খোলা জানালায় পুরোটা আকাশ দেখা যায় না – শাহানা সিরাজী
মাঝরাতে ঘুম ভাঙার পর কলিজা দাউ দাউ করে জলে উঠলো। এই কী জীবন! কাছে আসে তবু আসে না, পাশে থাকে তবু থাকে না! চোখ বড়ো অবাধ্য হয়ে উঠেছে। বাঁধ মানে না। কাউকে বোঝানো যায় না জীবন মানেই কেবল পান্তাভাত- পিয়াজ-মরিচ নয়! এর ভেতরই রয়েছে সূক্ষ কারচুপি। যেখানে জীবন ঢেউ খেলে যায়! নানান বৈচিত্রে সামনে এসে দাঁড়ায়। যেখানে আছে ভোরের আলোর মতো প্রত্যাশিত আবেগ, উজ্জ্বলতা। যে আলোয় পথের সন্ধান মিলে। না খেয়েও থাকা যায় এক টুকরো হাসির বিনিময়ে। এ চাকচিক্য এ ঝলমলে, মখমলে সময়ের কী মূল্য আছে যদি জীবন হাতছানী না দেয়! গাড়ির চাকা, স্টিয়ারিং সবই ঠিক আছে, হর্নও বাজে মুর্হুমুহু কেবল ইঞ্জিন নেই। ওই গাড়ি কে চালায় ! কে চায় ঠেলে ঠেলে চালাতে! এ সমাজ ইঞ্জিনবিহীন গাড়িই বেশি পছন্দ করে! ঠেলতে ঠেলতে কার প্রাণ গেলো! কে হঠাৎ আগুনে নিঃশেষ হলো তাতে কারো মাথা ব্যথা নেই। বরং চাকচিক্যের মোহে আবদ্ধ এক চাক্রিকজীবনে গোত্তা খেয়ে মরে। নিবেদিতা এক ঝটকায় ছিঁড়ে দিতে চায় ও সব প্রলেপ মার্কা যাপনের ইতিবৃত্ত। কিন্তু পারবে কী? নিজেকে প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছে তবুও হাল ছাড়েনি। যতোবার রাজীব তার কাছে আসতে চেয়েছে ততোবারই সে দূর থেকে দূরে গিয়েছে। কারণ নিবেদিতা জানে রাজীবের এই কাছে আসা ভালোবাসা নয় বরং প্রাচুর্যের মহামারীতে সে আক্রান্ত। টাকা আছে ক্ষমতা আছে সে যা ইচ্ছা করতে পারে কিন্তু নিবেদিতা ? তার ওসবে কোন মোহ নেই. জানালার পাশে দিনরাত বসে থাকে। একটুকরো আলো চাই।
ভালোবাসার জলতরঙ্গে এক ঝলক ভিজতে চাই। সৈকতের আনাগোনায় আজকাল সে পুলকিত হয়। তবে কী সৈকতের মাঝেই সে খুঁজে ফিরে নিজের অস্তিত্ব ! রাজীব ক্ষমতার দাপটে দিনকে রাত করতে পারে কিন্তু মানুষের মন স্পর্শ করতে পারে না। যান্ত্রিক এক জীবন কেবল ডিজেল পেট্রোলের গন্ধই পেলো হাসনুহেনার ঘ্রাণ ফিরে এলো না! নিবেদিতা জেগেছে এবার, এ সব বৈভব তার দরকার নেই! কারো ঘরের তৈজস হবার সাধ নেই। বাবা-মা এমন কেন? কেন ভাবতে পারে না ভালোবাসা জগতে সবার চেয়ে দামী! সৈকতের টাকা না থাকুক সে তো ছিলো. বাবা কী জানে তাঁর মেয়ে কেমন দিন কাটাচ্ছে? না জানেন না। বাবা এলে রাজীব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে প্রণাম করলো কী করলো না তার চেয়েও মূখ্য হয়ে ওঠে মেয়ে জামাই কতো বড়ো বাড়ির মালিক, গাড়ির মালিক! দোকানে হাঁটে মুখভরে নানান মুখরোচক আলাপ করে , গর্বে বুক দুলে দুলে ওঠে। অথচ জানলোই না মেয়ের দিন কাটে জানালায় রাত কাটে শূন্য বিছানায়!
২.
