ডাক্তাররাতো ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে না – স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খুরশীদ আলম

ডাক্তাররাতো ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে না – স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খুরশীদ আলম

স্বাস্থ্য প্রতিবেদকঃ সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু সংবাদের সমালোচনা করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রাখায় জনস্বাস্থ্যবিদদেরও একইসঙ্গে সমালোচনা করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্যবিদদের উদ্দেশ করে অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘তারা কোনও রোগীর পাশে দাঁড়াননি, আমাদের অধিদফতরে আসেননি। তারা নিরাপদ বাক্সে বসে নানান ধরনের বিভ্রান্তিরকর তথ্য দিচ্ছেন। আর এর মাধ্যমে তারা দেশবাসীকে এবং আমাদের বিভ্রান্ত করছেন।’

বুধবার (১৪ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতরে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। গণমাধ্যমে এমন কিছু সংবাদ এসেছে যাতে করে তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক।

সংবাদ সম্মেলের শুরুতে তিনি বলেন, ‘আজ অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মনে এখানে এসেছি। আমাদের এই করোনা অতিমারিতে যে মৃত্যুর মিছিল, তাতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত।

এই অতিমারির সময়ে যেখানে সাংবাদিক ভাইবোনদের সহযোদ্ধা হিসেবে মানি, যেভাবে গণ্য করে এসেছি এবং তাদের সহযোগিতা নিয়েই এই যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখতে পাচ্ছি, কিছু কিছু গণমাধ্যম এমনভাবে সমালোচনা করছে, যেটা আমাদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। সারা পৃথিবীতে কোথাও এমন নজির নেই যে, যারা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যান তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য সমালোচনা করা হয়। সমালোচনা করা হবে তাদের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘করোনাকালের সব কর্মকাণ্ড প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিচালনা করছেন। সেখানে আমাদের ভুল করে অন্য পথে চলে যাবার অবকাশ একেবারেই নেই।’

‘তারপরও আমরা মানুষ। আমরা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে না, আমাদেরও ভুলত্রুটি হতে পারে। সেই ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনারা আছেন, আপনারা আমাদের পথ দেখাবেন, আমরা আমাদের শুদ্ধ করবো। কিন্তু এমন একটা মুহূর্তে যদি আমাদেরকে বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি করেন, তাহলে আমাদের মনোবল ভেঙে যাবে’, বলেন তিনি।

অধ্যাপক খুরশীদ আলম বলেন, ‘ডাক্তার, নার্সসহ যারা একটা বছর ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তারা মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন। তারা অত্যন্ত চাপের মধ্যে আছেন, দিনের পর দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তারা প্রতিদিন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে আপনাদের কাছে আমরা সমবেদনা, সমব্যথী হওয়া এবং আমাদের সঠিক পথ নির্দেশনা আশা করছি। সেটা না করে এই মুহূর্তে যদি বিরূপ সমালোচনায় মেতে থাকেন…। আমি সবাইকে বলছি না। আমি বেশিরভাগ সংবাদকর্মীদের দেখছি, আমাদের সঙ্গে আছেন। কেউ কেউ করছেন, কেন করছেন আমি জানি না। এই ত্রুটি আমাদের হতে পারে, থাকতে পারে, কিন্তু এটা সেই সময় নয়।’ তাহলে পরে আমাদের সবার মানসিক অবস্থা কেমন দাঁড়ায়, সেটা কি আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন প্রশ্ন করেন তিনি।

মহাপরিচালক বলেন, ‘‘আমি সবাইকে বিনীতভাবে অনুরোধ করি, দয়া করে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করবেন। আপনারা ইদানিং যেসব বিষয় তুলে এনেছেন, আমাদেরকে সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, আমি সেগুলোর কিছু উত্তর দিতে চাই। কিছুদিন আগে এক টেলিভিশন নিউজে বলা হয়েছে— বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার উধাও করে দিয়েছি।’

এই ‘উধাও’ শব্দের মধ্যে একটা অপমানজনক ব্যাখ্যা আছে। আমরা সেটা বলতে চাই না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘উনি কী বুঝাতে চেয়েছেন উনি জানেন না এবং আমরা বলেছি, বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার যে পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিত বিদ্যমান ছিল না বিধায়, সেখানে অনেক মূল্যবান যন্ত্রপাতি ছিল, অনেক বিছানা ছিল। সারা দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এবং বিভিন্ন হাসপাতালে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছি।’

‘সেটার লিস্ট, টিস্যু পেপারের লিস্ট আমি কোথায় দিয়েছি, আমার কাছে রয়েছে।’ এসময় তিনি সাংবাদিকদের সেই লিস্ট দেখার জন্য তাদের (অধিদফতরে) কাছে যেতে বলেন।

তিনি বলেন, ‘কেন সেটা করা হয়েছিল, তার ব্যাখ্যাও রয়েছে। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জনবল সব মিলিয়ে সেখানে প্রতিদিন ৬০ লাখ টাকা খরচ হতো। অথচ ওখানে ১৫ থেকে ২০ জনের বেশি রোগী থাকতো না। চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে হাজারের বেশি মানুষ নিয়োজিত ছিল। কিন্তু তখনকার অবস্থায় যেহেতু ওটা প্রয়োজন ছিল না, তাই সেটা ডিসমেন্টাল (সরকারিভাবে বন্ধ) করে দেওয়া হয়েছে।’

একইসঙ্গে মহাখালীর ডিএনসিসি আইসোলেশন সেন্টার নিয়েও অনেক ভুল সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, ‘অথচ এই সেন্টারের ৯ তলায় ২০০ শয্যার আইসিইউ চালু করা হচ্ছে এই সপ্তাহেই। বাকি তলার প্রতি জায়গাতে প্রায় সাড়ে ৯০০ বিছানা দেওয়া হচ্ছে, যার প্রতিটির সঙ্গে অক্সিজেনের সংযোগ রয়েছে।

আপনারা বলছেন, আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়াইনি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের জনস্বাস্থ্যবিদরা যারা একদিনও কোনও রোগীর পাশে দাঁড়ান নাই, তারা রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ছিলেন।’ তারা তখন কী করেছিলেন প্রশ্ন করে স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, ‘তারা এখন টেলিভিশনের টকশোতে লম্বা লম্বা কথা বলেন।

আমি বলি, আমাদের পাশে আসেন। আপনার যে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান রয়েছে, তাকে কাজে লাগাই। আপনি আমাদের সহযোদ্ধা হন, আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে চলুন, হাসপাতালে রোগীর পাশে দাঁড়াই। সেটা না করে ওই নিরাপদ বাক্সের মধ্যে বসে, এই টেলিভিশন থেকে ওই টেলিভিশন, ওই টেলিভিশন থেকে ওই টেলিভিশনে গিয়ে নানানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা দেশবাসীকে যেমন বিভ্রান্ত করছে, আমাদেরকে আশাহত করছে। আমাদেরকে কাজ থেকে মন ফিরিয়ে দিচ্ছে।’

অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, আপনারা বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ। এই সরকারের চাকরি করেছেন আপনারা, এই সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। আজকে আপনারা রিটায়ার করেছেন। যে কাজটা আগে আপনি করতেন, সেই কাজের বিরূপ সমালোচনা করতে পারেন না। এটা অন্যায়, গর্হিত অন্যায়। দেশবাসীর প্রতি আপনার, আপনাদের যারা এটা করছেন, সবার দায়িত্বহীনতার পরিচয়।’

তিনি বলেন, ‘আজকে আমার ভাষা রূঢ় মনে হতে পারে। আমার বক্তব্য আপনাদের কাছে খারাপ মনে হতে পারে, হতে পারে আমি ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি আমার দেশের পক্ষ থেকে, আমার জনগণের পক্ষ থেকে, আমার নেত্রীর পক্ষ থেকে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পক্ষ থেকে, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে শুধু প্রতিবাদের ভাষাটা জানালাম। এটা আপনাদের কাছে বিরূপ মনে হতে পারে। আমার কিছুই করার নেই।’

‘তবে যদি ভুল কিছু বলে থাকি, আপনারা আমাকে কলম দিয়ে ঘায়েল করবেন। আমার বিরুদ্ধে লিখবেন, বক্তব্য দেবেন। আমি সেগুলো শুনবো, মাথা পেতে নেবো। কিন্তু আপানারা চিন্তা করে দেখেন, এই মুহূর্তে ডাক্তারদের সমালোচনা করেন— ডাক্তাররাতো ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে না। ডাক্তারদের অনেক ভুল ত্রুটি আছে, কিন্তু তারা মানুষ, আপনাদের বুঝতে হবে। এই সীমাবদ্ধ সম্পদের মধ্যেও আপনাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে’, যোগ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top