ভূতরাজা – এম.এ.সিরাজী( মুশফিকুল আনোয়ার সিরাজী)
প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে নাকে মুখে চাদর পেঁচিয়ে হেঁটে চলেছে আবীর। অনেক রাত হয়ে গেছে। গতকাল তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হাতে এখন অফুরন্ত সময়। আজ বিকেলে সে গিয়েছিল বন্ধু জামিলের বাড়ি। তার বাবা বিদেশ থেকে তার জন্য কি একটা কালো বক্স পাঠিয়েছে। কি যেন বলেছিল নামটা? ঠিক মনে পড়ছে না তার । ইংরেজি নাম তো তাই হয়তো মনে পড়ছে না আবীরের । ইংরেজিতে সে বরাবরই কাঁচা। চারকোনা একটা কালো বক্স। তাতে আবার ডিস্ক ঢোকানো যায়। বাজারে দেখেছে এমন বক্সের মাঝে ডিস্ক ঢুকিয়ে বড়রা সিনেমা দেখে। জামিলের এই কালো বক্স টিভিতে লাগিয়ে শুধু সিনেমা না অনেক ধরণের খেলাও খেলা যায়। গাড়ি চালানো যায়, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা যায়। আরো কতকিছু যে খেলা যায় তার হিসাব নেই। সব বড়লোকি কাজকারবার। জামিলের বাবা বিদেশ করে আজ অনেক বছর। গ্রামের সবচেয়ে বড় পাকা দালান তাদের। এই এক বক্সের কারণে স্কুলে জামিলের জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে গেছে। সবাই এই বক্স নিয়ে খেলতে চায়। সবাই চায় জামিলের বন্ধু হতে। জামিল আবার আবীরকে অনেক পছন্দ করে। তাইতো পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই আবীরকে ডেকে নিয়ে গেছে তাদের বাড়িতে। সেই বিকেল থেকে তাদের খেলা শুরু। বক্সটা টিভির সাথে লাগিয়ে খেলতে হয়। কিভাবে কি করতে হয় বুঝতে একটু সময় লাগলেও আবীর আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেল। তার হাতে আর একটো ছোট যন্ত্র আছে। তাতে অনেকগুলো সুইস। সুইসগুলো চেপে চেপে খেলতে হয়। কি অদ্ভুত ব্যাপার। হাতের যন্ত্রে ডানে চাপলে টিভিতে গাড়ি ডানে যায়। বামে চাপলে যায় বামে। যুদ্ধ খেলার সময় সুইস চাপলে গুলি বের হয়। সে গুলিতে ধ্বংস হয়ে যায় সব শত্রু। আবীর আর জামিল মিলে কতক্ষণ গাড়ি চালালো, কতক্ষণ যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের মেরে ধ্বংস করল। এই করতে করতে মাগরিবের সময় হয়ে এলো।
‘জামিল দোস্ত, অনেক মজা পেয়েছিরে খেলে। এখন যাই, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।’
‘আরে এখন কই যাবি! পরীক্ষা শেষ, এখনতো আমাদের ছুটি, একটু দেরী হলে কিছু হবে না। আর একটা খেলা আছে, ভূতের খেলা ওটা খেলে যা।’
জামিলের পিড়াপীড়িতে আবীর রাজি হলো আর একটু থেকে যেতে। তার নিজেরো অনেক কৌতূহল হলো ভূতের খেলাটা খেলার। আসলেই তো, পরীক্ষা তো শেষ। একটু দেরী হলে কি আর এমন হবে।
এত ভয়ংকর কোন খেলা আবীর আগে কখনো খেলেনি। শ্বাপদের মত ভয়ংকর, হিং¯্র আর কুৎসিত একগাদা প্রাণী দিয়ে ভর্তি একটা বাড়ি। তাদের কাজ হলো ওই বাড়ি থেকে রাজকুমারীকে বাঁচানো। প্রাণীগুলো যতটা কুৎসিত, রাজকুুমারী ঠিক ততটাই সুন্দর। আবীরের মনটা হু হু করে উঠলো, এত সুন্দর একটা রাজকুুমারী আর তাকেই কি না বন্দী করে রেখেছে এই ভূতগুলো। যে করেই হোক রাজকুমারীকে মুক্ত করতেই হবে। আবীর আর জামিল লেগে গেলো রাজকুমারীকে উদ্ধারের কাজে। খেলাটা যতটা ভয়ংকর ঠিক ততটাই কঠিন। বলা নাই কওয়া নাই হুটহাট গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণীগুলো। কতবার যে ভয়ে তাদের মুখ থেকে চিৎকার বের হয়েছে সেটা তারা দুইজনও বলতে পারবে না। তাদের এই চিৎকার শুনে জামিলের মা ছেলেরা কি করছে তা দেখতে এসে দেখলেন, টিভির পর্দায় ভয়ংকর কতগুলো প্রাণী ভাসছে আর ছেলেরা সেগুলোকে অতি আগ্রহভরে গুলি করছে। সারা ঘর ফেটে যাচ্ছে গুলির শব্দে আর অদ্ভুত প্রাণীগুলোর আর্তনাদে। এই কেয়ামতসম দৃশ্য জামিলের মা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না। কতক্ষণ জামিলকে আর কতক্ষণ জামিলের বাবাকে বকতে বকতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। শুধুমাত্র পরীক্ষা শেষ বলে রক্ষা। নইলে নিশ্চিত বকার সাথে সাথে কিছু উত্তমমধ্যমও জুটতো তার কপালে। জামিলও এই সুযোগটা নিল। মায়ের বকার দিকে মনোযোগ না দিয়ে এত কঠিন যে তারা কিছুতেই শেষ পর্যন্ত যেতে পারছে না। অবশেষে প্রায় ঘন্টা তিনেক চেষ্টার পর তারা শেষ করতে পারলো খেলাটা। খেলা শেষে রাজকুমারী যখন এসে ধন্যবাদ দিল দুইজনই লজ্জ্বায় লাল হয়ে গেল। মনে যেন একটা প্রশান্তি বয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল আবির, রাত এগারোটা বাজে। লাফিয়ে উঠল সে। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। জামিলের মা অনেক করে বারণ করলেন এতো রাতে না যেতে। কিন্তু আবীর রাজি হলো না। বাসায় বলে আসেনি সে। ফিরে তাকে ে যতেই হবে। শেষমেশ জামিলের মা তার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিলেন যাতে রাতের ঠান্ডায় আবীরের যেতে কোন কষ্ট না হয়।
আবীর এখন সেই চাদরমুড়ি দিয়ে দ্রæতপায়ে বাড়ির পথে হেঁটে যাচ্ছে। আজ কপালে অনেক বকা আছে। এর আগে কখনো বাড়ি ফিরতে তার এত দেরি হয়নি। বলা যায় না দুইএকটা চড়ও জুটে যেতে পারে। কেউ না মারলেও বড়ভাই যে কানে দুইটা ডলা দিবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। এইসবের মাঝেও রাজকুমারীকে মুক্ত করতে পেরেছে এই কথা মনে হলেই তার মনে একটা সুখের হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছে। রাজকুমারী যখন ধন্যবাদ দিচ্ছিলো তখন তাকে ঠিক পরীর মত লাগছিলো। কি মিষ্টি তার আওয়াজ! একটাই আফসোস, রাজকুমারী ধন্যবাদ দিতে গিয়ে কি বলেছে তা সে বুঝে উঠতে পারে নি। এই ইংরেজিটাই মেরে দিল। নাহ্! আজ থেকে বড় ভাইয়ের কাছে ইংরেজি শেখা শুরু করবে সে।
এই সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে আবীর হেঁটে চলছিল। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। অনেকক্ষণ থেকেই পেছন থেকে খসখস শব্দ আসছে। আবীর হাঁটার গতি আরো বাড়ালো। পেছন থেকে খসখস শব্দটাও তার হাঁটার গতির সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে গেলো।
‘কে? কে ওখানে?’- আবীর হাঁক ছাড়লো। কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিল না। আবীর একটু অনিশ্চিত ভঙ্গিতে পেছনে তাকালো। কাউকে দেখতে পেলো না। হয়তো একটানা অনেকক্ষণ ভুতের খেলা খেলে এখন মনের ভ্রম হচ্ছে। আবীর আবার হাঁটা শুরু করে দিল। হুম যা ভেবেছিল সে। মনের ভ্রমই। এখন আর কোন খসখস শব্দ আসছে না।
আর কিছুদূর যেতেই হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তার সামনের মাটি দুভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। আবীর প্রচÐভয় পেয়ে গেল। কোন মতে একটা গাছ আঁকড়ে ধরে নিজের পতন ঠেকালো। ফাঁক হয়ে যাওয়া মাটি থেকে বিকট এক হাসির শব্দ আসতে লাগলো। আস্তে আস্তে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এলো দানবটা। আরে! এতো ভূতের খেলার রাজাটা। এই ভূতরাজাই তো বন্দি করেছিল রাজকুমারীকে। আত্মা শুকানো হাসি দিয়ে বের হয়ে আসলো ভূতরাজা। মাটি থেকে ঠিক চারফুট উপরে ভাসতে লাগলো। আবীরকে দেখে দানবীয় গলায় ইংরেজিতে কিছু একটা বলে গেল। এই সেরেছে, এই ইংরেজিতেই তো আবীর কাঁচা। আর এই দানব কথা বলছে ইংরেজিতে। মনে হচ্ছে খুব রেগে আছে। নিজের দুই গালে কষে দুইটা চড় মারতে মন চাইলো তার। এই ইংরেজী শেখার জন্য বড়ভাই কতবার বলেছে। সে পাত্তা দেয়নি। আর এখন ইংরেজি না পারার কারণে বুঝতে পারছে না ভূতরাজার কথা।
ভূতরাজা কথা বলেই চলছে। হাত পা নাড়িয়ে, আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে ভূতরাজা আবীরকে শাসাচ্ছে। আবীর এক পর্যায়ে ভয়ে ভয়ে বলে উঠল,
‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে আমি। ইংরেজি বুলিতে করি না ভয়। সাহস থাকলে বাংলায় বলে দেখা কি বলতে চাস। এরপর হবে সমানে সমানেে মাকাবিলা।’
ভূতরাজা যেন একটু থমকে গেল। এরপর স্পষ্ট বাংলায় বলে উঠল, ‘রাজকুমারীকে আমার কাছ থেকে মুক্ত করার দুঃসাহস যে দেখায় তাকে আমি ছেড়ে দেব না। আজ এখনই তোর ঘাড় আমি মটকাব।’
ভুতরাজার কথা শুনে ঘাবড়ে গেল আবীর। এই ভূতরাজা হলোে খলার সবচেয়ে কঠিন একটা অংশ। জামিল আর আবীর খেলাতে প্রায় ছয়বারের চেষ্টায় ভূতরাজাকে তাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। কে জানতো ভূতরাজা খেলা থেকে বের হয়ে তাকে রাস্তায় আক্রমণ করবে। ভয়ে কোন কথা আসছিলো না মুখ দিয়ে। ঐদিকে ভ‚তরাজা বলেই চলছে, ‘ ‘তোকে মেরে আমি আবারো বন্দি করবো রাজকুারীকে। রাজকুমারী আমার বন্দি হয়ে থাকবে অনন্তকাল। কেউ তাকে মুক্ত করতে পারবে না।’
রাজকুমারীর কথা শোনার সাথে সাথেই আবীরের সব ভয় কেটে গেল। সে জায়গায় ভর করলো প্রচÐরাগ। কতবড় সাহস, আবার রাজকুমারীকে বন্দি করার কথা বলে। এর একটা সমাধান করতেই হবে।
‘আরে ভূতরাজ, এতো যদি তোমার ক্ষক্ষমতা তাহলে আমার থেকে দূরে গিয়ে ভেসে আছো কেন? সাহস থাকে তো আমার সামনে আসো।’
সাহস নিয়ে কথা বলায় ভ‚তরাজা রেগে আগুন হয়ে গেল। শাঁই করে আবীরের মুখ বরাবর চলে আসলো সে। আবীরও প্রস্তুত ছিল। ঠাস! গায়ের জোরে একটা চড় বসালো ভ‚তরাজার গালে।
সাথে সাথে বড়ভাইয়ের তীব্র আর্তনাদ কানে আসলো আবীরের। সেই সাথে কানে প্রচÐ ব্যাথা অনুভব করলো আবীর।
‘ওরে বদমাশ! সারা দিন জামিলের সাথে উল্টাপাল্টা খেলা খেলিস আর রাতে ঘুমের মাঝে বড়ভাইকে চড় মারিস! এতো বড় স্পর্ধা! আজ থেকে তোর জামিলের সাথে খেলা বন্ধ। ’
আস্তে আস্তে আবীরের কাছে ঘটনা স্পষ্ট হতে লাগলো। এতক্ষণ তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে। যাক বাবা বাঁচা গেলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তাই দেখে বড়ভাই কান আরো জোরে চেপে ধরলো, ‘ ঘটনা ঘটিয়ে আবার খুব হাসা হচ্ছে? কাল ইংরেজিতে পাঁচটা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত না করলে কপালে ছুটি নেই।’
শাস্তিটা মন্দ না। এই যাত্রায় তাহলে হয়তো ইংরেজিটা শেখা হয়েই যাবে!
লেখক পরিচিতি: এম.এ,সিরাজী
অপরাজিতা ২/এফ,
পশ্চিম মালিবাগ, রমনা .ঢাকা
জন্ম: ২২/০৮/১৯৯০
বাবা: আ.ন.ম. মাসরুরুল হদা সিরাজী
মা: শাহানা সিরাজী
তিনি একজন লেখক,গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্সএবং মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে গ্রাজুয়েট রিসার্চার হিসাবে মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত
বাড়ি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানার সিরাজপুর গ্রামে।