নিবেদিতা আমার ময়না পাখি, তাকে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দেবো যার অনেক টাকা কড়ি থাকবে, আমার মেয়ে রাজরাণী হবে! এ বাক্য শুনে শুনে সে বড়ো হয়েছে। ছোটবেলায় মনে হতো রাজরানী মানে হয়তো এমন কিছু যা সে কখনো চিন্তাও করতে পারে না। সে তো দেখেনি রাজা কী রাণী কী? গল্পের রাজার অনেক বউ থাকে। ছোট বেলায় বউ মানেই পুতুলের মতো কিছু সে ভাবতো। সে ভাবনার পুতুলের ভেতর তার প্রাণ শক্তি কী ভাবে হারিয়ে গেলো তা ভাবতে ভাবতে আবার চোখ সজল হয়ে ওঠে।
হায় বাবা! কেন যে পুতুলের স্বপ্ন দেখেতো! তাওতো পুতুল নিয়ে কেউ খেলা করে, সাজায় তার কপালে সে খেলাও জুটেনি। রাজীবের হাসি হাসি মুখ দেখে তাকে যতো ভালো মানুষ সমাজের মানুষ ভাবুক সে আসলেই একটা মানুষের ফসিল মাত্র! তার জন্য রান্না করে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা গেলেও ভালোবাসা যায় না। সব কিছুতেই মেকি মেকি ভাব। নিবেদিতার মন আর টিকতে চায় না। তাই এক পলকেই প্রসাদের বৈভব ছেড়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। সে খেটে খাবে সেই ভালো তবু প্রাণ ভরে হাসবে! নিবেদিতা জানে এ পথ অনেক কঠিন অনেক জটিল। পদে পদে তাকে লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। তবু তার অগ্নিগিরি চাই । যে তাকে মোমের মতো গলাবে। যার সান্নিধ্যে সে আগুনের মতো জলবে। তারপর শীতল হবে। হ্যাঁ, বরফের মতো শীতল। বরফানুভূতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে, প্রশান্তির ঘুম। দেহের কোষগুলো সন্ধ্যাতারার মতো জলজল জলে উঠবে। সিতারার মতো সাক্ষী হয়ে থাকবে সারারাত। উন্মাদ বাতাস তাকে উড়িয়ে নেবে।
৩.
চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেছে রাজীব এন্ড কোং গ্রুফ অব কোম্পানীর মালিকের পত্নী মহলে নেই। তাকে দেখা যাচ্ছে ফাইল-পত্র হাতে এ অফিস থেকে সে অফিস চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে। সবখানে সব জায়গায় রাজীবের আধিপত্য। তবে কী নিবেদিতা হাল ছাড়বে? রাজীব নিজেই গুন্ডাপান্ডা দিয়ে নিবেদিতাকে তুলে নিয়ে এসেছে। কিন্তু একী! এ কোন নিবেদিতা! রাজীবের দেয়া চড়ের হিসেব সাথে সাথেই দিয়ে দিয়েছে। রাজীব তাকে ক্রাশ করে দিতে পারতো কিন্তু না তা সে করেনি। নিবেদিতা চিৎকার করছে- এ মহলের পাথুরে জীবন চাই না, সামাজিকতা করতে করতে আমি ক্লান্ত। জীবন আলোয়ান দিয়ে কী হবে যদি সে আলোয়ানের কোন মূল্য না থাকে! এ সমাজ মানুষের তৈরি। আমি মানুষের দেয়া বিধান ছিঁড়ে দিলাম। প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পন করলাম।
এবার রাজীব মারতে থাকে, আজ ছাল তুলে নেবো। প্রসাদের বাইরে যাবার শাস্তি পেতেই হবে। নিবেদিতা শক্ত হাতে বেল্ট ধরে ফেলে। এবং টান দিয়ে নিজের আয়ত্বে নিয়ে আসে। মুখোশের আড়ালের মানুষকে সবাই দেখুক। পাল্টা আঘাত নিবেদিতা রাজীবের তুলতুলে দেহের মাঝবরাবর দিতে থাকে। রাজীব হঙ্কার ছাড়ার আগেই নিবেদিতা তাকে থামিয়ে দেয়। কোন লাভ হবে না। চারদেয়ালের আস্তর পলেস্তরা খসে গিয়েছে। এই মেকি রঙ মহলে নিবেদিতা থাকবে না আর। গুন্ডা পান্ডা দিয়ে ধরে এনে নিজের বাকী সম্মাানটুকুও দিয়েছো ধূলোয় মিশিয়ে। রাতদিন যার নারীর অভাব নেই তার কেন নিবেদিতাকে প্রয়োজন? সমাজকে দেখানোর জন্য? নিবেদিতা ইটের তৈরি খাম্বা নাকি মাটির তৈরি পুতুল? রাজীব তেড়ে আসতে গেলেই নিবেদিতা সপাং সপাং বেল্ট চালাচ্ছে। তোমার প্রাসাদে তুমি থাকো । এখানে থাকার মতো মানসিকতা হারিয়ে গিয়েছে।
ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে আসে। আর নয় পুরুষ! পরক্ষণেই মাথায় আসে সৈকত, সেওতো পুরুষই ! রাস্তায় ঘাটে অফিসে আদালতে সব জায়গায়ইতো পুরুষ! সে একা চলতে পারবে? ভাবতে ভাবতে নিবেদিতা জ্ঞান হারায়। দীর্ঘদিনের আড়ালের পক্ষী আলোতে এলে চোখ ধাঁধিয়ে যায় নিবেদিতারও তাই হয়েছে। সামনে নাকি পেছনে কোন দিকে যাবে! এবার সে নিজেকে প্রশ্ন করে বন্ধন বলতে কী বোঝায়? কোন উত্তর পায় না। চকচকে জুতো আর ঝকঝকে গাড়িতে চড়া নিশ্চয়ই বন্ধন নয়, হতে পারে তা বন্ধনের একটি মাত্র সূচক। অন্য সূচকগুলো সব আভিজাত্যের মোড়কে হারিয়ে গিয়েছে। প্রিন্সেস ডায়ানাও এমনি আভিজাত্যের ভাঁপে মজতে মজতে শেষে ছিঁড়ে দিয়েছে বৃটিশ রাজপরিবারের বাঁধন। সে চলে গেছে তার আগে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে সে মানুষ। নিবেদিতাও তাই চায়।
পারবে কী? হ্যাঁ , সে উড়বে। ডানা মেলে শঙ্খচিলের মতো আকাশের বুকে হেসে বেড়াবে। অবিরত সর্ষেফুলের হাসি তাকে দিশেহারা করবে। নিবেদিতা এখন সদর রাস্তায়।
৪.
সৈকত এসে মিশে যায় নিবেদিতার চোখের জলের সাথে। তার সংগ্রামকে সৈকত স্যালুট দেয়। শুরু হয় নতুন জীবনের সাধনা। এখানে নিবেদিতার বাঁচার অবলম্বন হয়ে ওঠে সৈকত। দু মেরুর দু বাসিন্দা এক হয়েছে সবার অলক্ষ্যে। ভেঙে দিতে চায় সামাজিক ঘুণে ধরা কাঠামো। প্রেমহীন ভালোবাসা হীন দুর্বল সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর চেয়ে একা থাকা উত্তম।
একাকী জীবনের বহুমাত্রিক উপলব্ধি তাকে অনন্য এক মানবী করে তোলে। নিবেদিতা যেন নিজেই এক সমাজের মুখচ্ছবি হয়ে উঠেছে। রাস্তার মানুষ রাস্তা ছেড়ে দেয় অফিসের মানুষ চেয়ার ছেড়ে দেয়, সমাজের মানুষ বিরল ভালোবাসায় তাকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু সৈকত? তার জীবনের তীব্র এক সত্য। তাকে তো উপেক্ষা করা যায় না। হ্যাঁ, রাজীবের নিশানা উড়িয়ে সৈকতে আছড়ে পড়া সমীচীন নয় জেনেই উপড়ে দিয়েছে বৃক্ষের রুট। নিবেদিতা দিশাহারা এখানেও লেগে আছে সামাজিক সিলের নিষ্ঠুর ছাপ! তাকে এখানেও সতর্ক থাকতে হয়। এখানেও সে চিৎকার করে কথা বলতে পারে না, এখানেও সে সৈকতের হাত হতে সিগারেট নিয়ে ফুঁকতে পারে না কিংবা সৈকতের ডাকে উচ্চ স্বরে জবাব দিতে পারে না। এ চক্র তাকে কী চিরকাল আঁটকে রাখবে? এ চক্রবূহ্য পারবে না কোন দিন ছিঁড়ে দিতে? সৈকতের সাথে একাকার হতে পারবে না?
ঘুম ভাঙার পর হতে তার মনে এ সব হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। আর চোখের জলে ধুয়ে মুছে সাফ করতে চায় রাজীবের বীভৎস ছায়া। তবুও কোথাও ছাপ থেকে যায় । একবার পথে পা রাখলে তার ছাপ আজীবন থেকে যায়। নতুন নতুন ছাপ হলেও পুরাতন ছাপকে ভুলে থাকা যায় কিন্তু মোছা যায় না। রাজীব তার জীবনে তেমনি কোন ছায়া যা ভোলা যায় মোছা যায় না। সৈকত কখনো এ নিয়ে প্রশ্ন না করলেও সে জানে সৈকতের মনে এক ধরণের কষ্ট আছেই-নিবেদিতাকে আর কতো ভালোবাসলে মুছে দেবে সব ইতিহাস!
