ডাঃ মৌমিতা দেবনাথ – শাহানা সিরাজী
মৌমিতার মা হয়ে তাকে হারানোয় যেমন আমরা ব্যথিত তেমনি সেই কুলাঙ্গারদের মা হয়ে আমরা তাদের ফাঁসি চাই।
মৌমিতা।
ডাঃ মৌমিতা দেবনাথ, গত ৯ আগস্ট ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কলকাতা শহরের একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে ৩১ বছর বয়সী মৌমিতার রক্তাক্ত ও বিভৎস লাশ উদ্ধার করা হয়। কী বিভৎস দৃশ্য! কী লোমর্ষক সে কাহিনী! সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মানুষ এমন আচরণ করতে পারে? তারা পেরেছে। ইনডিয়ান সাংবাদিক ময়ূখ কী তার আন্ত:নগর এক্সপ্রেস চালাচ্ছেন এখন!
মৌমিতা ভারতের।
তা ভারত হোক কিংবা পাকিস্তান বাংলাদেশে কিংবা আফগানিস্তানের ইজরাইল -গাজা -ইরান -আমেরিকা কিংবা লন্ডন যেখানেই জন্ম নিক। নারীর প্রথম পরিচয় নারী। নারীর বাঁচার অধিকার আছে, নিরাপদে চলাচলের অধিকার আছে, কাজের-পড়ার- লেখার- কথা- বলার অধিকার আছে। এ অধিকারগুলো জন্মগত। কেউ কাউকে দিতে হয় না। বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ নারী দিবস পালন করা হয় । এ নারীঅধিকার দিবস পালন করা হয় নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য সচেতনতা তৈরির জন্য।
এ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য – ‘নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। যেখানে নারীর বাঁচার অধিকার ছিলো না সেখান থেকে এখন নারীকে কাজে নিয়োগ করার জন্য যেখানে মানুষ এগিয়ে এসেছে সেখানে ভারতের মতো দেশে এক শিক্ষিত নারীরকে এমন নির্যাতন এটা ভাবা যায় কী?
২০২৪ সালে এসে যদি কোন পুরুষকে তার কামনা চরিতার্ করার জন্য ধর্ষণ করতে হয় তাহলে তাকে মানুষ বলা যাবে? মৌমিতার সাথে যা হয়েছে তা কী সভ্য সমাজ করতে পারে? এর আগেও দেখেছি ভারতে চলন্ত গাড়িতে নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছে । একই কায়দায় আমাদের এখানেও সাভারে চলন্ত গাড়িতে নারী নির্যাতন হয়েছে। আইনের শাসন আমাদের দেশে ছিলো না। তাই টাকার বিনিময়ে অনেক অপরাধী পার পেয়ে যায়। ভারতেও কী আইনের শাসন নেই? কেন একজন নারী সে হোন রাস্তার “ফেলানী” কিংবা ডাক্তার নারী এ ভাবেই মার খাবে?
অত্যাচারীর দলে নাকি এক নারীও ছিলো? সে নারীর কী পুরুষের মতো দন্ড ছিলো? রাগ কিংবা প্রতিহিংসা এতো ভয়ানক যার সে নিজেকে শিক্ষিত কী ভাবে দাবী করে? ধিক! ধিক! সে নারীকে!
নারীর জিঘাংসায় দেশ পুড়ে যায়, মানুষ পুড়ে যায়, নারীর মায়ায়ই আবার মানুষ প্রাণ ফিরে পায়।
বৈচিত্র্যময় অন্তরের মালিক নারীটি কেন এতো নৃশংস আচরণ করলো? ওই পুরুষগুলো কী ভাবে তোরা দানব হলি? তোরা কী একবারই ঢেলে শেষ? আর লাগবে না ঢালা? তাহলে প্রতিদিনই তোরা এক এক জন নারী,হোক ইন্টার্ন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার,ফিলোসোফার ধরে ধরে খুন করবি।
তীব্র নিন্দা জানাই। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই
মৌমিতা আমার সন্তান। পৃথিবীর সকল নারীর সন্তান মৌমিতা। একজন শ্রান্ত -ক্লান্ত ইনটার্ন ডিউটিরত ডাক্তার যে বিশ্রাম নিতে গিয়েছে তার দেহে শরীরে ১১৩ টা কামড়ের দাগ, ১৫০ গ্রাম রক্ত ও বডিলি ফ্লুইড মিশ্রিত সিমেন (বীর্য) পাওয়া গেছে। একজন পুরুষ যদি প্রতিবার ইজাকুলেশনে ৩-৫ গ্রাম সিমেন দেয় তার মানে মেয়েটার শরীরের ১৫০ গ্রাম সিমেনে তাকে নিম্নে ৩০বার ধর্ষণ করা হয়, গ্যাং-রেপ যাকে বলে। ধর্ষণের পর পেলভিকবোন ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো।
মৌমিতার চোখ দিয়ে পানি আসেনি, রক্ত বের হয়েছিলো। গ্যাং-রেপ করার সময় তার দুপাশ থেকে যে হাত বেঁধে রেখেছিলো, সেও একজন মেয়ে ছিলো। তার ফিমেল কলিগ। কতোটা ঘৃণা করলে একজন মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়ের সাথে এতো নৃশংসতা হতে দেওয়া যায়?
অবাক হলাম ভারত সরকার আমাদের দেশ নিয়ে যত কনসারন হল, তার দেশে নারীর নিরাপত্তা দিতে ততোই ব্যর্থ হলো। ‘র বাংলার’ ময়ূখ যে ভাবে আমাদের দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে শুধু নাক নয় মুখ ঠোঁট সব নিয়ে সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা লাগানোর জন্য আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের মতো মিথ্যাচার করছেন তেমনি মৌমিতা বা নারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন? তাঁর মতো এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদানকারী সাংবাদিক মৌমিতা হত্যার বিচার নিশ্চিত করবেন বলে আশা রাখি।
ভারতীয় চিকিৎসকরা শুক্রবার বলেছেন, তাদের এক সহকর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যা করায় তারা দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও ধর্মঘট আরো জোরদার করতে যাচ্ছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড যা নারীর প্রতি সহিংসতার দীর্ঘস্থায়ী ইস্যুতে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে।
আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
নয়াদিল্লিতে সরকার পরিচালিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সস (এআইআইএমএস) হাসপাতালের চিকিৎসক শুভ্রঙ্কর দত্ত বলেছেন, ‘আমরা আমাদের সহকর্মীর বিচার দাবিতে আমাদের প্রতিবাদ জোরদার করছি।’
এমন নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার বেশ কয়েকটি রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য’ কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ব্যবস্থায় একাধিক মেডিকেল ইউনিয়ন ধর্মঘট সমর্থন করেছে।
এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানাতে বুধবার রাতভর কলকাতার রাস্তায় হাজার হাজার মিছিল করেছে এবং এর পাশাপাশি মধ্যরাতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে
ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের শুরু হয়।
ভারতের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) সমাবেশ করেছেন নারী শিক্ষার্থীরা।
আজ শুক্রবার বিকেলে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘আওয়াজ তোলো নারী’ ব্যানারে সমাবেশ করেন একদল নারী শিক্ষার্থী।
সমাবেশ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে ধর্ষকেরা বেঁচে যায়। রাষ্ট্র নারীকে ভালো চোখে দেখেনি। ধর্ষক ধর্ষকই, ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভারতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের সংহতি।’
সমাবেশে ঢাবির নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহমি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা-ভিডিও এগুলো ফেসবুকে প্রচার হয় ঠিকই, কিন্তু ধর্ষকের শাস্তি জনসমক্ষে দেওয়া হয় না। আমাদের ধর্ষকদের ব্যাপারে কিছুই জানানো হয় না। বরং গত ১৫ বছর যাবৎ ক্ষমতাসীনরা ধর্ষকদের আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশের আইন ফোর্সের স্বাধীনভাবে বিচার করার মতো স্বাধীনতা নেই। টাঙ্গাইলে গোলাম কিবরিয়া নামে একজনকে ধর্ষণের দায়ে কেবল দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এমসি কলেজে ধর্ষণের ঘটনায় ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়, সকলেই ছাত্রলীগ কর্মী, তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ষণের আজকের যে বয়ান তা পুরুষ বনাম নারী না। বরং রাষ্ট্র বনাম নারী বয়ান। নারীর নিরাপত্তাকে তারা কখনো অগ্রাধিকার দেয়নি, দিলে যেকোনো ধর্ষণ মামলা দায়েরের পর তাদের তৎপরতা দেখা যেত।’
অবিলম্বে সব ধর্ষণের সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন ফাহমি।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, ‘আইন নিয়ম-নীতি আগেও শক্ত ছিল। তবে এর ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আইনের যথাযথ প্রয়োগ চাই। বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মেয়েরা স্বৈরাচার উৎখাত করেছে। তাঁরা কি সামান্য নিরাপত্তা পেতে পারে না? সরকারের কাছে সেই নিরাপত্তা চাই।’
সমাবেশে শিক্ষার্থীরা—‘তনু থেকে মৌমিতা, কুমিল্লা থেকে কলকাতা; ধর্ষকের সাজা একটাই, মৃত্যু ছাড়া কথা নাই; জাস্টিস ফর মৌমিতা; স্টপ রেপ; এই
অসুরদের জন্য মানবিকতা নয়, আমার মানবিকতা মৌমিতা-তনুদের সাথেই মরে গেছে; আওয়াজ তোলো নারী’ ইত্যাদি ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদ জানান।
আমিও আমার দেশের সকল নারী বাংলাদেশ থেকে তীব্র নিন্দা, ঘৃণা ও সংহতি প্রকাশ করছি। নারীর জন্য সহিংসতা বন্ধ করো। কোন নারীই আলাদা নয়, ঘরে যেমন মা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বাইরে আমরা কর্মজীবীরা কেউই নির্যাতনমুক্ত নয়।
আমাদের তনু থেকে কলকাতার মৌমিতা কেউই আলাদা না। আমরা সবাই এক। হয়তো বার বার হেরে যাই সরকারী প্রশাসনের কাছে। তবু চাইবো তনু থেকে মৌমিতা পর্যন্ত প্রতিটা ধর্ষকের বিভৎস মৃত্যু হোক। যদি আইনের ফাঁক-ফোকর গলে এসব বিকৃত মস্তিষ্কের লোকেরা বেরিয়ে যায় তবে সে আইন বাতিল করে নতুন আইন করা হোক। একটা নারীকে রেপ করে আবার মেরেও যদি পার পেয়ে যায় তবে এ পৃথিবী আমরা চাই না! আমরা মায়েরা পুত্র সন্তান জন্মদিতে চাই না!
মৌমিতার মা হয়ে তাকে হারানোয় যেমন আমরা ব্যথিত তেমনি সেই কুলাঙ্গারদের মা হয়ে আমরা তাদের ফাঁসি চাই !
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
শাহানা সিরাজী
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।