত কনস্টেবল, নায়েক ও এএসআইদের উদ্দেশে এ কথা বলেছিলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top