রিফাতকে রক্ষায় নয়ন বন্ডকে ঠেকাতে অভিনয় করেছে মিন্নি!
মিন্নির হাবভাব ও গতিবিধি দেখে মনে হয় তার পরিকল্পনাতেই হত্যার ঘটনা
রিফাতকে রক্ষায় নয়ন বন্ডকে ঠেকাতে অভিনয় করেছে মিন্নি!
বরগুনার রিফাত শরীফকে হত্যা পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা (মাস্টারমাইন্ড) ছিলেন তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তার এই উদ্যোগে আসামি নয়ন বন্ড সাড়া দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। ঐ পরিকল্পনা প্রণয়নের পরই নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ অন্য আসামিরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে মর্মে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামানের রায়ে উঠে এসেছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী যখন রামদা দিয়ে ভিকটিম রিফাত শরীফকে কোপাচ্ছিল তখন নয়নকে ঠেকাতে মিন্নির চেষ্টা ছিল অভিনয় মাত্র। এই অভিনয়ের আড়ালে সুকৌশলে আসামি রিফাত ফরাজী যাতে ভিকটিম রিফাত শরীফকে আঘাত করতে পারে সেই সহায়তা করে মিন্নি। এর ফলে মিন্নির কারণেই রিফাত নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার বয়সি মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
রায়ে বিচারক বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের দুটি ভিডিও ফুটেজ এই মামলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত সাক্ষ্য। ঐ ফুটেজ দুটিতে থাকা ঘটনার সময় মিন্নির ভূমিকা বিশ্লেষণকালে আসামি নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী ক্যালিক্স একাডেমির সামনে ভিকটিমকে (রিফাত) রামদা দিয়া এলোপাতাড়িভাবে কোপানোর দৃশ্যটি দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মিন্নি ঐ সময় তার স্বামী রিফাতকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল বলে মনে হয়। কিন্তু দৃশ্যটি একটু মনোযোগ সহকারে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন সামনে আসে যে, ঘাতকরা যখন তার স্বামীকে কোপাচ্ছিল তখন সে তাকে রক্ষার জন্য তার সামনে ঢাল হয়ে না দাঁড়িয়ে নির্ভীকভাবে ঘাতকদের একজন নয়ন বন্ডকে বারবার জড়িয়ে ধরে ও তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করছিল কেন? ঐ সময় উক্ত ঘাতক/ঘাতকরা তাকে কোনোরূপ আঘাত বা একটি ধাক্কাও মারল না কেন? উল্লিখিত অবস্থা উক্ত ঘাতক/ঘাতকদের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে।
মিন্নির গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক
রায়ে বলা হয়, প্রথমোক্ত ভিডিও ফুটেজে থাকা কলেজের গেটের দৃশ্য বিশ্লেষণে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। উক্ত দৃশ্যে আসামি মিন্নি তার স্বামীর সঙ্গে কলেজের গেট দিয়ে বের হয়ে গেটের বিপরীত পার্শ্বে থাকা রিফাত শরীফের মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে তাতে না উঠে গেটের দিকে ফিরে যায় ও কৌতূহল দৃষ্টিতে আশপাশে তাকায়। ঐ সময় তাকে ফেরানোর জন্য তার স্বামী পেছনে পেছনে দৌড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং এর পরপর আসামি রিফাত ফরাজী গং ভিকটিম রিফাতকে ধরে মারপিট ও টানাহেঁচড়া করতে করতে ক্যালিক্স একাডেমির দিকে নিয়ে যায়। এই সময় মিন্নি তাদের পেছনে পেছনে এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছিল যেন উক্তরূপ কিছুই ঘটছে না এবং তার অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব ও গতিবিধিতে তার সামনে লোকজন যে তার স্বামীকে ধরে মারপিট করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল তার কোনো প্রতিক্রিয়াই ছিল না। বরং তার উক্ত অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব ও গতিবিধি দেখে উল্লিখিত ঘটনা তার কাঙ্ক্ষিত মতে ঘটছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজ এলাকায় দিনে-দুপুরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীসহ এক দল তরুণ। এই নয়ন ছিল ‘০০৭’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান। বরগুনা শহরে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় নয়ন ও রিফাত ফরাজীরা মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এই হত্যাকাণ্ডের পর এই মামলার প্রধান আসামি নয়ন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এই মামলায় মিন্নি, রিফাত ফরাজীসহ ছয় আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। খালাস দেওয়া হয়েছে চার আসামিকে।
