ভুল – সাগর চৌধুরী

Picsart_22-09-30_20-33-02-933-scaled.jpg

ভুল – সাগর চৌধুরী

চায়ের কাপটা সে আমার দিকে দিয়ে বললো, চা নে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই বললাম
চা খুব ভালো হয়েছে।

তাহলে কি কাজ জেনো করিস বললি ?

‘এক গার্মেন্টস মালিকের অফিসে লেখাজোখার কাজ । ধর হিসাবপত্র লেখা, মাস শেষে বেতন দেওয়া । অফিসের জরুরি প্রয়োজনে আউটডোর করা ।

‘মাসে কয় দিন তোর অফিস ’?

‘মাস বলতে বোঝানো কঠিন হবে। তবে সপ্তাহে একদিন অফ ডে বুঝলি’ ।

‘বেতন কেমন’?
‘খারাপ না, যা পাই তাতে চলে যায় । বারতি খরচ নেই তো । চা বিড়ি খাই না, তার উপরে স্ত্রীরও তেমন চাহিদা নেই । বাচ্ছা দুটোর ছোটটা কলেজে পড়ছে আর বড়টা একটা স্কুলের টিচার। খরচ বলতে ওরাই যা করে। তাছাড়া বড়টা স্কুলের টিচার বলে দু’পয়সা রোজগার
করে।

‘ওখানে তোর কেমন চলছে ?

ওখানে আর এখানে বলতে তো কিছু নেই বন্ধু । চাকুরি বাকরি কিছু করছি না। কোন এক সময় করতাম তা বহু আগে । গত বছর পনের হলো নিজের ব্যবসায় আছি। ওখানেই হোটেল ব্যবসা। লোক রাখা আছে তারাই দেখাশুনা করে । আশা করি সেটা ভালোভাবেই
চলবে । তবে বাপের ভিটাতে কি করবো ভাবছি । এটা এমন বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে বুঝলি নিজের কাছেই কেমন খারাপ লাগে। জমিজমাগুলোর ও খোঁজখবর নিতে হবে। বছরের পর বছর সরকারের খাজনা পাতি দেওয়া হয়নি।

‘তাহলে তো তুমি এবার আছো বেশ কয়েক মাস’?

আছি বলতে বিদেশ বিভুই আর ভালো লাগছে না।

‘এখানেই স্থায়ী হও । বাল্য বেলার দু বন্ধু আছি । আশা করি ভালোই হবে।”

‘তা বেশ ভালোই বলেছো। কিন্তু দেশে আসার পর যা শুনছি তাতে তো সে ইচ্ছায় পানি ঢালতে হয় । এমন যদি হয় তবে থাকাটা তো খুবই মুশকিল হবে, কি বল ?

এভাবে গল্পটা হয়তো বোঝা যাবে না । একটু বিষদ আলোচনা করি আমি আর ফরহাদ। একই স্কুল ও কলেজে পড়েছি। পাশাপাশি বসতাম সেই কারণেই
কিনা ওর আর আমার মধ্যে গভীর বন্ধুত্বে রূপ নেয়। বন্ধুতের একটা রূপ আছে যেমন গরিবের সাথে বড় লোকের বন্ধুত্ব তেমন টেকসই হয় না, তার পরে ও কেমন করে যেন এই চল্লিশ বছর টেকসই আছে। ছোটবেলায় ওর মা মারা যাবার পর, বাবার পরে যদি কেউ থেকে থাকে; সে এই আমি।

বাবা মায়ের এত বেশি পয়সা ছিলনা যে আমাকে স্কুল কলেজে পড়ান। সৌভাগ্য বয়ে এনেছে ফরহাদ । সারাক্ষণ একই সাথে থাকতাম বলে ওর বাবাই একদিন ওর সাথে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। যতদিন ও দেশে ছিল আমার খাওয়া পড়ার জন্য কোন কাজ
করতে হয়নি। অবশ্য ইউরোপ যাবার আগে, ও আমাকে বলেছিল রাজি থাকলে কিছু টাকা দিয়ে যাবে, সে টাকা দিয়ে আমি যেন ব্যবসায় করি। আমি বরং রাজি হইনি।
এভাবেই আমার দিন কাটছিল তা বলা যাবে না, ও যাবার পর আমিও অনেক কষ্ট করেছিলাম, বিশেষ করে অর্থ কষ্ট।

এরই মাঝে বাবা এক প্রকার জোর করেই বিয়ে করতে
বাধ্য করলেন। বাবা ভেবেছিলেন বিয়ে করলে হয়তো শশুরের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে কিছু একটা করতে পারবো। কিন্তু বাবার সে আশাও পূর্ণ হলো না। অবশ্য বাবার জীবনের শেষ অংশটা একটু ভালো গিয়েছিল আমার চাকরির সুবাদে। বাবার জন্য আমি সব কিছুর আয়োজন করতাম।

ছেলেবেলায় বাবার পছন্দের বিষয়গুলো দেখে আসছি তাই সেই সব বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতাম। এতে বাবা খুব খুশি হতেন । আর বেশ খুশি হলে বলতেন-‘তোর মা যদি আরো ক’টা দিন বেঁচে থাকতো বুঝলি’।

