সংবর্ধনা – সাগর চৌধুরী

PicsArt_09-18-09.11.21.jpg

সংবর্ধনা – সাগর চৌধুরী

গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের আজাদ ভাইয়ের কবি পরিচিতিটা বেশ প্রসারিত হয়েছে। কবিদের মধ্যে তরুণ হওয়ার সুবাধে সিনিয়র কবিদের স্নেহ ভাজন হয়েছেন। তাছাড়া ‘আজকের তরুণরা আগামী দিনের পাথেয়’ কবিতাটি খানিক সুনামও কুড়িয়েছেন। ফলে নামটাও এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেছে বেশ।

গতবার বই মেলায় তিনটে কবিতার বই বেরিয়েছে। তার আগের বছরও বেড়িয়েছে এর সমান। এবারো তার বই বাজারে আসছে। আমরা তা আগে থেকেই টের পেয়ে গেছি। কেমন করে টের পেলাম ? ইদানীং ভাই আমাদের সাথে আর আড্ডায় আসেন না। খোঁজ! খোঁজ! অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল।

বাসায় কবিতা লেখায় ব্যবস্তা। বললাম ফোন ধরছেন না কেন? উত্তরে বললো-ভাবটা নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের আড্ডায় আর তাকে টানা হোঁচড়া করলাম না। তার কবিতা লেখায় ব্যাঘাত ঘটুক এটা আমরা চাই না।

ভাই আসছে না তাই আমাদের সাহিত্যের আড্ডাও জমে ওঠে না। বাংলা সাহিত্যে ‘আজাদ ভাইর অবদান’ শীর্ষক আলোচনা আপাতত বন্ধ। কি আর করা। এর নিন্দা করা। ওর বদনাম করা। একে অপরের সমালোচনা করেও যখন আর সময় পার করতে পারছিলাম না। তখন সবাই নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হলাম। হলাম তো হলাম এতই মনোযোগী হলাম যে, বেশ কয়েক দিন আর আড্ডায় এলামই না। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দিন পর যথারীতি আজাদ ভাইয়ের ফোন। কোথায় রে? ‘ভাই আছি শহরেই।

‘একবার পারলে বাসায় আসবি ? ‘সবাই। না একা?’

‘না, না। সবাই না কেবল তুই আয় কথা আছে।’ আজাদ ভাইয়ের চেলাপেলার মধ্যে এখন আমিই বেশ ফর্মে আছি। কেমন সেটা? বেশ কয়েক মাস আগে সুমনকে; ভাই কাগজ কিনতে বাজারে পাঠিয়েছে। কিন্তু কাগজ কিনে ফেরার পথে সুমনের খুব মন চাইলো বার্গার খেতে। আজাদ ভাইয়ের টাকার একটা অংশ দিয়ে সে বার্গার খেল । এই খবর পেয়ে আজাদ ভাই বললো-“ঠিক আছে। এর পরে যা কিছু হবে মিঠু করবে।

অবশ্য আজাদ ভাইয়ের প্রধান চেলার স্বীকৃতি পেয়ে নিজেকে বেশ উঁচু দরের লোক ভাবতে শুরু করেছি ইদানীং। কথাবার্তায় এর একটা রেশ; বেশ ভালোভাবেই চলে এসেছে আমার মধ্যে। ইদানীং ভাই কোন কাজ করতে গেলে; সে কাজের বিস্তারিত একটা আলোচনা করেন আমার সাথে। এই যেমন গত বছরের বিষয়টাই ধরেন না, বইগুলো কার কার কাছে পাঠাবেন, পোস্টারে তার ছবি থাকবে কি না, বই মেলার স্টলে বই সংখ্যা কত হবে। এবারের বই মেলায় যে বইগুলো আসবে সেই বই গুলোর প্রচ্ছদ কেমন হবে। কোন বইটা কাকে উৎসর্গ করবেন। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কাকে প্রধান অতিধি করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে আমার একটা মতামতের দাম আছে বলা যায়। কিন্তু আমাকে একা যেতে বলার কারণটা যাই হোক। তার একটা বিষয়ে আমি একমত। সেটা হলো অকাজে তিনি কখনো ডাকেন না।

কিন্তু কাজটা কি? মেলা তো এখনো বেশ কয়েক মাস পরে। আবার বুঝতাম তাকে নিয়ে আমাদের কোন অনুষ্ঠান থাকতো তাও নয়। তাহলে…? বাকিটা আজাদ ভাইর মুখেই শুনি। ‘ছেলেটা বেশ কয়েক দিন আগ থেকেই আমার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করছে।

স্বাভাবিকভাবেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-‘হ্যাঁ ছোঁকড়া, কি চাই?

ছেলেটা কাছে এসে বললো-‘ভাই আমি আপনার কবিতার একজন ভক্ত। বলতে গেলে আপনার ভীষণ ভক্ত। আপনার একটা অটোগ্রাফ প্লিজ। নোট খাতার পৃষ্ঠা ছিড়ে, বুক পকেট থেকে পেন বের করে, গোটাগোটা শব্দে বেশ দিয়ে দিলাম অটোগ্রাফ। ছেলেটার চোখ ভর্তি ভালোলাগার চাহনি দেখে বললাম-‘আমার বইগুলো পড়েছো? ছেলেটা গটগট করে আমার বইগুলোর নাম বলে গেল। আমি বিস্মিত হলাম। তার পর সে আমার বেশ কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনালো।

তাকে বাহবা দিলাম।

ছেলেটা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো-‘শুধু ভালো বললে চলবে না। আমাদের একটা আবৃত্তি সংগঠন আছে। তারপর সে সংগঠনটার নাম বললো কিন্তু নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সেখানে আপনাকে সংবর্ধনা দিব। আপনাকে রাজি হতেই হবে না বললে চলবেনা।

আমি আর না করতে পারি নি; বুঝলি। না কেনই করবো। আমার প্রতি ছেলেটার এমন ভক্তি। তাছাড়া ছেলেটার মুখে আমার কবিতাগুলোর প্রতিটি লাইন আমার ভেতরটা ছুয়ে গেছে। তারিখটা জেনে নিলাম। কোথায় সেটা তাও জেনে নিলাম। ছেলেটা বললো-‘প্রতি বছরই আমরা কবিদের সংবর্ধনা দিয়ে থাকি। বিশাল প্যান্ডেল গড়ি। বিদ্যুতের লাইন টেনে আলোকায়নের ব্যবস্থা করি। আশপাশের লোকজনেরা আসে। হৈ হুলুর করে অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যায় কবিদের নিয়ে আলোচনা। তারপর প্রধান অতিথির সাথে মিলে সবাই সংবর্ধিত কবিকে সম্মাননা জানানো। অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের রাতের খাবার। রাতের খাবারে তিন-চার পদের মাছ, মুরগি, খাসির মাংস, আরো অনেক কিছু। আপনাকে এখন ওসব বলতে চাই না। গল্প শুনলে যেমন সে গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করে না, আপনারও সে অবস্থা হবে। সব গিয়ে দেখবেন। আপনার ভালো না লেগে পারবে না।

আমি যথারীতি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দুপুরের পর বেড়িয়ে পড়লাম। আজ আমাকে সংবর্ধনা দেবে; একেবারে তো নেহাত ছাপোশা কেরানির পোশাকে যাওয়া যায় না। তাই না?

বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া ঘড়িটা আলমারী থেকে বের করে হাতে পরে নিলাম। বেশ দামি ঘড়ি । শহরে শীত তেমন গায়ে লাগে না, তাই শালটা উঠানো ছিল। গতবার ভারতে গিয়ে ফেরার পথে মনে হলো বেশ অল্পদামে কাশমিরি শাল পাওয়া যায় এখানে। শালটা দেখে সাধারণ কেউ বুঝতে পারে না এটা মাত্র পনেরশ রুপিতে কেনা। অনেকেই মনে করে শালটার দাম আরো বেশী। জুতাটা বাটার দোকান থেকে কেনা। সচরাচর পায়ে দেওয়া হয় না কিন্তু সংবর্ধনায় এটা পায়ে দেয়া যায়। বেশ ভালো সুগন্ধি দেখে একটু শরীলে মেখে নিলাম। সর্বোপরি আমার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান তো! আজ তো মানুষ আমাকেই দেখবে তাই না ?

গাড়ি ছেড়ে রিকসায় উঠে তাকে ফোন করলাম। ফোনে সে আমাকে একটা ঠিকানা বললো। আমি সেই ঠিকানায় গিয়ে হাজির হলাম। তখন রাত আটটা পার হয়ে গেছে। ভাঙ্গা রাস্তা। তার উপরে ইট বসানো হয়েছে পাকা করবে। বালু আর সুরকিতে রাস্তার উপরে চলাই দায়। খানিক রিকসা চলার পর পেছন থেকে ডেকে বললো-‘এই রিক্সা দাঁড়াও’।

রিকসা দাঁড়ালে; আমার কাছে এসে ছেলেটি দাঁড়ালো। বললো-‘ভাই আপনি অনেক দূর থেকে এসেছেন বেশ কষ্ট হয়েছে আপনার। ছেলেটার মায়াবী কথা শুনে আমিও একটু আনন্দে গদগদ। বললাম- এ আবার কষ্ট কিসের অ্যাঁ । ভালোবেসে ডেকেছ; না আসলে খারাপ লাগবে তাই চলে এলাম।

তারপর। বললাম আমি।

তারপর বলে ভাই একটু থামলেন। বললাম তারপর কি হলো? এবার আজাদ ভাই নিজের বুকভরে শ্বাস নিলো তারপর ফোঁস করে শ্বাসটা ফেলে বললো-“ আমাকে একটু অন্ধকারের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বললো- এখানে শয়তানের বাবাও আমাদের ভয় করে চলে। আশা করি বুঝতে পারছেন।

বললাম ‘হ্যাঁ’।

তাহলে এবার আপনার মোবাইলটা দেন। মোবাইলটা
দিলাম ছেলেটার হাতে। ভাবলাম হয়তো ফোন করবে।

হাত ঘড়িটা খুলে যখন নিয়ে যাচ্ছে বললাম-‘এটা খুলছো কেন? এটা দিয়ে কি করবে? ছেলেটা একটু আলতো হেসে বললো-‘আপনার এত দামি ঘড়ি পড়তে ইচ্ছে করে আমার করে না। ছেলেটা হাত ঘড়িটা খুলে নিল।

এরপর বাঁ হাতের সোনার আংটিটা দেখিয়ে বললো- ‘ওটা খুলুন।

বললাম-“কি ? হচ্ছে কি?

ছেলেটা বললো-” আপনাকে না বলেছি। এখানে শয়তানের বাবাও আমাকে ভয় করে চলে। আপনাকে বাঁচানোর জন্য এখানে আর কেউ আসবে না। ভালো চান তো খুলে দিন না হলে … । পকেটের মধ্যে থেকে একটা ছুড়ি বের করে বললো-— এটা কি দেখেছেন
তো ?

বাঁ হাতের আংটি দুটো খুলে নিয়ে বললো-‘মানি ব্যাগটা দিন।’ আমার প্যান্টের পেছন পকেট থেকে ছোঁ মেরে মানিব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। একটু রেগেই তাকে বললাম-‘দেখ অসভ্যতা করছো তুমি।

শুনে সে কোন উত্তরই করেনি। বরং পায়ের জুতাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো-“বেশ দামি আপনার জুতাগুলো । বেশ দাম দিয়ে কিনেছেন নিশ্চয়ই? বললাম-‘আমি কি রাস্তার ফকির নাকি, জুতা দামি হবে না।

তাহলে খুলুন।

চারদিকে খুটখুটে অন্ধকার। আশপাশের দিকে তাকিয়ে কোন মানুষের চিহ্ন তো দূরের কথা একটা পাতার শব্দও পেলাম না। শীতের রাত্রি; শিশির পড়ার শব্দ পেলাম টুপ করে। কিন্তু পায়ের জুতাগুলো নিয়ে সে শান্ত হয়নি, শরীরে জড়ানো শালখানার দিকে তার লোলপদৃষ্টিতে সে চাদরখানাও আমাকে খুলতে হয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে শীতে ঠকঠক করছি। শরীরের পাতলা গেঞ্জিটা রেখে সবকিছু খুলে নিয়ে গেল। খুব অনুরোধ করলাম-‘ভাই এই শীতের রাত্রি সব কিছু নিয়ে গেলে তুমি সার্টটা ফেরত দাও অন্তত।

ছেলেটা একটু ডাট্টাচ্ছলে বললো-নিতে তো ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সব কিছুই আপনার দামি। কি আর করা বলুন। এটলিস্ট আমার তো লস করা চলে না!

অন্ধকারের মধ্যে ছেলেটা আমার সামনে থেকে সরে পড়লো। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আর কি ই বা করবো; ছেলেটার হাতের ছুড়িটা বেশ চকচকে ছিল। ওটা দিয়ে একটা গুতো দিলে গলগল করে রক্ত ঝড়তো আমার।

কি বল তুমি ঝড়ত না?

এবার বললম-‘হ্যাঁ আপনি ভালোই করেছেন। ছেলেটাকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও ছেলেটা আপনার পেটে একবার ছুরিটা দিয়ে আঘাত করলেই আপনি শেষ।

‘কিন্তু’ ।

‘কিন্তু আবার কি?

না ভাবছি। এত বড় একটা আয়োজন করে আপনাকে সংবর্ধনা দিবে!

আমাদের বলেন নি কেন?

আর তোমাকে বলা । যে সংবর্ধনা পেয়েছি !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top