নামসর্বস্ব আইপিটিভির ছড়াছড়ি ভুয়া সংবাদ ও মানহীন অনুষ্ঠান প্রচার

PicsArt_09-14-11.49.20.jpg

সারাদেশে নামসর্বস্ব আইপিটিভির ছড়াছড়ি
ভুয়া সংবাদ ও মানহীন অনুষ্ঠান প্রচার  মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর অনুকরণে নাম

বিশেষ প্রতিবেদকঃ বিশ্বজুড়ে বহু বছর ধরে মানুষের জ্ঞানলাভ, দেশি-বিদেশি খবরা খবর জানার এবং বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম টেলিভিশন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে সরকারের অনুমোদন পাওয়া থেকে শুরু করে দর্শকদের জন্য সম্প্রচারে যাবার যোগ্যতা অর্জন পর্যন্ত বহু কঠিন ধাপ পার হতে হয়।

মানসম্মত অনুষ্ঠান তৈরি ও তা দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার পেছনে থাকে চ্যানেলগুলোর বিশাল অঙ্কের আর্থিক বিনিয়োগ। তাদের লক্ষ্য রাখতে হয় দেশের এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের সম্মানের দিকেও। ফলে সাংবাদিক ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ করতে হয় অনেক সতর্কতার সঙ্গে।

কিন্তু ‘টেলিভিশন’ নাম দিয়ে নতুন এক ধরনের ‘উৎপাত’ শুরু হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে আইপিটিভি। বাংলাদেশের আনাচে কানাচেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে তথাকথিত এই ‘টিভি চ্যানেল’। আসলে এগুলো কোনো টিভি চ্যানেল নয়।

ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মেসেজিং চ্যাট অ্যাপ্লিকেশনে যেভাবে আমার ‘লাইভ’ করি খানিকটা সেরকমই। যেকোন স্থানে বসে স্ট্রিমিং বা লাইভ করা ভিডিও কথিত ওই আইপিটিভির ওয়েবসাইটে দেখা যায়।

যেকোনো জায়গায় বসে একটি সাধারণ মানের কম্পিউটার দিয়েই নির্দিষ্ট এপ্লিকেশন ব্যবহার করে যে কেউই সেটা করতে পারে। ভিডিও ক্যামেরা কিংবা মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও এডিটিং করেও চালানো যায় এই কথিত এই আইপিটিভি। এগুলো আমাদের ডিশ লাইনে টিভি সেটে দেখা যায় না। দেখতে হয় কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে। বেশিরভাগ মানুষ জানেও না কোন আইপিটিভি কোন ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখতে হয়। অথচ এই ‘টিভি’ শব্দটিকে পুঁজি করে একটি চক্র মানুষকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। তারা দেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলগুলোর নামের আগে পিছে বিভিন্ন শব্দ জুড়ে দিয়ে কথিত ‘আইপিটিভি’ চ্যানেল চালায়।

বেশিরভাগের উদ্দেশ্য থাকে এসব চ্যানেলে ‘সাংবাদিক’ বানিয়ে দেয়ার নামে সহজ সরল মানুষের নিকট থেকে অর্থ আদায় এবং বিভিন্ন খবর ফাঁস করে দেয়ার নামে মানুষকে ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করা।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এই আইপি টিভির হাঁকডাক বাড়ছে। জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে তারা ‘সাংবাদিক’ পরিচয়পত্র বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা মোটরসাইকেল কিংবা প্রাইভেট কারের সামনে বড় করে ‘সাংবাদিক’ স্টিকার লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদাবাজি কিংবা প্রশাসনে তদবিরবাজি করছে।

সরকারি-বেসরকারি দফতর ও প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখিয়ে করে যাচ্ছে ব্ল্যাকমেইল। সম্প্রতি এ ধরনে টিভির দৌরাত্মের বিষয়টি সামনে আসায় এগুলো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যা খুশি তাই প্রচার করা যায়, তাই কি প্রচার করা উচিত সেই নীতি নৈতিকতার ধার ধারছে না এরা। জাতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর মতো লোগো ব্যবহার করে এরা প্রচার করছে দৈনিক সংবাদও। এরা নজরদারির বাইরে থাকে বলে পক্ষপাত মূলক ও রাষ্ট্রবিরোধী খবর প্রচার করতেও দ্বিধা করে না।

সম্প্রতি, হেলেনা জাহাঙ্গীর গ্রেফতারের পরে তার ‘জয়যাত্রা’ আইপি টিভির নৈরাজ্যের বিষয়টি নতুন করে দেশের মানুষের সামনে উঠে এসেছে। এদিকে, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রও আইপি টিভির মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী তথ্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

তন্ময় ভৌমিক জানান, জেলা সদর এবং উপজেলা মিলে কমপক্ষে ১০-১২ জন আইপি টিভি চালায়। এদের নামও দেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলগুলোর অনুকরণ। যেমন ‘৭১ নিউজ টিভি অনলাইন’, ‘৭১ বাংলা টিভি’, ‘মধুমিতা টিভি’, চ্যানেল আই ইন্টারন্যাশনাল’ ইত্যাদি।

জেলায় জেলায় বিশেষ প্রতিনিধি, সিনিয়র রিপোর্টার, স্টাফ রিপোর্টার এভাবে নিয়োগ দিয়ে সংবাদ প্রচারের নামে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে। টাকা নিয়ে ‘সাংবাদিক ’ কার্ড দেয় এরা। মানুষও ‘সাংবাদিক’ হবার লোভে এদের পাতা ফাঁদে পা দেয়।

এই আইপি টিভির নৈরাজ্যের কারণেই অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল, আইপি টিভি এবং নিউজ সংক্রান্ত ফেসবুক পেইজ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে দেশের সাংবাদিকদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে কেন বিধিমালা করা হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।

গত পহেলা সেপ্টেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিটের প্রাথমিক শুনানিতে এ রুল জারি করেন। রুলে তথ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাবের মহাপরিচালক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

যেখানে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠিত চ্যানেলকে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা মেনে চলতে হয় তার বিপরীতে এসব আইপি টিভি দর্শক রুচি, জাতীয় স্বার্থ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাত্তা দেয় না। তথ্য ও সম্প্রচার নীতিমালা অনুযায়ী আইপি টিভির সংবাদ প্রচারের কোনো বৈধতা নেই। অথচ তাদের সংবাদ প্রচারের কায়দা দেখলে মনে হবে দেশের কোনো প্রচলিত টিভি চ্যানলের সংবাদ এটি।

এমনকি নিজেদের লোকজনকে এনে ‘টক শো’ আয়োজনও করে থাকে এরা। এখন পর্যন্ত কোনো আইপি টিভির অনুমোদন দেয়নি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। প্রণীত হয়নি আইপি টিভি পরিচালনার কোনো নীতিমালা। কিন্তু কোনো নীতিমালার অপেক্ষা করার ধৈর্য্য মনে হয় তাদের নেই।

বেসরকারি টেলিভিশন মালিকরা বলছেন, অনেক সময় এ ধরনের ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে অনেকে গুজব ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে যায়। এ কারণেই আইপি টিভির ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। নইলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।

চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ বলেন, আইপি টিভিগুলো আমাদের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করছে, রাজনৈতিক উগ্রতা ছড়াচ্ছে। পাশাপাশি অপসাংবাদিকতাকে সমাজের তৃণমূলে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই আইপি টিভি নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর না হলে তার ক্ষতির প্রভাব থেকে তরুণ প্রজন্মকে, জনগণকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের নীতিমালা মেনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেছি। জাতির রুচিকে উন্নত করতে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু আইপি টিভিগুলো এসব দায়িত্ববোধের ধার ধারে না। এই অসুস্থ সংস্কৃতির প্রতিযোগিতা রোধ করা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, আইপি টিভিকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা বিতর্কিত আইপি টিভিকে বন্ধ করে দেব। অভিযোগের ভিত্তিতে এ পর্যন্ত ৩৯টি আইপি টিভিকে বন্ধ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সমপ্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, কোনো আইপি টিভিকেই এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। রেজিস্ট্রেশন দেয়ার জন্য আমরা দরখাস্ত আহ্বান করেছিলাম। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৬শর কাছাকাছি আবেদন পড়েছে।

অন্যদিকে, বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, বিটিআরসি কোনো লাইসেন্স দেয় না। শর্তসাপেক্ষে কিছু সংখ্যক আইপি টিভিকে অনলাইন স্ট্রিমিং করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই ৬১ টি আইপি টিভির মধ্যে থেকেও বেশ কয়েকটির অনুমতি বাতিল করা হয়েছে।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, বিটিআরসি যেসব আইপি টিভিকে সেবা পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে সেগুলো কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত অনুমোদন নয়। অথচ সেসব আইপি টিভি কৌশলে বা সুযোগ নিয়ে নিজেদের ‘গণমাধ্যম ’হিসেবে দাবি করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top