রাত – বিরোত – শাহানা সিরাজী
মনটি একবারেই খড়খড়ে হয়ে আছে। না পড়তে ভালো লাগে না লিখতে। আরে ধেৎ বলে সুমিতা রান্না ঘরে প্রবেশ করে। যা আছে কপালে! মা যা বলে বলুক, কেউ খেতে পারুক আর না পারুক রান্না করবো। কিন্তু কী রান্না করবে ভেবে পেলো না। ডিপফ্রিজ খুলে দেখে মাছ মাংসে একদম ভরা। সে দেখে দেখে মুরগীর লেগ পিসগুলো বের করে। এতো লেগপিস একসাথে কেনার উদ্দেশ্য তার জানা নেই। যা আছে কপালে আজ এগুলোর একটা বিহিত করতেই হবে। ভাবী বাসায় আসার পর মা লেগপিসই কিনে। নিজেই রান্না করে। ভাবীকে ছাড়া খেতেই বসে না। আমি যে তার একমাত্র মেয়ে সে দিকে খেয়ালই নেই। আজ মাকে জিজ্ঞেস করবো কারণ কী! সে না হয় পরে দেখা যাবে। আগে প্ল্যান করতে হবে লেগপিস দিয়ে কী বানানো যায়! মা এখনো অফিস থেকে ফিরেনি। ভাইয়াও না। ভাবীর মাস্টার্স ফাইনাল চলছে। হয়তো দেখা যাবে আজ মা অফিস থেকে আগেই বেরিয়েছে, সোজা ইউনিভার্সিটিতে যাবে। ভাবীকে নিয়ে কোথাও বসবে। চা কফি খাবে তারপর ভাইয়ার অফিসে যাবে। তিনজনই একসাথে ফিরবে। আজ মাকে চমকে দেবো। হতে পারে বিদঘুটে কোন খাবার কিন্তু চমকাবেই।
মার এ অভ্যাস কবে বদলাবে! ছেলেকে বউকে একা একা আসতে দিলেই পারে। ভাবী হয়তো কিছু বলে না কিন্তু সে যে খুব খুশি হয় না তা মা বুঝতে না পারলেও আমি পারি। এসেই আবার লেগে যায় বউ মা চেইঞ্জ করো, টেবিলে এসো, খাও দাও, সে কী হুলু¯ূ’’ল কাÐ করে! বুঝতে চায় না তারা নিজেরা একটু একা থাকতে চায়। মায়ের এতো কেয়ারিং সেন্টিমেন্ট শেষ কালে না হিতে বিপরীত হয়!
সুমিতা লেগপিসগুলোকে ডিফ্রস্ট করে নিলো, তারপর মেরিনেট করে রেখে দিলো ফ্রিজে। এবার সে কী করবে! তার যে সময় কাটে না। মার মতো একটা শ^াশুড়ি থাকলে এখানে তাকে পড়ে থাকতে হতো না। নিজেই তো মাকে বাধ্য করেছি রাজিবের সাথে বিয়ে দিতে। বিয়ের আগের রাজিব আর পরের রাজিবে যে এতো তফাৎ হবে কখনো ভাবতেও পারিনি। আমি যে ওই সংসার ছেড়ে ফাইনালি চলে এসেছি মা তা জানে না। রোজ জানতে চায় কিরে রাজিব এলো না যে! সুমিতা রোজ হেসে হেসে উত্তর দেয়, আহা কাজ আছে না। ব্যবসায়ী মানুষ। কতো ছোটাছুটি করতে হয়! কিন্তু এভাবে আর কতো দিন! বাবা বেঁচে থাকলে বাবার চোখ ফাঁকি দেয়া যেতো কী?
সুমিতার খুব ইচ্ছা করে রাজিবকে ফোন করতে। ফোন হাতে নেয়, নাম্বার সিলেক্ট করে কিন্তু সেন্ড বাটনে আর পুশ করা হয় না। এক ধরণের অভিমান তার গলা পর্যন্ত উঠে আসে। এক সাথে পড়তাম। একই ক্লাসে একই বিষয়ে। দুদার্ন্ত পাঁচ বছর। একদিন না দেখলে রাজিব অস্থির হয়েছে। যেখানে রাজিব সেখানেই সুমিতা, যেখানে সুমিতা সেখানেই রাজিব। তাদের রিলেশন নিয়ে তার মায়ের আপত্তি থাকলেও রাজিবের পরিবারের কোন আপত্তি ছিলো না। তখনো তার মা বেঁচে ছিলো। একদিন হুট করেই রাজিব বললো মা নেই। সুমিতা ছুটতে ছুটতে সে বাসায় গেলো। থমথমে পরিবেশ। যেন তার মায়ের এ হঠাৎ চলে যাওয়ার পেছনে কোথাও কোন কারণ ছিলো। যেন সবাই স্বস্তি পেলো। বুঝতে পারলো না সুমিতা ব্যাপারটা কী! রাজীবকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গিয়েছে। আবার কোন ঝামেলায় পড়ি! এখন মনে হচ্ছে আসলে জানাই উচিত ছিলো। কেন তার তরতাজা মা হঠাৎ করেই চলে গেলেন। আসলেই নরমাল মৃত্যু নাকি সুইসাইড! কেনই বা এতো তড়িঘড়ি দাফন করা হলো! অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেলেও রাজীবপ্রেমে সে অন্ধ ছিলো।
তার মা মারা যাওয়ার কিছু দিনের ভেতর রাজীব তাদের বিয়ে সেরে নেয়ার তাগাদা দিতে লাগলো। সুমিতারও মাস্টার্স শেষ হলো। সে চাকুরি করবে না বলে ঠিক করলো। রাজীবদের ব্যবসা বাণিজ্য এতো কিছু আছে যে সুমিতার চাকুরি করা কেন লাগবে! তার মা তাকে যতোই বোঝাক যে চাকুরি অভাবের জন্য যেমন করা উচিত তেমনি নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার জন্য চাকুরি খুবই প্রয়োজন। সুমিতার মা তাকে বোঝাতে চান যে জীবনের কোন মুহূর্ত কী ভাবে যাবে তা কেউ জানে না। ভালো গেলে তো ভালোই খারাপ হলে নিজেকে সামলে নেয়া যায়। কারো দ্বারস্থ হওয়া লাগে না। চলেই যায়। সুমিতা একদম কথা শোনেনি। সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে এটাই তার ফাইনাল কথা ছিলো।
অগত্যা তার মা তাকে ঘটা করে বিয়েই দিয়ে দিলো।
বিয়ের প্রথম রাতেই সুমিতা আবিষ্কার করে রাজীব ড্রাগ এডিক্ট। সে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে একটু হয়তো আজ খেয়েছে। কাল খাবে না। সে খেতে দেবে না। বাসর রাতের সুখস্বপ্ন ভেঙে খান খান। গত পাঁচ বছরের সাথে সে মিলাতে পারছে না। রাজীব তাকে অনেকবার নানা ভাবে বোঝাতে চেয়েছিলো তারা যেহেতু এক অপরকে ভালোবাসে তাদের ভেতর অনেক কিছইু হতে পারে। একবার সুমিতা প্রায় রাজী হয়ে গিয়েছিলো পরে তার আজন্ম সংস্কার তাকে সে পথ থেকে সরিয়ে রাখে। রাজীব সেদিন প্রচন্ড রিএক্ট করে সুমিতার সাথে অনেকদিন কথা বলেনি। সুমিতা অনেক চেষ্টা করে আবার এক হয়েছে। সেদিন রাজীব কোথায় গিয়েছিলো, এ কয়েকদিন তার কেমন কেটেছে কিছুই জানতে চায়নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কথা!
বিয়ের পর দিনই সুমিতা বুঝতে পারে বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে। মাকে এখনই কিছুই বলা যাবে না। মা যাতে এ বাসায় না আসে সে ব্যবস্থা করতে হবে। পরের দিন সকালে নাস্তা কী হবে, কখন হবে, কে বানাবে কিছুই সে বুঝতে পারলো না। সাহায্যের জন্য রাজীবের কাছে আসলো। রাজীব তাকে তাচ্ছিল্য করে বললো, এ বাড়ির বউ তুমি। আমার কাছে জানতে চাচ্ছো কী খাবে, কে রান্না করবে? লজ্জা করলো না? সুমিতা ভেবেছে এমনই রসিকতা করে বলেছে। সে পায়ে পায়ে রান্না ঘরে উঁকি দিলো। কোন ঘরের কোন সাড়া নেই। না রাজীবের ভাইদের না তার বাবার! কাজের লোক আছে কিনা থাকলে তারা কোথায়? পরে নিজেই ময়দা মেখে পরোটা ডিম ভেজে রাজীবকে ডাকে। নয়টা বাজলো ওঠো। পেট চোঁ চোঁ করছে।
রাজীব লাফ মেরে উঠেই বলে, ভুল হয়েছে , হাভাতে মেয়ে ঘরে এসেছে। এসব মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট। তোমার খাবার তুমি খাও। সুমিতা তাজ্জব হয়ে শুধু উচ্চারণ করলো, রাজীব! তারপর খাবার রেখে বাইরের বারান্দায় বসে রইলো। বেলা বাড়তে বাড়তে দুপুর। সে বুঝতে পারলো, ব্যবসায়ীরা নব বেরিয়ে গিয়েছে। তাদের বউরা এখনো বিছানায়। বাচ্চা কাচ্চা কেউ ঘুমে কেউ স্কুলে গিয়েছে মর্নি শিফটে। কাজের লোকের চলাচল অনুভব করলো। সে বেরিয়ে এলো রান্না গরের দিকে। বাবুর্চি লোকটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে নতুন ম্যাডাম আপনার ঘুম ভালো হয়েছে? চা খাবেন?
এবাড়িতে কারো জন্য অপেক্ষা করলে মরতে হবে। সুমিতা মনে মনে ভাবলো তা বুঝতে আর বাকী নেই। মুখে বললো, কাল থেকে আমার খাবার সকাল আটটার ভেতর দেবে। সে চেষ্টা করছে সবাইকে নিয়মের ভেতর আনতে। তার মায়ের কাছে নিয়মের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিলো না। এখানে নিয়ম মানেই মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট! প্রায় পনেরো দিন হলো রাজীবের একই ব্যবহার। রোজ রাতে ড্রাঙ্ক হয়ে বধ্য মাতাল বাড়ি ফেরে। সুমিতার দারুণ প্রেন্টিজে লাগে! সে বোঝার চেষ্টা করে আসলে ব্যাপার কী! আর কী জগতের মানুষের বিত্ত বৈভব নেই? এরা এ রকম কেন? কারো প্রতি কারো দায়-দায়িত্ব ইে। আরো বউরাও নিজেদের মতো ঘরে আসে আবার বেরিয়ে যায়। কোথায় যায়? আজ সে আটঘাট বাঁধে বাচীবকে তার ধরতেই হবে। রাতে রাজীব ঘরে ফেরার পর সুমিতা তার কাছে যায়। জানতে চায় রাজীব এসব কী হচ্ছে? তুমি তো এমন ছিলে না। আমাদের কতো সুন্দর সময় গিয়েছে। আজ যখন কাছে এলাম তখন তুমি কেমন পাল্টে গেলে!
রাজীব হাত দিয়ে তাকে সরিয়ে বলে তোমার কুমানীত্ব অক্ষুন্ন থাকুক। মনে আছে অপমান করেছিলে?
সুমিতা লজ্জা পায়। বলে তখন সে রকমই হওয়ার কথা ছিলো। এখন আমি তোমার স্ত্রী। আমার অধিকার আছে। রাজীব চোখে মুখে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে বলে, তুমি এজন্মে আমাকে পাবে না। যাও। বলেই ধাক্কা মেরে সুমিতাকে ফেলে দেয়। সুমিতা নিজেই ধাক্কা খেয়েছে। এই কী রাজীব! শোধ নেয়ার জন্য তাকে এক প্রকার জোর করে বিয়ে করেছে? সুমিতা নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে ডাইনিয় টেবিলে এসে ঠান্ডা পানি পান করে। বাবুর্চি লোকটি খিক খিক হাসে। বলে , পালান সমুন ম্যাডাম। এ বাড়ির আম্মাও আপনার মতো ভালো মানুষ ছিলেন। এদের অত্যাচারে বাঁচতে পারেনি।
সুমিতা চমকে ওঠে। তারমানে সুইসাইড!
