জাল-জালিয়াতি করে এসআইবিএল কর্মকর্তারা; মহাসড়ক বন্ধক রেখে ১৫ কোটি টাকা লোপাট
অপরাধ প্রতিবেদকঃ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জমি বন্ধক রেখে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। এ দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকটির তিন কর্মকর্তা ছাড়াও স্থানীয় ভূমি অফিস ও ঢাকা জেলার সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মাধ্যমেই জালিয়াতির নিপুণ ছক কষে ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মেসার্স গ্রিন ভ্যালি অটোমোবাইলসের মালিক গোলাম ফারুক। এ বিষয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুুদক) সহকারী পরিচালক আজিজুল হক একটি মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় উত্তরার আজমপুর অংশে মহাসড়ক বেচাকেনার মূলহোতা গোলাম ফারুক ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী খন্দকার মেহমুদ আলম ওরফে নাদিম ছাড়াও এসআইবিএলের প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) ও শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইকবাল (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) মো. আবদুল হামিদ ও প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) মো. ইমানী চৌধুরীকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) আসামি করা হয়। ঘটনার সময় এই তিন কর্মকর্তা দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত এসআইবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় কর্মরত ছিলেন।
আসামিদের মধ্যে গোলাম ফারুক ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফিরোজ আল মামুন ওরফে ফিরোজ একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সম্প্রতি জামিনে এসেই গত ১৭ নভেম্বর বিকালে সদলবলে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৭ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত জামির আলী মার্কেট দখল নেওয়ার উদ্দেশ্যে হামলা চালান গোলাম ফারুক। এ ঘটনার পরদিন উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেন মার্কেট মালিকের মেয়ে রাবেয়া সনি। এই মামলায় ফের গ্রেপ্তার হন গোলাম ফারুক। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে মহাসড়ক বন্ধক দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ভয়ানক এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত অন্যরা।
এই অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট এক আদেশে ঋণ জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান করতে দুদককে তিন মাসের সময় বেঁধে দিয়েছেন। সে হিসাবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি শুনানির দিন ধার্য করেন উচ্চ আদালত। সেদিন কী কারণে ভুয়া ডকুমেন্টে ঋণ দেওয়া হয়েছে তা জানাতে এসআইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) জবাব দাখিল করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
গত ২১ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ওবায়েদ আহমেদ বাদী হয়ে একটি রিট করেন। রিটকারী জানান, মহাসড়কের জায়গা বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সম্প্রতি গোলাম ফারুক একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু মহাসড়কের জমি বন্ধকের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ওই ঘটনার তদন্ত চেয়ে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চেয়ে আবেদন করা হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সপ্তাহব্যাপী যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় মহাসড়ক বেচাকেনায় মূল অভিযুক্ত গোলাম ফারুকের সঙ্গে। কাকরাইল ও উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে তার অফিস এবং বাসায় গেলেও ফারুকের দেখা মেলেনি। বহুবার তার সেলফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ওপাশ থেকে সাড়া দেননি তিনি।
একইভাবে গত কয়েকদিন ধরে এসআইবিএলের এমডি মো. জাফর আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। শুক্রবার বিকালে তার সেলফোন নম্বরে কল করা হলে ওপাশ থেকে সায় দেন সাফায়াত নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু প্রতিবেদকের পরিচয় দিতেই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর বহু চেষ্টা করেও এসআইবিএলের এমডির মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোলাম ফারুক গাজীপুরের কালিয়াকৈরের যে ভুয়া জমি দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন, তা বুঝতে পেরে ব্যাংক চাপ দিলে তিনি মহাসড়ক ও রাজউকের জমি সংযুক্ত করে দেন। অথচ সেটিও ছিল ভুয়া। এক সহকারী সেটেলম্যান্ট কর্মকর্তা অবৈধভাবে অস্তিত্বহীন দাগ দিয়ে আবদুল্লাহপুরের এক বাসিন্দার নামে রাজউক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ৪৮ শতাংশ জমি লিখে দেন। অধিদপ্তরের এক সেটেলম্যান্ট কর্মকর্তা নিজ ক্ষমতাবলে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারি সংস্থার দুটি দাগের ওই জমি ভুয়া মালিকানায় রেকর্ড করে দেন। পরে এসব ভুল রেকর্ডের জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন ফারুক। দাগে গরমিল থাকলেও অধিগ্রহণের বাইরের জমি দেখিয়ে তৎকালীন এসিল্যান্ড নামজারিও করে দেন ফারুককে। এরপর অস্তিত্বহীন দাগ আড়াল করতে ঢাকা জেলার সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার আরেকটি ভুল সংশোধন দলিল করে দেন তাকে। সেটিও ছিল বড় ধরনের প্রতারণা। এই ভুয়া কাগজ দেখিয়েই গোলাম ফারুকসহ আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেসার্স গ্রিন ভ্যালি অটোমোবাইলসের প্রোপাইটার গোলাম ফারুক ২০১০ সালের ৩১ মার্চ এসআইবিএলের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের দপ্তরে ১৫ কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফারুকের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুরির সুপারিশ করেন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল এবং অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। তাদের যৌথ স্বাক্ষরে এসআইবিএলের প্রিন্সিপাল শাখার ১১ এপ্রিলের এক স্মারকমূলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় বরাবর ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হয়। এই ঋণ প্রস্তাবের আলোকে এসআইবিএলের ২০ এপ্রিলের এক স্মারকে গোলাম ফারুকের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণের বিপরীতে খন্দকার মেহমুদ আলম নাদিম তার মালিকানাধীন (তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা) গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলাধীন হিজলহাটি মৌজার বিভিন্ন দাগ খতিয়ানের ৩২৬ দশমিক ০২ শতাংশ জমি কালিয়াকৈর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বন্ধকী দলিল ও আমমোক্তারনামার মাধ্যমে বন্ধক ও বিক্রির ক্ষমতা প্রদান করেন।
তবে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের ২০২২ সালের ২৯ মার্চের এক স্মারকমূলে দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, হিজলহাটি মৌজার ওই জমিটির দশমিক ০৬৫০ একর জমির মালিক গাজীপুরের বাসিন্দা জহুরা বেগম এবং অবশিষ্ট অংশের মালিক গুলশান ২-এর বাসিন্দা খন্দকার মেহমুদ আলম নাদিম। পরে তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, খন্দকার মেহমুদ আলম নাদিম তৃতীয়পক্ষ বন্ধকদাতা হিসেবে জাল ছবি ও জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করে জাল বন্ধকী দলিল ও জাল আমমোক্তারনামা দলিল সৃষ্টি করেন। ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ও গোলাম ফারুক পরস্পর যোগসাজশে এ কাজটি করেন। এই জাল বন্ধকী ও জাল আমমোক্তারনামা দলিলের বিপরীতে শতাব্দী বিল্ডার্স নামীয় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জরিপ প্রতিবেদন সংগ্রহ করে এসআইবিএলের তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইকবাল এবং অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ইমানী চৌধুরীর সার্বিক সহযোগিতায় প্রধান কার্যালয়ের এক স্মারকমূলে গোলাম ফারুকের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর হয়। এই ঋণের টাকা ফারুকের অনুকূলে এসআইবিএলের প্রিন্সিপাল শাখায় পরিচালিত হিসাব নং-১৩৩০০০৫৬২০-এ জমাও হয়। জমাকৃত ১৫ কোটি টাকার মধ্যে গোলাম ফারুক ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ কোটি ২ লাখ টাকা তুলে পরস্পর যোগসাজশে আত্মসাৎ করেন।
গত ১৭ নভেম্বর উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৭ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত জামির আলী মার্কেটে হামলার ঘটনার তদন্ত করছেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই রিজুয়ান ফকির। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, মামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনিসহ মামলার অন্য আসামিরা বর্তমানে জামিনে আছেন। তদন্তের পর ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে।