বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জাতিকে ইতিহাস বিকৃতি থেকে রক্ষা করেছে – প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধান প্রতিবেদকঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি প্রকাশ হওয়ার পর দেশ ও জাতি ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে।’
তিনি আজ বুধবার (৭ অক্টোবর) বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ের ব্রেইল সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। সরকারি বাসভবন গণভবনে তিনি এ মোড়ক উন্মোচন করেন।
ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ব্রেইলে প্রকাশ করা হয়েছে যাতে আমাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও পড়তে পারে।
এটি একটি মহৎ উদ্যোগ।’ তিনি জানান, এই বইটি প্রায় ১৪টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। আরও কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো উদ্ধারের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন,‘জাতির পিতা আমাদের মহান স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে তার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় ধীরে ধীরে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছি। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছিল।
আমার মা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন, তিনি যেন তার জীবনীটা লিখে রাখেন। সেই থেকে তিনি লিখতে শুরু করেন এবং যতবার কারাগার থেকে মুক্তি পেতেন, আমার মা জেলগেটে উপস্থিত থেকে আর কিছু না হোক লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন।
‘১৯৭১ সালে এই খাতাগুলো প্রায় হারাতে বসেছিল। সে সময় আমরা এটা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের ধানমন্ডির বাসার সবকিছু পাকিস্তান হানাদার বাহিনী লুটপাট করলেও এগুলো যেহেতু কতকগুলো লাইনটানা নোট খাতা, তাই ওদের নজরে পড়েনি। ওদের কাছে এগুলোর কোনও মূল্য ছিল না। যা হোক একসময় সেটা আমি উদ্ধার করে নিয়ে আসি। পরবর্তী সময়ে আরও দুঃখজনক যে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর আবার আমাদের বাসায় লুটপাট করে। আমি ১৯৮১ সালে ফিরে আসলে প্রথমে আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিল, সে-ই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে খুনিদের বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। আমরা ১৯৮১ সালে ফিরে আসার পর ওই বাড়িতে আমাদের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল, আমি ঢুকতে পারিনি। এটা সিলগালা দেওয়া ছিল, তখন হঠাৎ করে ১২ জুন তাদের কী মনে হলো, বাসাটা খুলে দিলো। আমি যখন বাসায় গেলাম। প্রথমত সেখানে ঢোকা খুব কষ্টকর ছিল। আমি ঢুকতে পারিনি প্রথমে। সেদিন বাসায় ঢুকতে গিয়ে আমি ওখানে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আমি প্রথমেই দেখি খাতাগুলো কোথায় আছে, সেটাই আমার কাছে সব থেকে মূল্যবান ছিল। অন্যকিছু না, এই খাতাগুলো সংগ্রহ করি। কিন্তু এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লেখাগুলো পাইনি, কিন্তু টাইপ করা কতকগুলো কাগজ পেয়েছিলাম যেগুলোর সব পোকায় কাটা, প্রায় অকেজো। এরপর আমি খাতাগুলো খুঁজে বেড়াই। কারণ আমি জানতাম যে, শেখ ফজলুল হক মণির কাছে দেওয়া হয়েছিল টাইপ করতে এবং বই আকারে প্রকাশ করতে। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি বাইরের বাড়িতে খুঁজি। যে টাইপ করেছে যেখানে নাম পেয়েছি, আমি ও আমার বান্ধবী বেবী মওদুদ অনেক জায়গায় খুঁজি। বেবী মওদুদও খুব চেষ্টা করে, কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। আমরা পাইনি। তবে অন্য যে ডায়েরিগুলো ছিল, যেমন– স্মৃতিকথা, চীন ভ্রমণসহ আরও কিছু লেখা সেগুলো সংগ্রহ করি, এর ওপর আমরা কাজ শুরু করি।’
বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো সংগ্রহের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ড. এনায়েতুর রহিম বাংলাদেশে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা করতে। তখন তার সঙ্গে বসে কাজ শুরু করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের যত রিপোর্ট সেগুলো আমি সংগ্রহ করেছিলাম। ফটোকপি করি এবং সেটা আমার কাছে রেখে দিই যাতে ওটার ওপর কাজ এবং তথ্য সংগ্রহ করতে পারি। আমরা যখন স্মৃতিকথা নিয়ে কাজ করছি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে রিয়াজুল কবির সাহেব যখন গবেষণা করছেন এর মধ্যে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার বন্ধ করে দেন এবং এনায়েতুর রহিম সাহেবকে দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করেন। আমি তখন আমেরিকায় যেতাম তার সঙ্গে কাজ করতাম এবং বঙ্গানুবাদ করে সেগুলো বই আকারে প্রকাশ করার ব্যবস্থা নিই। এর মধ্যে তিনি মারা যান। তারপর ডক্টর হারুন, শামসুজ্জামান খান, বেবী মওদুদ ও আমি, আমরা চার জন একসঙ্গে বসে কাজ করতাম। ২০০৪ সালে আমি যখন গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাই ঠিক তার পরপর আমাকে এই খাতাগুলো এসে একজন দেয় সে আমার ফুফাতো ভাই মারুফ। ওর কাছে খাতাগুলো রাখা ছিল। অথচ বারবার ওর বাসায় গেছি, অনেক বার খোঁজ করেছি কিন্তু কখনও সেটা বের করেনি। কী মনে করে সেদিন আমার হাতে দিয়ে গেলো। তারপর সমস্ত কাজ ফেলে অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু খাতাগুলোর কিছু কিছু পাতা তো একেবারেই ছিন্ন-জীর্ণ অবস্থায় ছিল। আমি আর বেবী মওদুদ বসে এটা নিয়ে দিনের পর দিন কাজ করেছি। সেগুলো উদ্ধার করতে খুব কষ্ট হয়েছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দিয়ে সেগুলোকে ফটোকপি করে নোট আকারে স্কান করে বের করে অনেক চেষ্টা করে এগুলো আমরা তৈরি করি। এরপর আমরা এই খাতাগুলো প্রকাশ করি এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনী নামটা রেহানারই (শেখ রেহানা) দেওয়া ছিল। আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এই নাম দিয়ে প্রকাশ করবো। এই বইয়ের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার জীবনী গাঁথা আছে, পাশাপাশি তার সংগ্রামের অনেক কথা আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তথ্য এখানে পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে আমি ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টগুলো প্রকাশ করি। ইতোমধ্যে ছয় কপি ছাপা হয়ে গেছে। আরও সাত-আট কপি আমাদের কাছে এখনও আছে, সেগুলো দেখে দিলে ছাপা হবে। এর মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাসটা বের হয়ে আসবে। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয় জাতির পিতার লেখা কারাগারের রোজনামচা। এই কারাগারের রোজনামচা নামটাও রেহেনার দেওয়া। ৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পর জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখার সময় তিনি এই ডায়েরিটা লেখেন। বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণ করতে গিয়েছিলেন ৫২ সালে একটা শান্তি সম্মেলনে। নয়া চীনে সেই কথা লিখেছেন। ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার অবস্থায় তিনি এই লেখাটা লিখেছিলেন। প্রতিটি খাতার ওপর যেহেতু জেলখানায় সেন্সরশিপের সিল এবং স্বাক্ষর রয়েছে, সেখান থেকে আমরা খোঁজ করে করে বের করেছি।’
‘এসব প্রকাশের মাধ্যমে জাতির পিতার জীবনীর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়, কীভাবে আমরা একটা স্বাধীন জাতি হতে পেরেছি– এইসব ইতিহাস জানার সুযোগ রয়ে গেছে। যেসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পড়াশোনা করে আমরা তাদের বিনা পয়সায় বই বিতরণ করি। আমরা এখন তাদের বইও ব্রেইল আকারে প্রকাশ করা শুরু করেছি। আজকে ব্রেইলে বই প্রকাশ করার ফলে আমাদের সমাজের একটা মূল্যবান গোষ্ঠী যারা পড়াশোনা করছে, তারাও ইতিহাসটা জানার সুযোগ পাবে। তারাও যে আমাদের একজন, সেটাই আরও একবার প্রমাণিত হলো। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এটি রাখা গেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সংগ্রহ করে পড়তে ও জানতে পারবে।’
প্রধানমন্ত্রী আবারও দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব। সে লক্ষ্যে সর্বস্ব উজার করে কাজ করবো।’