তোফায়েল আহমেদ – যে বেদনা চিরদিন বইতে হবে
তোফায়েল আহমেদ
১৯৭৫-এর ১২ সেপ্টেম্বর আমাকে যখন ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে (যেখানে ফাঁসির আসামিদের রাখা হয়) নিয়ে গেলো তখন আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমি স্বর্গে এসেছি। এটা আমার জন্য বেহেশত। যেখানে ফাঁসির আসামিকে রাখা হয় সেখানে সূর্যের আলো-বাতাস অনুভব করা যায় না। কারণ, ১৫ আগস্টের বিভীষিকাময় দিনটির শুরু থেকেই আমার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তাতে আমি না পারি হাঁটতে, না পারি দাঁড়াতে। আমার অবস্থা ছিল এতটাই করুণ।
১৫ আগস্ট থেকেই খুনিচক্র আমাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। গৃহবন্দি অবস্থায় ঘাতকের দল আমার ওপর তিনবার ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। ১৭ আগস্ট মেজর শাহরিয়ার (যার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) ও ক্যাপ্টেন মাজেদ (সম্প্রতি যার ফাঁসি হয়েছে) এই দু’জন বাসা থেকে টেনেহিঁচড়ে আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। আমার মা তখন বেহুঁশ। সেখানে আমার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। ১৮ আগস্ট আমার বাসায় তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন (তখন মেজর ছিলেন), আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং গোপন কিছু কথা বলেন। তারা চলে যাওয়ার পর আমার ওপর খুনিচক্রের নির্যাতন বেড়ে যায়। যে কথা শাফায়েত জামিল তার বইতে লিখেছেন এবং ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াতও তার বইতে উল্লেখ করেছেন যে আমার ওপর কী ধরনের অত্যাচার হয়েছে। ২৩ আগস্ট আমাকে এবং জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে খুনি মোশতাকের কাছে ই এ চৌধুরী নিয়ে যান। ই এ চৌধুরী তখন ডিআইজি এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান। সেখানে আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং খুনি খোন্দকার মোশতাক সরকারকে সমর্থনের জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। আমরা যখন কিছুতেই রাজি হইনি, তখন খুনি মোশতাক ভীতি প্রদর্শন করে ইংরেজিতে You are waking on grave. If somebody enter your house and killed you, nobody will take responsibility. খুনি সরকারের সপক্ষে সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আমাদের বাসভবনে ফিরিয়ে দেয়। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। আমি, জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই (প্রয়াত শ্রদ্ধেয় নেতা) ও আবিদুর রহমান (তৎকালীন ‘দ্য পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক)-এই চার জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রাখে। সেখানে প্রায় ৩০ জন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পুলিশ কন্ট্রোল রুম ঘিরে রাখে। প্রত্যেক দিন আমার ওপর সেনা সদস্যরা দুর্ব্যবহার করে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের বন্দিদশা থেকেই একদিন খুনিচক্র আমাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেদিন রাতে আমি এবং রাজ্জাক ভাই একটি কক্ষে একসাথে ঘুমাচ্ছিলাম। জিল্লুর রহমান ও আবিদুর রহমান আরেকটি কক্ষে ছিলেন। হঠাৎ একদিন রাত তিনটার দিকে মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার আমাদের কক্ষে ঢুকেই চিৎকার করে বলে, ‘হু ইজ তোফায়েল’, ‘হু ইজ তোফায়েল’। রাজ্জাক ভাই আমার আগে জেগে ওঠেন এবং আমাকে দেখিয়ে দেন। আমাকে দেখেই তারা আমার বুকে স্টেনগান চেপে ধরে। চোখের সামনে মৃত্যু উপস্থিত বিধায় সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে বলি, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…।’ মৃত্যু তখন সন্নিকটে। আমি ওজু করার জন্য তাদের নিকট অনুরোধ করি। পাশেই বাথরুম ছিল। সেখানে আমাকে ওজু করতে দেয়। ওজু করে আসার পর খুনিরা আমার চোখ বাঁধে। আমি সহবন্দিদের কাছ থেকে বিদায় নিই এবং ভাবি আজই আমার শেষদিন। তারপর বারান্দায় নিয়ে আমার দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধে। এরপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কোথাও নিয়ে যায়। অনুমান করি এটি রেডিও স্টেশন। পরে জেনেছি স্থানটি রেডিও স্টেশনই ছিল। সেখানে নিয়ে আমার হাতের বাঁধন খুলে চেয়ারের সাথে বেঁধে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়। চোখবাঁধা থাকায় ইন্টারোগেশনকালে কারা প্রশ্ন করেছিল বুঝতে না পারলেও খুনি ডালিমের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট চিনতে পেরেছি। ডালিম বলছিল, ‘শেখ মুজিব মেজর ডালিমকে ভালোবাসতো। কিন্তু শেখ মুজিব আমাকে আর্মি থেকে ডিসমিস করেছে।’ ‘Sheikh Mujib he is to loved Dalim very much, but he has been dismissed me from the army and Mr. Tofail you…’ বলেই সে বাঁ হাত দিয়ে আমাকে ঘুষি মারতে থাকে। তার ডান হাত নষ্ট ছিল। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। সে যে বাম হাত দিয়ে ঘুষি মেরেছে আমি তা অনুমান করি। এরপর শুরু হয় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধুর ফান্ড ছিল আমার কাছে, রক্ষীবাহিনী, রক্ষীবাহিনীর অস্ত্র এসব বিষয়াদি নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন করা হয়। একপর্যায়ে তারা আমাকে রেখে নিজদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে যে, আমাকে কী করবে? পরে অনেক প্রশ্ন করে খুনিরা আমাকে বলে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে। কোথায় শেখ মুজিবের ফান্ড, কোথায় আমার অস্ত্র গেছে ইত্যাদি। খুনিরা আমায় বলে, ‘তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সে ৬০ পৃষ্ঠার স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সেখানে লেখা আছে তুমি কাকে কাকে অস্ত্র দিয়েছো। রক্ষীবাহিনীর ওখানে (রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে) গিয়ে তুমি পাল্টা কিছু করতে চেয়েছিলে।’ ///////সেদিন ১৫ আগস্টের সকালে যখন রেডিওতে ডালিমের কণ্ঠস্বর শুনলাম তখন আমি সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব, ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব সকলের সাথেই টেলিফোনে কথা বলেছি। খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মনোবল নিয়ে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে গিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এতোটাই প্রতিকূলে ছিল যে কিছুই করা সম্ভবপর হয়নি। কারণ খুনিচক্রের ষড়যন্ত্রের জাল ছিল কঠিন এবং তা ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এক বহুবিস্তৃত নীলনকশা! মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রক্ষীবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে যখন গিয়েছি তখন চারপাশে ১৪টি ট্যাঙ্ক। রক্ষীবাহিনীর গোলাবারুদ ওখানে থাকতো না। সে-সব গোলাবারুদের কোত্ ছিল বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ক্যাম্পে অর্থাৎ পিলখানায়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান তখন বিডিআর-এর ডিজি। তিনি কোনোরকম সহযোগিতা করেননি। অস্ত্র না পেলে তো কিছু করা যাবে না। অপরদিকে সাভারে সেখানে ২০০০ আন্ডার ট্রেনিং রক্ষী ছিল। কিন্তু সাভারে ব্রিজের উপর ট্যাঙ্ক বহর অবস্থান নেওয়ায় কেউ যেতেও পারেনি আসতেও পারেনি। অর্থাৎ সবদিক থেকেই আমরা অবরুদ্ধ। রক্ষীবাহিনীর দুই উপ-প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ ও সারোয়ার হোসেন মোল্লা প্রতিরোধের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য পায়নি। ষড়যন্ত্রকারী খুনিচক্র এতটাই নিখুঁতভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে যে আমরা ছিলাম নিরুপায়। রক্ষীবাহিনীর সদরদফতরে আমার উপস্থিতি জানাজানি হলে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ওখান থেকেই সিটি এসপি সালাম সাহেব প্রায় ৫০ জন পুলিশ নিয়ে আমাকে গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করে রাখে। রক্ষীবাহিনীর উপপ্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কিন্তু বাঙালি জাতির দুর্ভাগ্য যে শোকে মুহ্যমান জাতীয় নেতারা (রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত) জাতির এই কঠিন সময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি।’ (পৃষ্ঠা-১৪৯)।
বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার্থে আমি চেষ্টা করেছি সে কথা আমি কখনও বলি না। কারণ আমরা কিছু করতে পারিনি; জাতির পিতাকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। বিষয়টি নিছক ব্যক্তিগত নয়, এটি আমাদের জাতীয় ব্যর্থতাই বটে!
এরপর আসে বিভীষিকাময় ১০ সেপ্টেম্বরের রাত। তখন রোজা। শাহবাগস্থ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বন্দী। আমি তারাবির নামাজ পড়ে রাজ্জাক ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে ছিলাম। গভীর ঘুম। সেখান থেকে খুনিচক্র আমাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর সেই একই প্রশ্ন। কোথায় কাদের কাছে অস্ত্র ডিসট্রিবিউট করেছি, আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি ৬০ পৃষ্ঠার স্টেটমেন্ট ও নানারকম তথ্য দিয়েছে। আমি কাকে কাকে অস্ত্র দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর টাকা-পয়সা কোথা থেকে আসতো, কিভাবে দিতো। আর্মির লোকজনের সাথে বিশেষ করে কর্নেল র্যাংকের নিচে কারো সাথে আমি দেখা করতাম না। বড় বড় অফিসার কোথায় তারা এখন। তারা কি তোমাকে হেল্প করতে পারে? এরপর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ শারীরিক নির্যাতন। খুনিরা আমাকে টার্গেট করেছিল। আমার তখন হুঁশ নেই। আমি তাদের সোজাসাপ্টা একটি কথাই বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর ভালো কাজের সাথে আমি যেমন জড়িত, যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে তবে তার সাথেও জড়িত। এর বেশি আর আমি কিছু বলতে পারবো না।’ খুনিরা যখন নির্যাতনে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি দেয় তখন অজ্ঞাত একজন মানুষ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে খুব করুণ কণ্ঠে চাপাস্বরে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন, আল্লাহ আল্লাহ করেন।’ তার মনে হয়েছিল মৃত্যু আমার অবধারিত। সন্ধ্যার সময় খুনি মেজর শাহরিয়ার আসে। একগাদা লিখিত প্রশ্ন আমাকে দিয়ে বলে, ‘এর উত্তর দিতে হবে।’ আমার তখন হুঁশ নেই, আমি আধমড়া। এই বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দিয়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি। তখন রাজ্জাক ভাই, জিল্লুর ভাই আমার শুশ্রুষা করেন। কিছুক্ষণ পর যিনি আমাকে গ্রেফতার করেছিলেন, সেই সিটি এসপি সালাম সাহেব ডাক্তার নিয়ে আসেন। সন্ধ্যার দিকে আমাকে, আবিদুর রহমান, রাজ্জাক ভাই এবং জিল্লুর ভাই-এই চারজনকে সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের নাম-ধাম লিপিবদ্ধ করে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ আমাদের চারজনকে জেলগেটে নিয়ে আবিদুর রহমান এবং আমাকে ময়মনসিংহ এবং রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে প্রেরণ করে।
ময়মনসিংহ কারাগারে ১২ তারিখ সকালের দিকে পৌঁছাই। তখন আমার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমাকে আর আবিদুর রহমানকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখে। এক রুমে দু’জন থাকার নিয়ম নেই। হয় থাকতে হবে তিনজন নয় একজন। গভীর রাতে জেল সুপার, জেলার এবং সুবেদার আলী আহমদ এসে কনডেম সেলে যারা অন্য আসামি ছিল তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেন। এখানে আমি প্রায় ৫ মাস সূর্যের আলো দেখিনি। এই কনডেম সেলেই ফাঁসির আসামির মতো আমার জীবন কেটেছে। জেলাখানার নিয়ম-কানুন মেনে চলতাম। এখন তো কারাগার অনেক উন্নত হয়েছে। তখন এতো উন্নত ছিল না। উন্নত বাথরুম ছিল না। আবিদুর রহমান সাহেব আমার জেলসঙ্গী ছিলেন। তিনি কবিতা লিখতেন। আমিও ডায়েরি লেখার চেষ্টা করতাম। ঈদের দিন জেলখানায় সকলকে সেল থেকে বেরুতে দেয়। সকলেই নামাজ পরে এবং খোলা অবস্থায় থাকে। যখন ঈদের দিন সুবিধা দিলো তখন আগের ওই কনডেম সেলের ফাঁসির আসামির মধ্য থেকে পাঁচ জন জেল থেকে পালিয়ে যায়। আমি আর আবিদুর রহমান ছাড়া আর সবাই স্বাধীনতা বিরোধী এবং অন্যান্য আসামি। তখনই যারা আগে কনডেম সেলে ছিল তাদেরকে আবার কনডেম সেলে নিয়ে এসে আমাকে ওয়ার্ডে দেয়। সেই ওয়ার্ডে আমরা অনেকেই ছিলাম। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অর্থাৎ ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘জেলখানার সম্বল, থালা-বাটি-কম্বল।’ আমাকে দিয়েছে দুটো কম্বল। একটি বিছানার, আরেকটি গায়ে দেওয়ার; সেইসাথে একটি থালা ও বাটি। এই ছিল আমার জেলখানার সম্বল। তখনও আমি এমপি। এমপি পদ যায়নি, কিন্তু ডিভিশন দেয়নি। ডিভিশন আসে অনেকদিন পর। ডিভিশন পাওয়ার পর আমি ওয়ার্ডে গেলাম। সেখানে পেলাম জনাব আবদুল হামিদ সাহেবকে (বর্তমান রাষ্ট্রপতি)। তিনি গ্রেফতার হন ২০ মার্চ ১৯৭৬-এ। তাঁকে গ্রেফতারের পর প্রথমে আর্মি ক্যাম্প, পরে পুলিশ ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ডিভিশন পাওয়ার পর আমরা অনেকেই একসাথে থাকি। সেখানে ছিলাম আমি, আবিদুর রহমান, আব্দুল হামিদ, জাতীয় নেতা রফিক উদ্দিন ভূইয়া, সাবেক ধর্ম মন্ত্রী ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান, শেরপুরের নিজামউদ্দীন এমপি, আব্দুস সামাদসহ শেরপুরের অনেকে। এছাড়াও মেম্বার ওয়াদুদ, আব্দুল হামিদ, মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু মিয়া এমপিসহ কিশোরগঞ্জের বহুনেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের ছোটো ভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু ভাই, সিপিবি’র নেতা অধ্যাপক যতীন সরকার এবং ন্যাপ নেতা আব্দুল বারী-যিনি ছিলেন খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের আপন ভাগনে-তিনিও আমাদের সাথে ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী ছিলেন। নেত্রকোনার খসরু, ফজলুর রহমান, সাফায়েত, ন্যাপ নেতা অলোক ময়নাহা, এরকম ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গার অসংখ্য নেতাকর্মী আমাদের সাথে বন্দী ছিলেন। কারাগার ভর্তি শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ’৭৬-এর ৩১ আগস্ট জিয়াউর রহমানের এক আদশে স্বাধীনতা বিরোধী যারা হত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ করেছে-বঙ্গবন্ধু ক্ষমা প্রদর্শনের পরে এরা সবাই কারাগারে ছিল-তাদের সকলকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু দালাল আইনে তাদের আটকাদেশ দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করেছিল। যারা কোলাবরেটের তারা কারাগারে ছিল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আমাদের নেতাকমীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করা শুরু করলে পর্যায়ক্রমে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বেরুনোর পালা শুরু হয়। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে ৩১ ডিসেম্বর জেলখানা খালি করে দেয় এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কারাবন্দী করে।
এই ময়মনসিংহ কারাগারেই ৩ নভেম্বর জেলহত্যার সংবাদ পাই। কারাগারের জেল সুপার তখন নির্মলেন্দু রায়। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে বন্দী তখন তিনি ডেপুটি জেলার ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেকবার তিনি গণভবনে দেখা করতে এসেছেন। আমি তখন তাকে দেখেছি। নির্মলেন্দু রায় আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই জেলখানায় এক মেজর সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু রায় তাকে ঢুকতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে ঢুকতে দিবো না।’ যেটা ঢাকা জেলখানায় করেনি। আমার ক্লাসমেট ছিল ওদুদ। ওদুদ তখন এসডিপিও তথা সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার। যার ’৭৩ ব্যাচে চাকরি হয়। সে প্রায় ৩০/৪০ জন পুলিশ নিয়ে জেলখানা ঘিরে রেখেছিল। যার জন্য সেই মেজর সেদিন ময়মনসিংহ কারাগারে ঢুকতে পারেনি। ইতোমধ্যে ঢাকায় জেল হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কারাভ্যন্তরে নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ময়মনসিংহের তৎকালীন এসপি রাত্রিবেলায় জেলখানায় আসেন আমাকে জেল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ জেলখানায় আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু আমি যাইনি। আমাকে প্রোটেকশন দেওয়ার কারণে পরবর্তীকালে নির্মলেন্দু রায়কে বদলী করে ফরিদপুরে পাঠানো হয়। আর এসপিকে ময়মনসিংহ থেকে বদলী করে ওএসডি করে রাখে। এই দু’জন মানুষের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