সুমিতা চমকে ওঠে এবং দৌড়তে থাকে। এক দৌড়েই সে তার মায়ের বাসায়। বিধ্বস্ত মেয়েকে দেখে তার মা কোন প্রশ্ন না করে কাছে টেনে নেয়, খেতে দেয়। মেয়ের খাওয়ার স্টাইল দেখে মা অবাক তাকিয়ে থাকে। তার মেয়ে কয়দিনের অভূক্ত কে জানে! মুখে জানতে চায় রাজিব এলো না যে! সুমিতা খাবার গিলে আর বলে আজ অফিস থেকে ফিরতে একটা বিসিএস গাইড নিয়ে এসো। সময় কাটে না। তার চেয়ে পড়ি। সে ভাবতে থাকে রাজীব কোন কালেও লেখাপড়ায় আমার ধারে কাছে ছিলো না। কিন্তু আমার জন্য রোজ লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা আমার প্রতি কেয়ারিং তার প্রতি আমাকে দুর্বল করে তোলে। প্রথম দিকে পাত্তাই দেয়নি। শেষের দিকে রাজীবকে না দেখলে তার পড়ায় মন বসতো না। সে রাজীব এক হিসেবে আজ তাকে ঘর থেকেই বের করে দিয়েছে। গতরাতেও তার গায়ে হাত তুলেছে । সে অভিমানে বারান্দায় ছিলো। রাজীব রাতভর কার সাথে যেন কথা বললো। সে কী হাসি ! ঠিক যেমনটি আমার সাথে সে করতো। বিধাতা আমার সাথে এ কী খেলা খেললো!
সুমিতা তার মায়ের কাছে এক কাপড়েই চলে এসেছে। এখানে তার পুরোনো পোশাক বের করে সে পরা শুরু করে। পরদিন সে বেরিয়ে পড়ে আমাকে জানতেই হবে আসলে রাজীব কী করে। শুরুতেই তাদের ব্যবসায়ীক অফিসে যায়। সেখানে সে খোঁজ খবর করে। সবাই তাকে পেয়ে চমকে ওঠে। এতো ভালো মানুষ এই বদখত লোকের কাছে কেমন করে এলো। একজন কর্মচারী তাকে নিয়ে গেলো রাজীবের রেস্টরুমে। সুমিতা যেন ভীমরতী খায়। একী রাজীব! মদ-নারী বেষ্টিত! এ সব কী! কোন কথা না বলে চুপচাপ চলে আসে। তার কলিজা ভেঙে খান খান। তার স্বপ্ন তার সুখ মুহূর্তেই উবে গেলো ভূত দেখার মতো! এরপর তার শ^শুরের ভাসুরের চেম্বারে গিয়েও জগন্য দৃশ্য দেখে সে বমি করতে খাকে। যেন মারা যাবে। কোন মতে সেখান থেকে পালায়। কর্মচারীটি বলে ম্যাডাম এদের অত্যাচারে তাদের মা সুইসাইড করেছে। টাকা আছে সব ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে। জগতে তার মা আর ভাই এ দুজন ছাড়া আর কারো কথা সে ভাবতে পারছে না। এ রাজীবের জন্য মা ভাই এর সাথে তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
বাসায় ফিরেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জ¦র আসে তীব্র। সে ভাবে এ জ¦র যেন আমাকে ভুলিয়ে দেয় কুৎসিত অতীত। তার মা বার বার রাজীবের কথা জানতে চায়। কেন সে শ^শুরবাড়িতে না থেকে এখানে থাকছে জানতে চায়। সে বলে বেড়াতে এসেছি। চলে যাবো। এই যাবো যাবো করতে করতে প্রায় ছয়মাস হয়ে গেলো। এর ভেতর সে নানা জায়গায় চাকুরির পরীক্ষা এবং সে সাথে বিদেশী স্কুলে স্কলারশীপের জন্য ট্রাই করতে থাকে। বিসিএস দিতে শুরু করেছে। তার এ পরিবর্তন দেখে তার মা ভাই যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। তাই আর কখনো প্রশ্ন করে তাবে বিব্রত করেনি। আগের মতোই রুটিন জীবন। পড়ালেখা নিয়েই সে ব্যস্ত। কিন্তু রাজীবের কথা মনে হলে তার বুক ভেঙে যেতে চায়! কখনো ভালোবাসায় সে আপ্লুত হয় কখনো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এ ছয় মাসে রাজীব তাকে একবার ফোন পযর্ন্ত করেনি। সেও না। ইচ্ছা হলেও তা সে কবর দিয়ে ফেলেছে। মনে মনে শপথ করে তোদের এ বৈভব কেড়ে নিয়ে জিরো বানিয়ে ছাড়বো!
রাজীবদের মিল-ইন্ডাস্ট্রিগুলোর খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। নিজের পড়াশানা আর শ^শুরের সম্পদের তথ্য জানা এ হলো তার নিত্য দিনের ডিউটি। দিনে দিনে সুমিতা চৌকশ হয়ে ওঠে। এক চান্সেই বিসিএস প্রশাসনে চাকুরি হয়ে গেলো। ই”্ছা হলো তার শ^শূরকে খবরটা দিতে কিন্তু দেয়নি। কারণ তারা খুশি তো হবেই না উল্টো মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে গালিখেতে হবে।
এরই মাঝে সুমিতা জেনে এলো তারা ব্যাংকের কাছে প্রচুর ঋণী। ব্যাংক তাগাদা দিচ্ছে তাদের পাওনা শোধ করার জন্য। প্রতিবারই মন্ত্রী দিয়ে ঝামেলা ঠেকায়। সুমিতা ভাবে টাকা তো আর মন্ত্রীর নিজের নয়। জনগনের টাকা মার গেলে তার কী! অপেক্ষার দিন যেন পুরোয় না। সে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এবং তার মায়ের কল্যাণে, ভায়ের কল্যাণে রাজনীতি অর্থনীতিও বেশ বোঝে। তার মাকে প্রতি রাতে বিশ^রাজনীতি অর্থনীতি নিয়ে একঘন্টা বক্তৃতা শোনাতে হতো। বিশ্বের সব দেশ সম্পর্কে তাকে ব্রিফ করতে হতো। অদ্ভুত এ মায়ের জন্য তাদের দু ভাইবোনের চাকুরী পেতে অসুবিধা হয়নি। সুমিতা একটানেই বিসিএস পাস করে। তার পোস্টিংও হয় ঢাকাতেই। চাকুরীতে জয়েন করার পর সুমিতার নতুন দিগন্ত উম্মুচিত হয়। তার স্কুল কলেজ ভার্সিটির বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আবার যোগাযোগ শুরু হয়। তাদের মাঝে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার- উকিল -মোক্তার-ব্যবসায়ী-মন্ত্রণালয়ে জব-দুদক-সাংবাদিক- ব্যাংক অফিসার কী নেই! সুমিতা কৃতজ্ঞচিত্তে তার মাকে ধন্যবাদ জানায়। সে কী জগন্য টাইপ জীবন-যাপন করতে চেয়েছিলো। এ মুহূর্তে রাজীবকেও সে ধন্যবাদ দেয়। যদি রাজীব এ রকম জগণ্য না হতো হয়তো সুমিতার এই পৃথিবীর সাথে দেখাই হতো না।
দিন যায় রাত পোহায়। সুমিতা অফিসের কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠে। ব্যস্ততা বেড়ে যায় ।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রাজীবের গাড়ির সাথে তার দেখা হয়। রাস্তায় জ্যামে রাজীবের এবং সুমিতার অফিসের গাড়ি পাশাপাশি দাঁড়ায়। সুমিতা রাজীবকে দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়। কারণ তার গাড়িতে অন্য নারী। প্রচন্ড হাসাহাসি হচ্ছে। সুমিতার ভুলে যাওয়া ক্রোধ জেগে ওঠে। সে তার বন্ধুদের সবাইকে পাকে। গেট-টুগেদার। শহরের নাম করা হোটেল ক্যামেরুনে তার পার্টি চলছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে সে চৌধুরী গ্রæফ অব কোম্পানীর অজানা কাহিনী বলতে থাকে। পরদিন দেশের নামী দামী পত্রিকার হেড লাইন চৌধুরী গ্রæফ অব কোম্পানী। এক পলকে চৌধুরী পরিবারের ইনডোরের সব তথ্য ফাঁস।
সারা দেশে হইচই পড়ে গিয়েছে । তার মানে চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী সুইসাইড করেছে! জনস্বার্থে মামলা ঠুকে দেয় সুমিতার উকিল বন্ধু। সুইসাইড করা ইস্যু কোন প্রকার ইনভেস্টিগেশন ছাড়া কার অনুমতিতে কবর দেয়া হয়েছে। সুইসাইডের রহস্য জাতির স্বার্থেই উন্মোচন প্রয়োজন। দুদক নড়েচড়ে বসলো এরা কর ফাঁক দিচ্ছে কিনা। ব্যাংক জেগে উঠলো এরা লোন ফেরত দিচ্ছে না। অথচ অবৈধ কাজ করে যাচ্ছে। চৌধূরীকে স্মাগলার হিসেবে ট্রিট করা হলো। চারদিকের টানাপোড়নে চৌধুরী পরিবার প্রায় ভেঙে পড়েছে। ব্যাংক মামলা করে দিয়েছে। সে মামলার বিচারের ভার সুমিতার উপর পড়লো। সুমিতা এক মাসের ভেতর ব্যাংকের যাবতীয় লোন পরিশোধের জন্য ডিক্রি জারী করে। সে মামলা আবার আপীল বিভাগে য়ায়। সেখানে কী সুমিতার পরিচিতি নেই? এ দিকে মিসেস চৌধুরী হত্যার দায়ে চৌধূরীও তার তিন ছেলেকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারী হয়েছে।
রাজীবের টনক নড়লো। এতো সব এক সাথে কেন হচ্ছে! সুমিতা নয়তো। তাহলে তার লাশ ফেলে দেবো!
রাজীবের নাম্বার থেকে ফোন বেজে ওঠে। সুমিতা তখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। কোন কোন খাবারে ভেজাল তা দেখছে, কোন কোন ইন্ডাস্ট্রি এসব খাবার উৎপাদন করছে তা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে দেশের সকল জাতীয় দৈনিকে খবর প্রচার হচ্ছে। চৌধুরীর কোম্পানী ভেজাল লিস্টে পড়ে সিলগালা হচ্ছে। সে এক পরিস্থিতিই বটে! সুমিতা ফোন রিসিভ না করে তার কাজ করেই যাচ্ছে। এ সমাজকে কিছু দিতে হবে। কেন তার শ^াশুড়ি সুইসাইপ করেছে তাকে যে বের করতেই হবে। দেশের প্রথিতযশা কোম্পানী, খ্যাতিমান বিজনেজ ম্যাগনেট এতো অপরাধের সাথে জড়িত যে যেখানে সুমিতা হাত দিচ্ছে সেখানেই সে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় চ্যেধুরীর পাশে কোন রাজনৈতিক নেতাও থাকতে চাচ্ছে না। কারণ এই কালো অধ্যায়ের সাথে তারা কেউ প্রত্যক্ষবাবে থাকতে চাচ্ছে না।
রাজীব সশরীরে সুমিতার মায়ের বাড়িতে হাজির হলো। রাজীবকে দেখে সুমিতার মা বিস্মিত হলো। এ কোন রাজীব! এর সাথে সে কী খরে মেয়ে বিয়ে দিলো। বাজখাই গলায় জানতে চাইলো সুমিতা কোথায়?
সুমিতার মা ভদ্রভাবে বললো, এটা মধ্যবিত্তের বাড়ি। এখানে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না। সে বাড়ি নেই । কখন ফিরবে ঠিক নেই।
রাজীব কিছুক্ষণ মৌন থেকে কোন কথা না বলে চলে গেলো। প্রসঙ্গতঃ রাজীব এখনো জানেই না সুমিতা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে তার সহকর্মীরাও পারছে না। রাজীবের বিরুদ্ধে একর পর এক ইভটিজিং এবং ধর্ষণ মালা হচ্ছেই। কী ভয়ানক কাÐ! রাজীবকে আদালতে দাঁড়াতে হলো। সাত কর্মদিবসে মামলা শেষ করতে হবে সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী।
সুমিতাও তাই করলো। আদালতের কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজীব তাজ্জব হয়ে গেলো। সুমিতা!
সুমিতা নিজের কার্য সম্পাদন করে একবার রাজীবের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে ফেললো। নিচু স্বরে যেন েিজর সাথেই বললো, উচ্চ আদালত রয়েছে।
বলাবাহুল্য রাজীব সুমিতার সাথে কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো কিন্তু সুমিতা তার কর্তব্যে অটল। সুমিতার হাত ধরেই চৌধুরী গ্রæফ অব কোম্পানী রাতারাতি জিরো পয়েন্টে চলে এলো। স্ত্রী হত্যার দায়ে চৌধুরী নিজেই চৌদ্দ বছরের জেলে। বাকী ভায়েরা দুদকের হাতে গ্রেফতার।
সুমিতার ইচ্ছা করে চিৎকার করে বলতে-আমি মধ্যবিত্ত এ আমার অহংকার। এ আমার সেন্টিমেন্ট। উচ্চবিত্তের অহংকার দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর।
সুমিতা রাজীবের জন্য অপেক্ষা করবে?
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর সাধারণ, পিটিআই মুন্সিগঞ্জ,
কবি প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক।