এসেনসিয়াল ড্রাগসের নিরাপত্তায় শঙ্কা; বেদখল সরকারি সম্পদ

Ban_Govt4.jpg

এসেনসিয়াল ড্রাগসের নিরাপত্তায় শঙ্কা; বেদখল সরকারি সম্পদ

অপরাধ প্রতিবেদকঃ চাঁদাবাজি-দখলবাজির জাঁতাকলে সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী দেশের একমাত্র কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশনভুক্ত (কেপিআই-১(খ)) প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) নিরাপত্তা আঙ্গিনায় বড় ফাটল ধরেছে।

২০১৩ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় (কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা, ২০১৩) বলা হয়েছে- সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (কেভিইডিসি) ছাড়পত্র ছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে কেপিআই ১(খ) শ্রেণিভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের বহির্নিরাপত্তায় সীমানা প্রাচীর ঘিরে প্রায় ৫০ ফুট (১৫ মিটার) দূরত্ব এলাকার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পয়ঃনিষ্কাশন লাইন ও সুড়ঙ্গ পথসহ কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।

অথচ ইডিসিএলের সম্মুখভাগ কিছুটা মুক্ত থাকলেও এখন প্রতিষ্ঠানটির সীমানা প্রাচীর লাগোয়া অন্য পাশগুলো (বিআরটিসি ঢাকা ট্রাক ডিপো সড়ক, তেজগাঁও মিনি ট্রাক স্ট্যান্ড ও মদিনা মসজিদ মার্কেট সড়ক) হয়ে গেছে জবরদখল। কেভিইডিসির প্রাচীরসংলগ্ন ফুটপাত দখল করে বস্তিঘরসহ অন্তত শতাধিক স্থায়ী দোকান গড়ে তুলেছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা।

ওয়াচ টাওয়ারের সামনেই গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় কার্যালয়।

শুধু তাই নয়, সড়কগুলো এখন পরিণত হয়েছে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের তিন সংগঠনের তালিকাভুক্ত প্রায় ১০ হাজার ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান রাখা হচ্ছে সড়কজুড়েই। প্রতিদিন কারওয়ানবাজারে কাঁচামাল নিয়ে দেশের দূরদূরন্ত থেকে আসা বড় ট্রাক ২৫০ টাকা ও কাভার্ডভ্যান ১৫০ টাকা চাঁদার বিনিময়ে মূল সড়কে যানগুলো রাখার সুযোগ করে দিচ্ছেন শ্রমিক নেতারাই। রাত যত গভীর হয় সড়ক দখল করা ট্রাকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ট্রাকের আড়াল ও ফুটপাত দখলের কারণে রাতে ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এলাকাটি। প্রতিনিয়ত যানজটের মহাবিড়ম্বনা ছাড়াও ঝুঁকি নিয়ে সড়কটি দিয়ে হাঁটাচলা করতে হচ্ছে যাত্রী ও পথচারীদের। সবকিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে। কিন্তু নীরব দর্শকের ভূমিকায় কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব দোকান-বস্তিঘর আর ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড থেকে মাসে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা উঠে নেতাদের নামে। স্থানীয় থানা-পুলিশ ছাড়াও এ বখরার ভাগ যাচ্ছে উত্তর সিটি করপোরেশনের অসাধু কিছু কর্মকর্তার পকেটে। ফলে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় এ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকলেও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে গা করছে না কর্তৃপক্ষ। ইডিসিএল এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

ইডিসিএল কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানীয় রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতাদের প্রভাবের কারণে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অপারগ তারা। তবে কেপিআইভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটির বহির্নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেসব ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে, তার সব বিষয় জানিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য প্রতি মাসেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ৮টি দপ্তরে চিঠি দিচ্ছেন তারা। কিন্তু ইডিসিএলের অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না উচ্ছেদ সংশ্লিষ্টরা। চলতি মাসের গত ৬ সেপ্টেম্বরও এক মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। এর তিন দিন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য ফের উল্লেখিত ৮ দপ্তরে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি। ইডিসিএলের পাশেই গড়ে তোলা ট্রাক স্ট্যান্ডে ২০২০ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। এতে ব্যাপক ঝুঁকিতে পড়ে ইডিসিএল। এ বিষয়ে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি ইডিসিএলের ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন; যার জিডি নম্বর-২৮। কিন্তু গত দুই বছরেও ওই জিডির সুরাহা হয়নি। টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। সরেনি অবৈধ কিছুই।

advertisement
জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই মনির হোসেনের সঙ্গে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ‘দুই বছর আগে ইডিসিএলের সীমানা প্রাচীর সংলগ্নে গড়ে ওঠা একটি দোকানে অগ্নিকা-ের ঘটেছিল। আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দোকান মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দোকান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম। উচ্ছেদ করার বিষয়ে সবাই আশ্বস্তও করেছিল।’ বলেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। তবে এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন এসআই মনির।

অগ্নিকা- সংঘটিত হওয়া ওই দোকানে গিয়ে গতকাল বিকালে দেখা যায়, দোকানটি খোলা রয়েছে। পাশে মূল রাস্তা দখল করে গাড়ির যন্ত্রাংশের কাজ করতে দেখা যায় দোকান কর্মীদের। সোবাহান পরিচয়ের এক কর্মচারী জানান, কেপিআই-টেপিয়াই বুঝি না। আমরা এখানে টাকা দিয়া ব্যবসা করি। সবাই এ টাকা পায়। ক্ষমতা থাকলে যারা আমগো থেইক্যা চাঁদা নেয়, পারলে তাদের গিয়া কিছু কন। অভিন্ন মন্তব্য করেন অন্য দোকানের মালিক-কর্মচারীরাও।

ইডিসিএলের ম্যানেজার (এডমিন) মো. শাহাবুদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, আমার (ইডিসিএল) কেপিআই রিপোর্ট সবচেয়ে সন্তোষজনক। গত ৬ সেপ্টেম্বর আমার এখানে কেপিআই কর্তৃপক্ষ ভিজিট করেছেন। তারা আমাকে ৯৮ প্লাস মার্কস দিয়ে একটি প্রশংসামূলক চিঠি দেবেন বলেও জানিয়েছেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বহির্নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়ে প্রতি মাসেই মেয়রের দপ্তরসহ আমি সংশ্লিষ্ট অন্তত ৮টি দপ্তরে চিঠি দিই। কিন্তু কোনো উত্তর পাই না। আমাদের কেপিআইয়ের স্থানীয় সার্ভে টিমের সদস্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওসি)। তাকে গত সপ্তাহেও বিষয়টি অবগত করেছি। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত যা ছিল তাই আছে। সরেনি অবৈধ কোনো স্থাপনা। ২০২০ সালে একবার দেওয়ালের পাশের একটি দোকানে আগুন লাগে। এ বিষয়ে জিডিও করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কিছু হয়নি। আমরা কাউকে উচ্ছেদের ক্ষমতা রাখি না। যারা রাখেন তাদের তো বিষয়গুলো প্রতিনিয়তই জানাচ্ছি। কিন্তু অভিযোগ কোনো কাজেই আসছে না। ফলে ঝুঁকি কাটছে না।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি কাজী আবুল কালাম বলেন, ইডিসিএলের বহির্নিরাপত্তার বিষয়টি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমি অবগত হয়েছি। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন উচ্ছেদে এলে আমরা তাদের সার্বিক সহায়তা করব।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ মাহে আলম আমাদের সময়কে বলেন, এসেনসিয়াল ড্রাগসের বহির্নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি বা থানার ওসি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে আমাদের চিঠি দিয়েছে, বিষয়টিতে আমি অবগত নই। যেহেতু বিষয়টি নজরে আনলেন, সরেজমিনে অভিযোগের সত্যতা পেলে- কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তার স্বার্থে মেজিস্ট্রেট পাঠিয়ে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।

চাঁদাবাজির বিষয়টি ভিত্তিহীন দাবি করে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মো. মনির জানান, আমরা সড়কে গাড়ি পার্কিং করার পক্ষে না। নিরুপায় হয়ে সড়কে পার্কিং করতে হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালামাল নিয়ে এ এলাকায় ঢুকছে। মালামাল লোড-আনলোডের জন্য মাঝে মধ্যে সড়কে ট্রাক থাকে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মালিক-শ্রমিকরা ট্রাক ভাড়া দিতে না পারায় ট্রাক সরাতে চাচ্ছে না। ট্রাক স্ট্যান্ডের জন্য আমাদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। যা আছে, তাও রেলওয়ের জায়গা। ট্রাক স্ট্যান্ডের জন্য অন্যদিকে জায়গা খোঁজা হচ্ছে। জায়গা পেলেই ট্রাকগুলো সরিয়ে নিয়ে সড়ক ছেড়ে দেওয়া হবে। উত্তর সিটি করপোরেশন ট্রাক টার্মিনাল করে দেবে বলেছে। ওই স্ট্যান্ড হলেই সড়কে আর ট্রাক থাকবে না।

ঢাকা মহানগর উত্তরের ২৪নং ওয়ার্ড (৩নং ইউনিট) আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জহির গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, আমি নেতা হওয়ার আগে থেকেই এখানে (ইডিসিএলের সীমানা প্রাচীর) আমাদের কার্যালয়। কখনো কেউ এ প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য নোটিশ দেয়নি। চাঁদাবাজির বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা এখান থেকে এক কাপ চাও কারও কাছ থেকে খাই না। আমাদের রাজনৈতিক সুনাম ক্ষুণœ করার জন্য প্রতিপক্ষরা এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে শুধু ইডিসিএলের বহির্নিরাপত্তা ছাড়াও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায়ও ফাঁক লক্ষ করা গেছে। কেপিপআই নীতিমালায় বলা হয়েছে- (কেপিআই-১(খ)-এর চতুর্দিকে স্থাপিত সুউচ্চ ইমারত/স্থাপনাগুলো যেখান থেকে গোপনে ছবি তোলা যায় বা আগ্নেয়াস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুর আওতায় পড়ে তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

কেপিআইগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে চতুর্দিকে ন্যূনতম ৮ ফুট উঁচু সীমানা প্রচীর নির্মাণ করতে হবে। এর ওপরে কমপক্ষে আড়াই ফুট ওয়াই আকৃতির কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের দরজা জানালাসহ সব অবকাঠামো মজবুতভাবে নির্মিত ও সুরক্ষিত হতে হবে।

কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রাচীরসংলগ্ন বেশ কয়েকটি জানালার কাচ ভাঙা। যেগুলো দিয়ে অনায়াসেই ভেতর থেকে বিপুল ওষুধ পাচার করা সম্ভব। এ ছাড়া সীমানা প্রচীরের ওপর যে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে তার অনেক জায়গায়ই দেখা গেছে ফাঁকা। ফলে এ ফাঁকা জায়গা দিয়েও নিরাপত্তার ফাঁক ছাড়াও ভেতর থেকে ওষুধ পাচার সম্ভব বলে অভিমত খোদ ইডিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

কেপিআই নীতিমালার ৪-এর ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- কেপিআই এলাকায় কোনো ধরনের অবৈধ স্থাপনা যাতে নির্মিত না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ থাকবে। এ ধরনের কোনো অবৈধ স্থাপনা বিদ্যমান থাকলে অথবা নির্মিত হলে তা উচ্ছেদের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেবেন। এর ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টরা দায়ী থাকবেন।

কিন্তু বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের বাইরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটির কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার নজির রয়েছে বলে জানাতে পারেনি ইডিসিএলের কেউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top