পুলিশ সহকর্মীদের যৌন হয়রানির শিকার নারী পুলিশ
অপরাধ প্রতিবেদকঃ ‘ওসি নিবারণ সাক্ষাতে ও ফোনে আমাকে বলতে থাকেন, আমাকে তাঁর অনেক ভালো লাগে। আমি দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। আমি তাঁর কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমার স্বামীকে বাসা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে শিবিরকর্মী সাজিয়ে মামলা দিয়েছেন।’
রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ বর্মণের বিরুদ্ধে গত মার্চ মাসে যৌন হয়রানির এই অভিযোগ যিনি তোলেন, তিনিও পুলিশের একজন সদস্য। কর্মরত আছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক হিসেবে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগে এভাবেই বর্ণনা দেন কর্মক্ষেত্রে নিজের যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা।
শুধু ওই নারী পরিদর্শক নন, কর্মক্ষেত্রে নিজ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন কোনো কোনো নারী পুলিশ সদস্য। অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দিলে বদলি-বিভাগীয় মামলার হুমকি, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ; এমনকি পোশাক নিয়েও বাজে মন্তব্য করেন কতিপয় ঊর্ধ্বতন ও একই র্যাঙ্কের পুরুষ পুলিশ সহকর্মীরা। বাহিনীটির সশস্ত্র ও নিরস্ত্র দুই বিভাগেরই কনস্টেবল, নায়েক, এএসআই, এসআই পর্যায়ের নারী পুলিশ সদস্যরা এমন হয়রানির শিকার হন বলে এক জরিপে উঠে এসেছে।
‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার ও উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ের মতামত’ শিরোনামে সম্প্রতি জরিপটি চালিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। রেঞ্জ, মেট্রোপলিটন, পার্বত্য অঞ্চল ও বিশেষায়িত ইউনিটের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদবির ৪৪১ জন পুলিশ সদস্য এই জরিপে অংশ নেন। জরিপে একাধিক প্রশ্নের মধ্যে একটি ছিল: কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশ সদস্য যৌন হয়রানির সম্মুখীন হন কি? জরিপে অংশ নেওয়া নারী ও পুরুষ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৩৪৬ জন এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩৮ জন অর্থাৎ উত্তরদাতাদের প্রায় ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন, নারী সদস্যরা হয়রানির শিকার হন। এরপর জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্য থেকে ১২ জনের কাছে আলাদাভাবে জানতে চাওয়া হয় তাঁরা যৌন হয়রানির শিকার হন কিনা। তখন তাঁদের মধ্যে ৮ জন হাঁ সূচক জবাব দেন।
এর আগে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন। উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক পদের নারী কর্মকর্তাদের শতকরা ৩ ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। এ ছাড়া ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশ সদস্যরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন। তবে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক তখন বলেছিলেন, এ ধরনের তথ্য একেবারে ভিত্তিহীন।
১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ নারী কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে নারী পুলিশের সদস্যদের যাত্রা শুরু। চলতি বছর পর্যন্ত বাহিনীতে নারী সদস্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ১৬৩ জন, যা পুলিশবাহিনীর মোট সদস্যের ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ।
বোয়ালিয়া থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ওই নারী পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আমার মতো এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একটা সময় বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্য হিসেবে নিজেকে নিয়ে অনেক গর্ব করতাম। কিন্তু পদে পদে এত হয়রানির শিকার হয়েছি যে, এখন আর গর্ব করতে পারি না। বাহিনীতে গুটিকয়েক এমন খারাপ সদস্যের উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারলে, এই যৌন হয়রানি সংক্রমিত হতেই থাকবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসআই র্যাঙ্কের এক নারী সদস্য জানান, দুই বছর আগে এক রাতে তিনি ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই সময় এক পুরুষ সহকর্মী তাঁকে খারাপ ইঙ্গিত দেন। পরদিন তিনি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানান। এরপর বিষয়টি গোপনেই সমাধান করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি ও উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আমেনা বেগম বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশ সদস্যরা যে যৌন হয়রানির শিকার হন, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমরা এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে তাঁর ইউনিটের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা বলে থাকি। তবে অনেকেই এসব বিষয়ে মুখ খুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। যার কারণে অনেক ঘটনাই আবার জানতে পারি না। যাঁরা যথাযথ মাধ্যমে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট শাখাকে (ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড–ডিএনপিএস) বিষয়টি অবহিত করেন, দ্রুত তদন্ত করে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএনপিএস) বিভাগ। এই বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল হক বলেন, ‘এসব ঘটনায় আমরা সব সময় আমাদের নারী সহকর্মীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিই। যদি তাঁর সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ ঘটে থাকে, তাহলে আমাদের জানানোর পাশাপাশি তিনি নিয়মিত মামলা করতে পারেন। উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্কে জানাতে পারেন। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড বিভাগ বরাবর লিখিত দিতে পারেন। তা ছাড়াও, আইজিপি অভিযোগ সেলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা মিললে দোষীকে শাস্তি দেওয়া হয়।’
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, ‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো পেশাদার বাহিনীতে এসব ঘটনা একটু বেশি দুঃখজনক।’ পুলিশের নারী সদস্যদের নিয়ে যে সংগঠনটি আছে অর্থাৎ বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন খুশী কবির।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন ও অপারেশন) মো. মইনুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আপনি যে বিষয়টা বলছেন, সেটা আমাদের ডিপার্টমেন্টাল জরিপে উঠে এসেছে। যেহেতু এটা পুরো বাহিনীর বিষয়, আমি ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারি না। যাঁরা এ বিষয়ে দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন।’