অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে কেনাকাটায় গোঁজামিল –
গণপূর্তে হরিলুট
বিশেষ প্রতিবেদকঃ শেষ হয়ে যাচ্ছে অর্থবছর। কিন্তু সময়ের অভাবে অনুমোদন পাওয়া প্রাক্কলিত অর্থ কাজে লাগাতে গোপনে কাগজ-কলমে দরপত্র আহ্বান দেখিয়ে কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে দেখাতে হবে জুনের মধ্যেই। তা না হলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। তাই গোঁজামিল দিয়ে, কখনও কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিচ্ছেন গণপূর্ত অধিদফতরের বেশিরভাগ নির্বাহী প্রকৌশলী। এর প্রমাণও মিলেছে।
ঢাকার তেজগাঁও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের বাংলো-১-এর দরজা, জানালায় থাই গ্লাস লাগানো, টাইলস বসানো, রঙ করা এবং কেন্দ্রীয় রেকর্ড ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন লাইন মেরামত ও গ্যারেজ কাম-ড্রাইভার কোয়ার্টারের নিচতলায় গ্যারেজগুলোর সিলিং মেরামত, বিভিন্ন দরজা মেরামত, স্যুয়ারেজ লাইন মেরামত কাজের জন্য গত ৫ জুন ১৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার একটি প্রাক্কলন অনুমোদন করেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক। কিন্তু অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে অনুমোদন পাওয়া এ কাজ শেষ না করেই বিল পরিশোধের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ। শুধু এটা নয়, বিভাগ-৩-এর জন্য এভাবে গত মে ও চলতি জুন মাসে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি টাকারও বেশি মেরামতের কাজের প্রাক্কলন, যার অধিকাংশই নামমাত্র কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এভাবে মে ও জুন মাসে তড়িঘড়ি করে গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা জোন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অধীনে ২০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ দেখানো হচ্ছে ভবন মেরামত, রঙ করা সহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে।
গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মে মাসের শেষদিকে বা জুন মাসে কোনো প্রাক্কলন অনুমোদন হওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করে সঠিক ভাবে কাজ সম্পন্ন করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। তারপরও অর্থবছর শেষ হওয়ায় কাজ শেষ দেখাতে হবে জুনের মধ্যে। তা না করলে বরাদ্দ অর্থ সরকারের কোষাগারে ফেরত যাবে। এ কারণে বেশিরভাগ নির্বাহী প্রকৌশলীই গোঁজামিল দিয়ে বা কাজ না করেই কাগজ-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল দিয়ে দিচ্ছেন।
গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থাপনা মেরামত বা বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (এপিপি) খাতে গণপূর্ত অধিদফতরকে মোট ৮১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে স্থাপনা মেরামতের জন্য আবাসিক ভবনে ৫ হাজার ৯১২টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি এবং অনাবাসিক ভবনে ৬ হাজার ১৭৪টি কাজের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়।
ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ মে ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবনের ১নং ব্লকের দ্বিতীয় তলায় প্রয়োজনীয় মেরামত ও রঙ করার একটি প্রাক্কলন এবং সেগুনবাগিচায় অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলায় পূর্ত অডিট অধিদফতরের বিভিন্ন কক্ষে মেরামত ও রঙ করার কাজের আরেকটি প্রাক্কলন অনুমোদন দিয়েছেন ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
গত সোমবার রাজস্ব ভবনের দ্বিতীয় তলায় সরেজমিন গিয়ে রঙ করার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এনবিআরের প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীরা জানান, দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় কোনো মেরামত বা রঙ করা হয়নি; বরং এই ভবনের দেয়ালগুলোর অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। একই ভাবে অডিট কমপ্লেক্স ভবনের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, শুধু লিফটের সামনের ছোট্ট খোলা জায়গার দেয়ালের নিচের অংশ মেরামত করা হয়েছে।
অডিট অধিদফতরের স্টাফরা জানান, তৃতীয় তলায় কোনো কক্ষে মেরামত ও রঙ করা হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাক এবং গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখ যোগসাজশ করে কাজ শেষ না করেই ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিল পরিশোধ করছেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিসকে বিলের মোট ৫ পার্সেন্ট দিতে হয়। সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অফিস কক্ষটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করার বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রায় ১০ মাস আগে কক্ষটির ওয়াশরুমের কমোডসহ ফিটিংস পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং দামি ফার্নিচার কেনা হয়েছিল। প্রথমে দামি টাইলস বসানোর পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর তা পছন্দ না হওয়ায় আবার তা তুলে দামি পাথর বসানো হয়েছে। এভাবে সরকারি টাকা অপচয় করেছেন এই কর্মকর্তা।
একইভাবে গণপূর্ত ঢাকা সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামিলুর রহমানের কার্যালয় থেকেও অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে মে ও জুন মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজের প্রাক্কলন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত কাজের প্রাক্কলন পাঠানোর ঘটনাও ধরা পড়ে।
আরবরিকালচার বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রধান বৃক্ষপালনবিদ শেখ মো. কুদরত-ই-খুদাও কাগজ-কলমে গাছ লাগানোর নামে অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে প্রায় ৪ কোটি টাকার বিল পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি ২২৪টি কাজের চাহিদা দিয়ে চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ পেয়েছেন ১০ কোটি টাকা।
এদিকে অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে কয়েকদিন আগে ই/এম গণপূর্ত বিভাগ-৮-এর জন্য জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বৈদ্যুতিক কাজ ও তিনটি এয়ারকুলার লাগানোর জন্য ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় তলায় প্রশাসনিক ভবনে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং ও সুইচ পরিবর্তনের জন্য ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার, গার্ডেন লাইট ও সিকিউরিটি লাইটের জন্য ২৮ লাখ ৭০ হাজার, ইমার্জেন্সি ব্লকে এসির জন্য ১৫ লাখ ৯৬ হাজার, রেটিনা ব্লকের এসির জন্য ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ও প্রশাসনিক ব্লকে ভিআরএফ এসির জন্য ২৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, গণপূর্ত অধিদফতরের ই/এম ঢাকা-৮-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল হালিম ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ হারে টাকা নিয়ে প্রাক্কলিত দর অনুযায়ী কাজ দিয়েছেন। পিপিআর অনুযায়ী এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে দরপত্র হওয়ার কথা থাকলেও তা না করে ওটিএমের মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করে কাজ দেওয়া হয়েছে। টেন্ডার আইডি হাইড করে রেখে যাদের কাছ থেকে টাকা নিত পরে তাদের আইডি ও রেট জানিয়ে দিত বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা।
তাদের দাবি, পিপিআর অনুযায়ী ইজিপিতে এলটিএমের বাইরে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ নেই। এলটিএমের ক্ষেত্রে প্রতি টেন্ডারে ১০ শতাংশ কমে দর জমা পড়ে। এর মধ্যে লটারির মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়। এতে সরকারের শিডিউল বেশি বিক্রি হওয়ায় সরকারি কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ কমের কারণে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হয়। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী তার মনোনীত ব্যক্তিদের প্রাক্কলিত মূল্যে কাজ দেওয়ায় সরকারের ১০ শতাংশ হ্রাসের অর্থ লোকসান হচ্ছে। তবে এই ১০ শতাংশ টাকা প্রকৌশলী এবং ঠিকাদার ভাগ করে নেন তাদের নির্ধারিত কমিশনের বাইরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতে বেশিরভাগ দরপত্রে মাত্র একজন ঠিকাদার অংশ নিয়েছেন, যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
বহুল আলোচিত পাবনার রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘বালিশ-কাণ্ড’ দুর্নীতি মামলার অন্যতম আসামি গণপূর্ত ই/এম বিভাগ-১ ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মো. আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজের ৫৫-৬০ শতাংশ টাকা নিয়ে কাজ না করে বিল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কোনো ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও এসএসএফ ও নিরাপত্তার ভয় দেখিয়ে কাজের স্থান ঠিকাদারকে দেখায় না। টেন্ডারের পর কাজের মোটমূল্যের ৫৫-৬০ শতাংশ টাকা ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়ে কাজ সম্পন্ন দেখায়। এ ছাড়া একই কাজ একাধিক নামে করিয়ে বিল দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা জানেনও না তারা কোথায় কাজ করেছে বা আদৌ কাজ হয়েছে কি না। এসব কারণে ভিভিআইপি এলাকায় ই/এম-এর কাজ নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসু বলেন, এপিপির অর্থ সঠিক ভাবে যাতে ব্যয় হয় সে বিষয়ে মনিটরিং করা হয়। সবাইকে সঠিক ভাবে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপ করতে বলেন।
ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সতীনাথ বসাকের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজ না করে বিল পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই। অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে কেন কার্যাদেশ দেওয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সময় প্রশাসনিক অনুমোদন পেতে দেরি হয় তাই এমনটি হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলীদের কাছ থেকেও প্রাক্কলন পেতে দেরি হয়। তিনি এসব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কায়সার ইবনে সাঈখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।