ঠ্যাং ভাঙার পরিকল্পনার সঙ্গে রামদাও কেন
মৃত্যুদণ্ডের ঐ রায়ে বলা হয়েছে, আসামি রিফাত ফরাজী ও মিন্নি তাদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঘটনার পরিকল্পনা হিসাবে যেটুকু স্বীকার করেছে সেই অনুযায়ী তাদের পরিকল্পনা ছিল ভিকটিম রিফাতকে মার দিয়া বা ঠ্যাং ভেঙে শিক্ষা দেওয়া সংক্রান্ত, হত্যার জন্য নয়। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণ ও নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঘটনার পূর্বে ঘটনাস্থলের পার্শ্বে দুটি রামদাও এনে রাখা হয়। যা দ্বারা ঘটনার সময় ভিকটিমকে কোপানো হয়। সাধারণ মার দেওয়া বা ঠ্যাং ভাঙার পরিকল্পনার সঙ্গে উক্ত রামদা রাখা আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে। যা ভিকটিম রিফাত শরীফকে হত্যার পূর্ব পরিকল্পনাকেই নির্দেশ করে।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, যুক্তি উত্থাপিত হতে পারে যে ভিকটিমকে কোপানোর পরিকল্পনার সঙ্গে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী ছাড়া মিন্নি বা অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। মিন্নি কেবল তার দোষ স্বীকারের জবানবন্দিতে ভিকটিমকে মার দেওয়া বা ঠ্যাং ভাঙার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা বলেছেন। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ভিডিও ফুটেজে থাকা ঘটনার সময় আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বী আকন, টিকটক হূদয়, সিফাত, মো. হাসান ও মিন্নির ভূমিকা পাশাপাশি বিশ্লেষণ করলে ঐ সময় তাদের অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব, গতিবিধি ইত্যাদি হতে এটা সুস্পষ্টভাবে পরীলক্ষিত হয় যে , ঘটনার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত আসামিদের ভূমিকা আদৌ বিচ্ছিন্ন ছিল না। আসামি রিফাত ফরাজীর নেতৃত্বে তাদের দলীয় কার্যক্রম ছিল এবং ঘটনায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
হত্যা পরিকল্পনার অডিও/ভিডিও না থাকলেও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তা প্রমাণিত হয়
রায়ে বলা হয়েছে, প্রসিকিউশন কেস অনুযায়ী ঘটনার পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটে গত বছরের ২৫ জুন সকালে আসামি নয়ন বন্ডের বাসায়। ঐদিন নয়ন বন্ড ও মিন্নির আলোচনা এবং পরবর্তীতে ঐদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় বরগুনা সরকারি কলেজের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আসামি নয়ন, রিফাত ফরাজী গংদের বৈঠতে তা চূড়ান্ত হয়। উক্ত শহিদ মিনার কলেজের মধ্যে এবং কলেজের গেটে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। তবে শহিদ মিনারে উক্ত পরিকল্পনা বৈঠক সংশ্লিষ্ট সময়ের কোনো ভিডিও ফুটেজ বা উক্ত পরিকল্পনা সম্পর্কিত অন্য কোনো অডিও/ভিডিও রেকর্ড জব্দ কিংবা কোর্টের সামনে উপস্থাপিত হয়নি। এছাড়া এই পরিকল্পনা বৈঠকের কোনো চাক্ষুস সাক্ষীও এই মামলায় সাক্ষ্য দেয়নি। অবশ্য কোনো অপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র সাধারণত গোপনে হয়ে থাকে এবং তা ঘটনার পরে প্রকাশিত হয়। এই পরিকল্পনার প্রেক্ষাপট হিসেবে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির প্রেম ও বিয়ে এবং ঐ বিয়ে বলবত থাকা সত্ত্বেও রিফাত শরীফকে বিয়ে করা, নয়নের জন্মদিনে মিন্নির উপস্থিতি ও নয়নের বন্ধু হেলাল কর্তৃক মোবাইল ফোনে উক্ত ভিডিও ধারণ ও তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা, পরে ভিকটিম কর্তৃক ঐ ফোন নিয়ে আসা এবং তা নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাত শরীফের মনোমালিন্য ও আসামিদের গালমন্দ ও মারধর ইত্যাদি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।