মানুষের শান্তি কোথায়? যে সব সময় নতুনকে স্বাগত জানায়, বর্তমানকে অনিন্দ্য করে তোলে সেই কী সুখী? তাহলে মরিয়ম, সুজাতা, লিপি ওদেরকে কেন চোখের জল ফেলতে দেখে। তারা তো স্বামী –সন্তান-সংসার সব নিয়েই আছে। কেন তারা নিজেদের অসুখী ভাবে? নিবেদিতার ভাবনায় ছেদ পড়ে। মোবাইল বাজতেছে। কে ? কে?
৫.
এতোকাল পরে রাজীব কী চায়? ফোন ধরতে মন চায় না। তবুও কোথায় যেন একটা টান অনুভব করে, কোথায় যেন একটি সূত্র ইকোয়েশান চায়! নিজের অজান্তেই হাত বাড়ায় , ফোন পিকআপ করে।‘তুমি ফিরে এসো।’ নিবেদিতার কান গরম হয়ে যায়। খুবই শান্ত স্বরে বলে, নো এন্ড নেভার।
রাজীব ফোন ধরে বসেই আছে নিবেদিতা ফোন হাতে চুপচাপ চোখের জলে ভাসছে। এ জল কার জন্য রাজীব নাকি সৈকত?
দু’জন মানুষ একসাথে থাকার জন্য কেন সামাজিক স্বীকৃতি লাগে তা নিবেদিতার মাথায় আসে না। যারা থাকবে তারাই ভাবুক তাদের ভালো মন্দ। রাজীব কোন অধিকারে আবার তাকে ফিরে যেতে বলে? না না সে যাবে না। জলুক এ জীবন পাওয়া না পাওয়ার বেদনায়… থাকুক হাহাকার জীবন জুড়ে। তবুও নিজের সত্ত্বাকে আর বিসর্জন নয়। সৈকতের সাথে সে ভালো আছে। যদিও সৈকত তার হাতে জনসম্মুখে রিং পরায়নি তবুও সে আছে হৃদয়ে দেহে মনে। মানুষের রক্তচক্ষু তার কোন কাজে আসবে ! সুতরাং নো মোর রাজীব! যে টুকু প্রেম তার জন্য জেগেছিলো সেটুকুও আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছে। যে দিনগুলোতে নিবেদিতা আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করেছে সেদিনগুলো বজ্রাহত পাখির মতো ডানা ঝাঁপটে মরেছে! আজ কেন আবার আগুন উসকে দেয়া!
সৈকতের সাথে নিবেদিতা ভালো সময় কাটায় এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও সত্য সে ভয়ে থাকে। হারানোর ভয়ে নাকি অধিক পাবার ভয়ে বুঝতে পারে না। যতোক্ষণ তার সাথে থাকে নিবেদিতার সময় তরতর কেটে যায়। সামনে থেকে সরলেই কী এক আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসে। এখানেই হয়তো সামাজিক স্বীকৃতির একটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হয়তো এ অধিকারেই রুবিনা তার স্বামীকে রাস্তা থেকে কান ধরে ঘরে এনে সাবান মেখে গোসল করায়। হয়তো এ কারণেই রুবিনাও চিৎকার করে, বাজার করবি না কেন? যা বাজার নিয়ে আয়। প্রচন্ড মারপিট করে আবার খুসনুটিতে মেতে ওঠে। না থাকুক প্রাচুর্য আছে এক ধরণের প্রেম এক ধরণের মোহ পরস্পরের জন্য। এই সূঁতোটুকুই দরকার জীবনের জন্য।
৬.
