পিছিয়ে যাচ্ছে অনুসন্ধান, তদন্ত ও চার্জশিট
অর্ধেক জনবলে গতি হারাচ্ছে দুদক
জিরো টলারেন্সের নীতি সব ক্ষেত্রে প্রতিফলিত না হওয়ার অভিযোগ।
বিশেষ প্রতিবেদকঃ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জনবল সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক জনবল দিয়ে চলছে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি। তিন বছর আগে দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর অনুমোদন দিলেও অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি। অনুমোদিত দুই হাজার ১৪০ জনের স্থলে বর্তমানে দুদকে কর্মরত আছে এক হাজার ৮২ জন। লোকবলের অভাবে কাজে গতি ফেরাতে পারছে না কমিশন। সময়মতো শেষ হচ্ছে না বেশির ভাগ অনুসন্ধান ও তদন্ত। চার্জশিট বিলম্বিত হওয়ায় সঙ্গত কারণে বিচার প্রক্রিয়াও পিছিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনসাধারণের প্রত্যাশা দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে।
এ ছাড়া নানা কারণে দুর্নীতি দমনে এখনো বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেওয়ার রেকর্ডও গড়তে পারেনি দুদক। সব ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা ফাঁকফোকর গলিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এমনটিই জানিয়েছেন পর্যবেক্ষক মহল ও কয়েকজন বিশ্লেষক।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার জনবল নিয়োগের অনুমোদন করেছে। সেক্ষেত্রে কমিশনের সক্ষমতা বাড়াতে জনবল নিয়োগে কালক্ষেপণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে এ কাজে দুদককে দীর্ঘসূত্রতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সক্ষমতা না বাড়লে দুদকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট বাড়তেই থাকবে। একই সঙ্গে কমিশন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে।’
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, বিভিন্ন জেলায় কার্যালয় স্থাপনের পাশাপাশি লোকবলের ঘাটতি পূরণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি জেলায় দুদকের শক্তিশালী কার্যক্রম চালু শুরু হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদকের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা আমরা ধরে রাখতে চাই। দুর্নীতি করলে কেউই রেহাই পাবে না।’
এদিকে দুদক কর্মকর্তাদের অনেকে বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দুদকের সাংগঠনিক কাঠামো জোরদারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের যাত্রা শুরু হবে। এ জেলা অফিসের সঙ্গে যুক্ত হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কার্যক্রম। এ রকম আরও ১৩ জেলা কার্যালয়ে কাজ শুরু হবে পর্যায়ক্রমে। এছাড়া সহকারী পরিচালক ও উপ-সহকারী পরিচালক পদে মোট ২৮০ জনকে নিয়োগের প্রক্রিয়াটি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভ্যারিফিকেশন পর্ব শেষ হলেই কমিশন ওই কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেবে। জনবলের ঘাটতি মেটাতে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আগামী বছরের শুরুর দিকে বড় পরিসরে আরেকটি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে। আশা করা হচ্ছে, চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে জনবল সংকট কিছুটা কমবে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, কমিশনে জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করতে হয়। তবে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত যথাসময়ে সম্পন্ন করতে চাইলে পর্যাপ্ত লোকবলের প্রয়োজন। কমিশনের উচিত লোকবলের ঘাটতি মেটাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘লোকবলের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও তদন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিচার প্রক্রিয়াও অনেকটা বিলম্বিত হচ্ছে। আর দুর্নীতি মামলার তদন্ত ও বিচারে দ্রুত গতিতে না হলে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এক হাজার ৮২ জন লোকবল নিয়ে চলছে দুদক। এর মধ্যে অবসর ও শূন্য পদও রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা ও দুর্নীতির অভিযোগের তুলনায় এ লোকবল অতি নগণ্য। একেকজন কর্মকর্তার কাঁধে একাধিক অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে একটি বিষয়ে সময় দিতে গেলে আরেকটির কাজ পড়ে থাকছে। সময়ক্ষেপণের কারণে অনেক সময় দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একটি বিষয়ে একটানা কাজ করতে না পারায় তদন্তের ধারাবাহিকতাও নষ্ট হয়। এসব কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়। সম্ভাব্য অপরাধের তথ্য গোপন কিংবা ধ্বংস করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ৬৪ জেলায় ৬৬টি কার্যালয়ের মাধ্যমে অফিস পরিচালনা করেছে। ওই সময় জেলা কার্যালয়ের পাশাপাশি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলেও ব্যুরোর ফিল্ড অফিস ছিল। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে কমিশন গঠন করা হয়। এরপর থেকে ৬৬টি কার্যালয়ের পরিবর্তে ২০ জেলায় ২২টি কার্যালয় দিয়ে কমিশন ৬৪টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে ২০১৮ সালে সরকার দুদকের ৩৬টি জেলা কার্যালয় অনুমোদন করলেও অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি।
নতুন উদ্যোগ : ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে ২০টি জেলায় ২২টি ফিল্ড অফিস (সমন্বিত জেলা কার্যালয়) নিয়ে দুদকের কার্যক্রম চলছে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর অর্থ বিভাগ থেকে ওই বছরের ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়।
দুদকের নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ছয়টি বিভাগীয় কার্যালয়ের সঙ্গে আরও দুটি নতুন বিভাগীয় কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলমান ২২টি জেলা কার্যালয়ের সঙ্গে আরও ১৪টি নতুন জেলা কার্যালয় স্থাপনেরও অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিনেও এ উদ্যোগের তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এরই মধ্যে কমিশন পরিবর্তন হয়। নতুন কমিশন গঠনের পর সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর উদ্যোগে গতি ফেরে। এরই অংশ হিসেবে গত ৬ অক্টোবর দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা সমন্বয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয় স্থাপনের ঘোষণা আসে।
জনবল নিয়োগ : বর্তমানে কমিশনে এক হাজার ৮২ জন কর্মরত আছেন। অনুমোদিত জনবল দুই হাজার ১৪০। ফলে শূন্যপদ এখনো এক হাজার ৫৮ জন। এর মধ্যে ২৮০ জন কর্মকর্তা (সহকারী পরিচালক ও উপ-সহকারী পরিচালক) নিয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভ্যারিফিকেশন সম্পন্ন করে তাদের শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর অন্তত ৭৭৮টি পদে কমিশনকে লোকবল নিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে ওই ৭৭৮টি পদে দুই দফায় নিয়োগ সম্পন্ন করবে কমিশন। গঠনতন্ত্র অনুসারে একটি জেলা কার্যালয় পরিচালনা করতে ২০ থেকে ৩১ জন লোকবলের প্রয়োজন হয়। সে অনুসারে আরও ১৩টি জেলা কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করতে হলে কমপক্ষে ৪০৩ জন লোকবল প্রয়োজন হবে। এ ঘাটতি আসন্ন নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।
ইতোমধ্যে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এ পদে চূড়ান্ত মনোনীত ১৩৩ জনের তালিকা ভ্যারিফিকেশনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া উপ-সহকারী পরিচালক পদেও নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এ পদে চূড়ান্ত মনোনীত ১৪৭ জনের তালিকা শিগগিরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। ভ্যারিফিকেশন সম্পূর্ণ হলেই কমিশন তাদের নিয়োগ দেবে। দুই পদেই নিয়োগের ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ তালিকা কমিশনে ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হবে। কেউ যোগদান না করলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
যেসব জেলায় চলছে দুদকের কার্যক্রম : দুদকের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বর্তমানে চালু থাকা ২২টি কার্যালয় হলো-ঢাকা-১ মেট্রোপলিটন (ঢাকা মহানগর), ঢাকা-২ (ঢাকা মহানগরের বাইরে ৫ থানা ও মানিকগঞ্জ), ফরিদপুর (ফরিদপুর ও রাজবাড়ী), ময়মনসিংহ (ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা), টাঙ্গাইল, রাজশাহী (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর), পাবনা (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ), বগুড়া, রংপুর (রংপুর ও গাইবান্ধা), দিনাজপুর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন (চট্টগ্রাম মহানগর), চট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম মহানগরের বাইরে উপজেলাসমূহ), রাঙ্গামাটি (রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি), কুমিল্লা (কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নোয়াখালী (নোয়াখালী ও ফেনী), খুলনা, যশোর (যশোর ও নড়াইল), কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর), বরিশাল (বরিশাল ও ভোলা), পটুয়াখালী (পটুয়াখালী ও বরগুনা), সিলেট (সিলেট ও সুনামগঞ্জ) ও হবিগঞ্জ (হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার)।
এছাড়া আগামী ১ জানুয়ারি থেকে কক্সবাজার (কক্সবাজার ও বান্দরবান) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চালু হচ্ছে। বাকি ১৩টি কার্যালয়ও দ্রুত চালু করা হবে। এগুলো হলো-বাগেরহাট (বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা), নারায়ণগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ), গাজীপুর (গাজীপুর ও নরসিংদী), মাদারীপুর (মাদারীপুর ও শরীয়তপুর), গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর (জামালপুর ও শেরপুর), নওগাঁ (নওগাঁ ও জয়পুরহাট), কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও (ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়), চাঁদপুর (চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর), ঝিনাইদহ (ঝিনাইদহ, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা) ও পিরোজপুর (পিরোজপুর ও ঝালকাঠি)। যেসব জেলায় সমন্বিত জেলা কার্যালয় নেই, সেখানে জেলার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে সেটি পরিচালিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ৬৪টি জেলায় পৃথক কার্যালয় খোলার পরিকল্পানা রয়েছে কমিশনের।