ময়মনসিংহ কারাগারে থাকাকালে আমার জীবনে অনেক দুঃখের ঘটনা ঘটে। হঠাৎ একদিন শুনতে পাই, মাইকে ঘোষণা করছে যে, শফিকুল ইসলাম মিন্টু নামে কোনও বন্দী আছে কিনা? অর্থাৎ আমার এপিএস শফিকুল ইসলাম মিন্টু; আমাকে বন্দী করার পর তাকে গ্রেফতার করে আমার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করে খুনিচক্র। কিন্তু সে সম্মত না হওয়ায় হত্যা করে তার লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। তার মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। তখন তাঁকে খোঁজার জন্য কারাগারে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই কারাগারেই ‘৭৫-এ ৫ অক্টোবর আমার মেজো ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাই। তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ফজরের নামাজ পড়ে দিনের বেলা যখন ঘুমাই তখন আলী আহমদ সুবেদার আমাকে জাগিয়ে বলেন, ‘উঠেন উঠেন, আপনার সাক্ষাৎ আসছে।’ অর্থাৎ আমার স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে-ডা. তসলিমা আহমেদ মুন্নি-এবং চাচাত ভাই ওদুদ আমাকে দেখতে ময়মনসিংহ কারাগারে এসেছে। ওদের সঙ্গে সাক্ষাতের শুরুতেই জিজ্ঞাসা করি মেজো ভাইয়ের খবর কী? তখন আমার স্ত্রী বলেন, ‘এসব কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা আলাপ করো।’ হঠাৎ ক্লাস টু-তে পড়ুয়া আমার ছোট্ট মেয়েটি বলে, ‘আব্বা, কাকুকে তো মেরে ফেলেছে!’ আমার মেজো ভাই আলী আহমেদ, ঈদের আগের দিন বাড়ির কাছে গ্রামের হাটে বাজার করতে গিয়েছিল। তখন খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ লোক নিয়োগ করে মেজো ভাইকে বাজারের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। আমার মায়ের জীবনটা ছিল খুবই কঠিন। কারণ, মেজো ভাইয়ের মৃত্যুর ৩ মাস আগে ‘৭৫-এর ১১ জুলাই আমার বড় ভাই চিকিৎসধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন ঢাকার (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) পিজি হাসপাতালে। বঙ্গবন্ধু তখন ধানমন্ডির বাসভবনে এসে আমার ভাইয়ের জানাজা করলেন, এয়ারপোর্টে নিজে গেলেন ও হেলিকপ্টারে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ ভোলায় পাঠালেন। আমি যখন ১৫ দিন ভোলাতে ছিলাম, প্রতিদিনই তিনি আমাকে ফোন করতেন। আজকের মতো তখন ফোন এতো সুলভ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আমি যেন প্রতিদিন ১১টার সময় ভোলার থানায় গিয়ে বসে থাকি। ঠিক ১১টার সময়ই প্রত্যেকদিন আমাকে তিনি ফোন করতেন। শেখ জামাল ও শেখ কামালের বিয়ের দিনও ফোন করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবাই আছে শুধু তুই নাই। তোর কথা শুধু মনে পড়ে।’ এতবড় মহান নেতা ছিলেন তিনি। আমার মায়ের তখন করুণ অবস্থা। আমরা তিন ভাই। বড় ভাই মারা গেলেন ১১ জুলাই, মেজো ভাই মারা গেলেন ৫ অক্টোবর আর আমি কারাগারে। মায়ের সেই বেদনাবিধুর কষ্ট আমি আজ লিখে বোঝাতে পারবো না। যে সরকারি বাড়িতে ছিলাম ১৫ দিনের মধ্যেই সেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। সে-সময় আমার স্ত্রীকে মানুষ বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি। কারণ আমার স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে তাদের ক্ষতি হবে। আমার ভাগনি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থাকতেন। পরিবারের সকলেই তখন সীমাহীন কষ্ট করেছে।
ময়মনসিংহে দীর্ঘদিন কারানির্যাতন ভোগের ২০ মাস পর ‘৭৭-এর ২৭ এপ্রিল যে দিন শেরেবাংলার মৃত্যুবার্ষিকী ওইদিন আমাকে ট্রেনে করে কুষ্টিয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রথমে আমাকে আইসলোশনে রাখা হয়। কুষ্টিয়া কারাগারে সহকারাবন্দী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সরদার আমজাদ হোসেন, সেদিনের জাসদ নেতা শাজাহান খান এবং বরিশালের ছাত্রলীগ নেতা ফারুক। দুই ছেলে হারানো আমার মা তাঁর বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলেটিকে দেখতে বৃদ্ধাবস্থায় অসুস্থ শরীরে কুষ্টিয়া কারাগারে যেতেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে কপালে চুমু খেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিদায় নিতেন। আমার স্ত্রী আমাকে দেখতে আসার পথে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। তার মাথায় ১৪টি সেলাই লাগে। অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে ২ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন। আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী (যিনি আমার স্ত্রীর নিকট থেকে মাত্র ১ টাকা ফি নিয়েছিলেন) অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রীর পিতা) আদালতে বলেন, ‘তাঁর আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং ১৯৭৫ সালের জরুরি ক্ষমতা আইনের আওতায় তাঁর আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার মতো কোন তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। ফলে উক্ত আটকাদেশ অবৈধ ও আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত।’ রাজ্জাক ভাই এবং আমার একসাথে রিট হয়। রাজ্জাক ভাই হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাইনি। অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে মুক্তি পেলাম ৪ মাস পর অর্থাৎ ‘৭৮-এর ১২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাসসহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি লাভ করি। কুষ্টিয়া কারাগারে যখন বন্দী তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় এবং কারাগারে আটকাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে নেওয়ার আগে ময়মনসিংহ কারাগার থেকে ৮ মাস পর আব্দুল হামিদকে প্রথমে কুষ্টিয়া কারাগারে, পরে কুষ্টিয়া কারাগারে যখন আমাকে নিয়ে গেলো তখন তাকে রাজশাহী কারাগারে পাঠায়। রাজশাহী কারাগার থেকে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আনার পর তিনি মুক্তি লাভ করেন ‘৭৮-এর প্রথম দিকে। আর আমাকে কখনই কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়নি। কুষ্টিয়া কারাগারের ১৩ মাসে অনেক উত্থান-পতন দেখেছি। এই জেলে বসেই প্রত্যেক রাতেই আমি চিৎকার শুনতাম। ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া কারাগারে থাকাকালে ফাঁসির আসামীদের কান্না শুনেছি।
আমি কখনও ভাবিনি যে বেঁচে থাকবো। বঙ্গবন্ধুর স্নেহ-আদর-ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন। পৃথিবীর যেখানে গিয়েছেন, বাংলাদেশের যেখানে গিয়েছেন আমাকে সঙ্গী করেছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে অফিসে যেতাম। আবার রাতে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম। যেদিন ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাসায় পৌঁছে দেই এবং বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, ‘কাল সকালে আসবি। তুই ডাকসুর ভিপি ছিলি। তুই আমার সাথেই ইউনিভার্সিটিতে যাবি।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা ও কথা! পরদিনের পরিস্থিতি এমন হতে পারে তা ছিল কল্পনাতীত! তবুও ভাবি, যাহোক আমি তো বেঁচে আছি। কিন্তু সারাজীবন মনের গভীরে এই দুঃখ থেকে যাবে, যে মহান নেতা জাতির পিতা পরম মমতা-স্নেহ-আদর-ভালোবাসায় সিক্ত করে সর্বদা ছায়া দিয়ে নিজের সঙ্গে রেখেছেন-যার স্নেহ-আদর-ভালোবাসা আমার জীবনে পাথেয়-তাঁর মৃত্যুতে কিছুই করতে পারিনি, বেদনার এই অবিরাম ভার আমাকে চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে!
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদ।
tofailahmed69@gmail.com