আজ কতো দিন হলো সৈকত নেই। নানান কাজে বিজি সৈকতের কবে সময় হবে? কবে! ফিরে আসবে? সারা দিনের সকল কাজের মাঝে সৈকত একাই তার সময় জুড়ে বিরাজ করে। হাজারো ব্যস্ততায় সৈকত তার জীবনীশক্তি হয়ে মিশে থাকে। কী চায় সৈকতের কাছে? না কিছু না। শূন্য এ জীবনে সস্তান এক নিগূঢ় সত্য। একটি সন্তান চায়? যাকে ঘিরে নিবেদিতার সময় কেটে যাবে। যার জন্য সে আরো বেশি পরিশ্রম করবে। তার কোম্পানীকে সে ধীরে ধীরে বিস্তৃত করবে। সততা আর পরিশ্রম থাকলে একদিন সে ঠিকই দাঁড়াবে। এ দেশ মাটির । মাটি কখনো মিথ্যা কথা বলে না। মাটি কখনো মুখ ফেরায় না। ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের সময় কতো মানুষ না খেয়ে মরেছে। কতো মানুষের ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস হয়েছে! সে সব ভাবতে চায় না। আমাদের দেশেও তাই । মাটি রেখে সবাই মিল কারখানা নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু নিবেদিতা মাটিকেই করেছে জীবনের আরেক ব্রত। ইচ্ছা থাকলে শূণ্য হতেই পূর্ণ হওয়া যায়। রাজীবের প্রাচুর্য সে প্রত্যাখ্যান করেছে। একাই সংগ্রাম করছে। সৈকতকেও এ সংগ্রামে রাখেনি। থাকুক সে সকল কিছুর উর্ধ্বে। কেবলই প্রেমে আর ভালোবাসায়।
কিন্তু সব সময় সব কিছু সত্য হয় না। নিবেদিতা যাকে আগুন ভাবে সে আসলে আগুন কী? যাকে ভালোবাসে এতো তীব্র সে আসলে বাসে কী? রাজীব যেমন বৈভব আর নারী বেষ্টিত ছিলো তেমনি সৈকতও কী নয়? নিবেদিতার সাথে দুর্দান্ত ইনিংস এর পর কোথায় ফোন করে, কার সাথে কথা বলে জানতে চায় না। কিন্তু মন বলে জানতে চাও? ভালোবাসায় অন্য কারো উপস্থিতি কাম্য নয়। সেদিন রাতের কথা ভুলতে পারে না। প্রচÐ উত্তাপে পুড়ে ভষ্ম হবার পর সৈকত পাশের ঘরে বিশ্রাম নিতে যায়। নিবেদিতার ভালো লাগেনি। তবু ব্যক্তি সত্ত্বাকে সম্মান জানাতে হয় ভেবে চুপচাপ ছিলো। অনেকক্ষণ পর নিবেদিতা দেখতে যায় কেমন আছে সৈকত, সে বুঝতে পারে কারো সাথে সৈকত চুপিসারে কথা বলছে।
অনড়- স্থির- পাথর হয়ে বসেছিলো অনেকক্ষণ। চোখে তখন আষাঢ় মাস। কোন প্রেমে সৈকত তাকে বেঁধেছে! সেখানে অন্য কারো উপস্থিতি কী ভাবে সম্ভব! বিস্ময়ে নিবেদিতা স্তব্ধ হয়ে যায়। সৈকতকে কিছুই বলেনি। জীবন যারে বঞ্চিত করে সৈকত তাকে কী করবে! যতোদিন আসে যতোবার আসে আসুক কিছুই বলবে না। নিবেদিতা জানে খোলা জানালায় সবটুকু আলো আসে না। আলোর জন্য দরকার ঘর ছেড়ে বের হওয়া। যেমন সামাজিক বন্ধন তার সাথে বেঈমানে করেছে তেমনই ভালোবাসাও তার সাথে করেছে বেইমানি। নিবেদিতা নিজেকে শীতল করে ফেলে। এন্টার্কটিকায় এতো বরফ নেই যতো বরফ জমে আছে তার অন্তরে। দিশোহারা নিবেদিতা সৈকতকে ছেড়ে চলে যাবে নাকি সৈকত তাকে ছেড়ে যাবে!
সে রাত নিবেদিতার একাই কাটে। আকাশ বাতাস সব যেন মিথ্যে হয়ে ধরা দেয়। এ কেমন জীবন! এ কেমন যাপন! যেখানে যাকেই বিশ্বাস করেছে সেই ঠকানোর জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় সৈকতের হুঁস ফিরে অন্ধকারে নিবেদিতা তার পাশেই বসে তার প্রেমের গুঞ্জরণ শুনছে। থতমত সৈকত যেন এক্সকিউজ দিতে চায়। নিবেদিতা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। উন্মাদের মতো হাসি। হাসির তোড়ে সৈকত উড়ে যায়। নেই ভোরেই সৈকত ছেড়ে আসে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’। নিবেদিতা হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে যায় । যে প্রেম সৈকতের হৃদয় স্পর্শ করেনি সে প্রেম নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলা উচিত কী? সে দিনই নিবেদিতা নিরক্ষরেখায় ছেদটানে জীবন সবার জন্য নয়। তার দরকার একটি শিশুকানন, শতশত শিশুর স্বপ্নবোনা দিঘি যেখানে চলবে হাজারো ময়ূরপঙিক্ষ, ডিগবাজি খাবে পানকৌড়ি।
শাহানা সিরাজী
ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ)
পিটিআই মুন্সীগঞ্জ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক