বিএসসি ইন নার্সিং এর প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ০৬ সদস্যকে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব
অপরাধ প্রতিবেদকঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজসমূহের বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ০৬ সদস্যকে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
দেশে যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস এর মত ঘৃনিত সংস্কৃতির প্রচলন শুরু হয়; র্যাবই সর্বপ্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত প্রতারকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। ইতোপূর্বে প্রতারক চক্রগুলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতারণা করেছে। পরবর্তীতে র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই চক্রগুলো কোনঠাসা হয়ে পড়ে। গত ১৯ মে ২০২২ তারিখে হিডেন স্পাই ওয়্যারলেস কিট ব্যবহার করে সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সিন্ডিকেটের মূলহোতা ইকবাল ও তার অন্যতম ০৩ সহযোগীকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এসকল অসাধু, চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি করে আসছে। গত ২০ আগস্ট ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজের ১ম বর্ষ ফাইনাল বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই আদান প্রদান করার প্রমান পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল ২০ আগস্ট ২০২২ তারিখ পরীক্ষা শুরুর পূর্বে একটি নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে প্রশ্নপত্রের ছবি ও সাদা কাগজে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রের ছবি উদ্ধার করে। ফলশ্রুতিতে র্যাব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর অভিযানে রাজধানীর মহাখালী, ধানমন্ডি ও আজিমপুর এলাকা হতে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূলহোতা (১) ফরিদা খাতুন (৫১), স্বামীঃ মির্জা মোঃ শামীম, পালং, শরীয়তপুর, (২) মোছাঃ মনোয়ারা খাতুন (৫২), স্বামীঃ মোঃ আব্দুল আওয়াল, জাফরপুর, চুয়াডাঙ্গা, (৩) মোসাঃ নার্গিস পারভীন (৪৭), স্বামীঃ নূরে আলম, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ (৪) মোছাঃ কোহিনুর বেগম (৬৫), স্বামীঃ মোঃ শফিকুর রহমান সাদিক, সাঘাটা, গাইবান্ধা, (৫) মোঃ ইসমাইল হোসেন(৩৮), পিতাঃ মৃত সফর আলী, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল এবং (৬) মোঃ আরিফুল ইসলাম (৩৭), পিতাঃ মোঃ রিয়াজ উদ্দিন, কালিহাতি টাঙ্গাইল’দেরকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের কপি এবং ০৯টি মোবাইল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা বর্ণিত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞসাবাদে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সর্বমোট ৯৮টি নার্সিং কলেজ এর মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি কলেজে পরীক্ষা চলমান। প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ০২ জন প্রশ্ন প্রণয়নকারী নিয়োগ দেওয়া হয় যারা দুই সেট আলাদা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে থাকেন। পরবর্তীতে এই প্রশ্নপত্রগুলোকে যাচাই-বাচাই করার জন্য একটি মডারেটর টিম নিয়োগ করা হয়। যাদের কাজ হচ্ছে প্রশ্নপত্রগুলো থেকে পরীক্ষার জন্য এক সেট পরিপূর্ণ প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেগুলো সিলগালার মাধ্যমে চিকিৎসা অনুষদের ডিনের কাছে জমা দেয়া। পরবর্তীতে চিকিৎসা অনুষদের ডিন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সরবরাহের জন্য ০৪ সদস্যদের একটি গোপনীয় টিম নিয়োগ করে থাকেন; যারা নির্বাচিত প্রশ্নপত্রটি প্রিন্টিং এবং প্যাকিংয়ে নিযুক্ত থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রশ্নপত্রগুলো প্রিন্ট করে আলাদা আলাদা প্যাকিং করে তার উপরে কেন্দ্রের নাম লিখে সিলগালা করে দেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই প্রশ্নপত্রগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রে বিতরণ করে থাকেন।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, এই চক্রের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত ফরিদা খাতুন। তিনি রাজধানী মহাখালীর একটি নার্সিং কলেজের Comprehensive Nursing and Pathphysiology বিষয়ের প্রশিক্ষক। প্রায় ১০ বছর যাবত এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং ও প্যাকিং এর দায়িত্বে থাকেন। চক্রের অপর সদস্য গ্রেফতারকৃত নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম তার অন্যতম সহযোগী। তারা পরস্পর যোগসাজসে বেশ কিছুদিন যাবত শিক্ষকতার আড়ালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। গ্রেফতারকৃত ফরিদা খাতুন গত ২০ আগস্ট ২০২২ তারিখে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য বিএসসি ইন নার্সিং (পোস্ট বেসিক) প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় চিকিৎসা অনুষদের ডিন কর্তৃক নির্বাচিত ০৪ সদস্যদের গোপনীয় টিমের একজন সদস্য ছিলেন। গত ১৩ আগস্ট ২০২২ তারিখ গ্রেফতারকৃত নার্গিস ও মনোয়ারা বেগম ফরিদা খাতুন এর নিকট Comprehensive Nursing and Pathphysiology পরীক্ষার প্রশ্নপত্র চাইলে ফরিদা খাতুন প্রিন্টিং ও প্যাকিং এর সময় সংগ্রহ করে রাখা প্রশ্নপত্র গ্রেফতারকৃত নার্গিস ও গ্রেফতারকৃত মনোয়ারা বেগম প্রদান করে। পরবর্তীতে তাদের এই চক্রের আরেক সদস্য প্রশ্নপত্রটি গ্রেফতারকৃত ইসমাইল এর মাধ্যমে কোহিনূর বেগমের নিকট প্রদান করে। এসময় ইসমাঈল কিছু কপি নিজের কাছে রেখে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তার ঘনিষ্ঠজনদের নিকট সরবরাহ করে। পরবর্তীতে কোহিনূর বেগম ও আরিফ প্রশ্নপত্রটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিকট অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেন।
গ্রেফতারকৃত ফরিদা, মনোয়ারা, নার্গিস বিগত প্রায় ১০ বছর যাবত একটি নার্সিং কলেজ এর প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত নার্সিং কলেজসমূহের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটি, মডারেটর ও ডিন কর্তৃক নির্বাচিত প্রশ্নপত্র প্রিন্টিং এবং প্যাকিং এ নিযুক্ত গোপন টিমের সদস্য ছিলেন। গ্রেফতারকৃত কোহিনুর বেগম ২০০৮ সাল হতে ঢাকার একটি সরকারি নার্সিং কলেজে নার্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অবসরে যাওয়ার পর একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন।
গ্রেফতারকৃত ইসমাঈল হোসেন রাজধানীর একটি নার্সিং কলেজের সিনিয়র ষ্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত এবং গ্রেফতারকৃত আরিফ ঢাকার একটি নার্সিং কলেজের Post Basic B.Sc in Nursing এর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা গত ২০ আগস্ট ২০২২ তারিখে অনুষ্ঠিত Comprehensive Nursing and Pathphysiology বিষয়ে প্রশ্নপত্রটি ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য কোহিনূর বেগম এর নিকট থেকে সংগ্রহপূর্বক বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের নিকট অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করে। গ্রেফতারকৃত আরিফ ২০১৭ সালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অপরাধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করে।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।