মাঝে আমার আর ফরহাদের বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। কারণটা কি তা বলা মুশকিল তারপরেও বলা যায় ফরহাদের বিদেশ গমন আর আমার চাকরি।

দীর্ঘকালীন সময় ফরহাদ বিদেশের মাটিতে । তাছাড়া পিছু টান বলে ওর অবশ্য কিছু ছিল
না । মা তো আগেই মারা গেছে। বিদেশে যাবার পর পরই ওর বাবাও মারা যায়। ওখানেই পরবর্তী পড়াশুনা শেষ করে চাকরি বাকরি করে। আজকের বিষয়টা ভিন্ন। বেশ কয়েক বছর পর গত দিনকয়েক আগে বাসার ঠিকানায়
একটা চিঠি আসে। এই সময় কেউ কাউকে চিঠি লিখে না। তবে ফরহাদ আমাকে লিখেছিল। কেন ? কারণটা বেশি কিছু না, আমার কোন মেইল বা সেল নম্বর না থাকার কারণে সে এই পন্থা অবলম্বন করেছে। আর যাই হোক; আমার বাড়ির ঠিকানাটা সে
জানতো। সেই ঠিকানাটাকেই সে কাজে লাগিয়েছে । বন্ধুত্ব বলে কথা।

আজকের দেখা সেই সুবাধেই। আমি একাই এসেছি দেখা করতে, বউর শরীরটা খুব ভালো না, তাই তার আসা হলো না।

ফরহাদকে দেখে খুব পুলকিত হলাম। বাল্যবন্ধু তার উপরে আবার ওর সাহায্যেই আমার পড়াশুনা। আমাকে দেখে ও খুব আনন্দিত হলো। আমাকে ধরে বসিয়ে দিল দামী সোফার উপর। তারপর বললো, তুই তো দেখছি বুড়ো হয়ে গেছিস। তোর কানের কাছের চুলগুলো
সব পেকে গেছে। ওদের ওখানে ৫০ সে যৌবন শুরু হয়, বুজলী ।
আমি ওর কথাগুলো শুনছি আর মনে মনে বলছি, আরে চুল তো সবই পেকে গেছেরে কলপ লাগাই বলে অল্প পাকা দেখা গেল ।

ওর কথাবার্তা শুনে মনে হলো; ওর বয়স সেই যে পঁচিশ বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে; একটুকুও বাড়েনি। এরই মধ্যে একটা ফুটফুটে বাচ্ছা এসে ওর কোলের মধ্যে গড়াগড়ি খেল। আমি হাত বাড়াতেই আমার কোলে এল নানা রকম দুষ্টামির পর বললাম
তোমার দাদু কেমন আছে? সহসা সে উত্তর করলো ভালো। তারপর আলতো করে বললো,
তুমি আমার কি হও ?

আমি তোমার দাদু হই ।

তার দিকে নজর ফেরালাম যখন একটি তেইশ চব্বিশ বছরের মেয়ে হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে এল। মেয়েটি খুব সুন্দর, আমাদের দেশের মেয়েরা যেমন স্বাভাবিক হয় তার চেয়ে সে একটু ভিন্ন।
ভাবলাম বহু বছর দেশের বাহিরে ছিল এরকম একটু অধটু হবেই । বললাম নাতি নাতনি নিয়ে বেশ আছ। আমার এই কথাটায় ওর খেয়াল ছিল বলে মনে হলো না ।
ও বিদেশের কোন এক বন্ধুকে ইমেইল দিতে ব্যস্ত ছিল। এই তার বড় মেয়ে। এই বাচ্ছা দুটো ওর নাতি নাতনি। মনে মনে ভাবছি।

রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। অসুস্থ শরীর নিয়ে অনুপমা আমার জন্য বসে থাকবে না খেয়ে।

কাল আবার সকালে অফিসে যেতে হবে। তাই ও তারা না দিলেও বললাম; কাল সকালে অফিস আছে বুঝলি, না হলে তোর সাথে আরো আড্ডা দিয়ে যেতাম।

ওঠার আগে বললাম তা তোর স্ত্রীকে ডাক; কত বছর পরে এলো একটু কথাবার্তা বলি।

এই লিরা। লিরা । ফরহাদের উঁচু গলা

তেইশ চব্বিশ বছরের সেই মেয়েটি ভেতর থেকে এসে বললো-‘কিছু লাগবে’ ?

ফরহাদ বললো-‘আমার বন্ধু তোমার সম্পর্কে বলছিল; তাই ডেকেছি। বুঝলে আমরা এক সাথে পড়াশুনা করেছি বলতে পারো সে আমার বাল্যবন্ধু। আমার এই বন্ধুটি ভালো বাঁশি বাজাতে জানে। তা কবে শুনাবে বন্ধু’ ?

বললাম-‘আমাকে আর এক দিন ডেকো। সেদিন না হয় শুনিয়ে যাবো। ভেতরের কথা সব সময়ই ভেতরে থেকে যায়। আর প্রশ্ন করলাম না এই মেয়েটি কে ?

ভাগ্যিস আমার সাথে অনুপমা আসে নী । আজ যে কি হতো। ও আজ নির্ঘাত আমাকে খুন করতো। বউকে মেয়ে বলা। নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেলাম।


সাগর চৌধুরী
ঢাকা, গ্রীনরোড। কলাবাগান থানা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top