করোনাকালীন সাংবাদিকতা ও পেশার ভবিষ্যৎ – মোল্লা জালাল

করোনাকালীন সাংবাদিকতা ও পেশার ভবিষ্যৎ – মোল্লা জালাল

বলাই হয়, সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। কেন ঝুঁকিপূর্ণ ? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, এখানে জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, মহামরি যা-ই হোক একজন সরকারি কর্মচারী মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ পান। চাকরি শেষে অবসরকালেও তারা পেনশন পান। ফলে কর্মক্ষম থাকার সময় থেকে শুরু করে কর্মহীন অবস্থায়ও সরকারি কর্মচারীদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকদের নেই। যে যত বড় প্রতিষ্ঠানেই কাজ করুন না কেন, তিনি যত মেধাবী হোন না কেন, কখন কী কারণে চাকরি যাবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। আবার চাকরি করলেও কবে কখন কোন তারিখে কোন মাসের বেতন পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।
তবুও সাংবাদিকদের কলম চলে, ক্যামেরা কথা বলে। সমাজের নানা অনিয়ম-অনাচারের চিত্র তুলে ধরার কারণে অনেকের অকালে জীবনও যায়। তারপরও সাংবাদিকরা কাজ করেন, করে যাচ্ছেন নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধ বিগ্রহ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়েও সাংবাদিকরা ঘরে বসে থাকেন না। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সঠিক তথ্যের সন্ধানে বেরিয়ে যান। খবর সংগ্রহ করে দেশ ও জাতিকে জানান।
তাই সাংবাদিকরা ব্যক্তি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও তাদের কাজ মূলত রাষ্ট্রের জন্য। সে কারণেই সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলা হয়ে থাকে।
এখানেও প্রশ্ন থাকে, সাংবাদিকরা যদি রাষ্ট্রের জন্যই কাজ করে তবে রাষ্ট্র কেন তাদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় না। দেয় না এ কারণে, রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত লোকজন রাষ্ট্রের কর্মচারী। রাষ্ট্র পরিচালনাকারি সরকারের ইচ্ছানুযায়ী তাদের কাজ করতে হয়। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী হয়ে যেতে পারে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা তা দেখলেও সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না। এক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা সাহসিকতার সাথে সকল অনিয়ম, অনাচার আর অবিচারের কথা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেন। সাংবাদিকরা যদি সরকারের বেতনভূক্ত কর্মচারী হন তবে এ কাজটি তারা করতে পারবেন না। এ কারণেই রাষ্ট্র সাংবাদিকদের বিবেকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।
করোনা সাংবাদিকদের নতুন কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। এই মহামারি থেকে জীবন রক্ষার জন্য বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে। এর মধ্যে রয়েছে, করেনটাইন, আইসোলেশন, লকডাউন, সোস্যাল ডিসটেন্স মেনটেইন, মাস্ক ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গরম পানি পান করাসহ আরো কিছু নিয়ম-কানুন। কারণ, এখানো পর্যন্ত এই মহামারির কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। সুতরাং ‘জীবন রক্ষার’ জন্য এসব নিয়ম মেনে চলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
অপরদিকে এই নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে যায়। কারণ, একজন সাংবাদিক যদি করেনটাইনে থাকে তবে তার পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। একজন সাংবাদিকের আইসোলেশনে থাকার মানে জেলে থাকার সামিল। লকডাউনের সামনে পড়লে সাংবাদিক কোনো অবস্থাতেই ঘটনাস্থলে যেতে পারেন না। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কোনো রিপোর্ট করলে সেটা হয় হোম মেইড। যা কারো কাম্য নয়। সোশ্যাাল ডিসটেন্স প্রকৃত সত্য জানার ক্ষেত্রে বড় বাধা। কারণ, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কী জানবে, কীভাবে জানবে। সবাই মাস্ক পড়ে থাকলে ভিকটিমকে চিনবে কীভাবে। অনেক রিপোর্টের ক্ষেত্রে ভিকটিম বা সোর্সকে চিনতে হয়। না চিনলে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতায় আস্থা থাকে না। শুধু মাত্র সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায় সাংবাদিকের কাজে তেমন কোনো অসুবিধার হওয়ার কথা নয়।
সারাংশে বলা যায়, করোনা মহামারির সময়ে একজন সাংবাদিক যদি নিজের জীবন বাচাঁনোর বিষয়কে প্রাধান্য দেন তবে তার দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যদি দায়িত্ব পালনকে মুখ্য বিবেচনা করা হয় তবে একজন সাংবাদিকের জীবন হয় মারাত্মক ঝঁকিপূর্ণ। মহামারির সময়ে অন্যকোনো পেশাজীবীর ক্ষেত্রে এ অবস্থা দেখা যায়নি।
ডাক্তার-নার্স,আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের লোক কারো ক্ষেত্রে এ ধরণের ঝুঁকি নেই। কারণ, তারা সবাই সরকারি কর্মচারী। তাদের জীবন-জীবিকার গ্যারান্টার রাষ্ট্র। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। কিন্তু সাংবাদিকরা থাকে অরক্ষিত। করোনাকালে কোনো গণমাধ্যমের মালিক পক্ষ তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি। দেয়নি জীবিকার নিশ্চয়তা। বরং বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সবাই জানে, করোনাকালে বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেও বহু সংবাদকর্মী বেতন-ভাতা পাননি। লক ডাউনের মধ্যে নিজ ব্যবস্থাপনায় অফিস আসতে যেতে হয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক সংকটের অজুহাতে বহু সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পথে বসতে বাধ্য হয়েছেন।
এবার এই করোনা মহামারির সময়ে সংবাদকর্মীদের পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার ক্ষেত্রে নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। কম-বেশি সকল পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা উপলব্ধি করেছেন, এ পেশার মানুষ কতটা অসহায়, নিরাপত্তাহীন।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় সাংবাদিকদের কর্মের স্বাধীনতাসহ জীবন-জীবিকার বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়। আবার এর উল্টোটাও আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সংবাদপত্রের তথা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও জীবন-জীবিকার সুরক্ষায় কতগুলো আইন ও বিধি-বিধান রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণাালয়ের কাজই হচ্ছে এগুলো দেখভাল করা। সরকারের যেমন সব কিছু দেখভাল করার দায়িত্ব তেমনি সাংবাদিক ইউনিয়নের কাজ কর্মরত প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়ে সোচ্চার থাকা। মালিক পক্ষ ইউনিয়নের দাবি না মানতে চাইলে প্রয়োজনে সরকারের ওপর প্রেসার সৃষ্টি করা যাতে সরকার বাধ্য হয় রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন মোতাবেক সংবাদকর্মীদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধে মালিকদের বাধ্য করতে।
সংবাদকর্মীদের রুটি-রুজির নিশ্চয়তা প্রদান ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে আইনি প্রতিনিধি হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়ন। ইউনিয়ন ক্লাব নয়। ক্লাবে মানুষ যায় টাকা খরচ করে আনন্দ-বিনোদন করতে। ইউনিয়ন সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। সাংবাদিক ইউনিয়ন এই আইনি অধিকার পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার খবরাখবর রাখতেন। তিনি জানতেন সাংবাদিকতা পেশার ঝুঁকির বিষয়গুলো। তাই তিনি ১৯৭৪ সালে `The Newspaper Employees (Serviccs & Condition) Act 74′ প্রণয়ন করে সাংবাদিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে রাষ্ট্রীয় আইনদ্বারা সুরক্ষিত করেন। ওই আইনের আলোকেই গঠন করা হয় ওয়েজবোর্ড। ঘোষণা করা হয় রোয়েদাদ। শুধু তাই নয়, জাতির পিতা সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, মানোন্নয়ন ও গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ’। পাশাপাশি প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধানসহ সাংবাদিকতার নীতিমালার আওতায় দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন,‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’।
সাংবাদিক ইউনিয়নের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রতি পাঁচ বছর পরপর সংবাদপত্র শিল্পের সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য ওয়েজবোর্ড গঠন করে। ওয়েজবোর্ড শুধুমাত্র একটি বেতন কাঠামো নয়। এটি রাষ্ট্রের আইন। এ আইনে সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতার অধিকারসহ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এই ওয়েজবোর্ড মানছে না। তারা অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো তাদের মর্জি মাফিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালাতে আগ্রহী। ফলে সাংবাদিকতা পেশায় ক্রমান্বয়ে নানা রকমের অনাচার, অবিচার ও দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে জাতির পিতাকে হত্যার পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিকতাকে পণ্য হিসেবে বেচা-কেনার বাজারে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
এ কাজে সামরিক শাসকরা সাংবাদিকতার মানদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সংবাদপত্র জগতে দালাল শ্রেণীর জন্ম দেয়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় সাংবাদিকদের মধ্যে দলাদলি, লবিং গ্রুপিং শুরু হয়। সরকারি সুযোগ-সুবিধার লোভ-লালসা সাংবাদিকদের দলদাস ও এই পেশাকে লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত করে। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সংবাদপত্র শিল্পে শুরু হয় বেসুমার লুটপাট। শত ফুল ফুটতে দেওয়ায় যুক্তিতে দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সংবাদপত্রের মালিকানা। লেখাপড়া নেই, নেই ভাষা জ্ঞান, নিজের নাম লিখতে অক্ষম, ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না, এমন সব লোক রাতারাতি হয়ে যায় গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক-প্রকাশক।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্সসহ উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান না। ফলে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি।
বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণ করা রীতিমত গবেষণার বিষয়। অপরদিকে সংবাদপত্রকে বানানো হয়েছে ‘গণমাধ্যম শিল্প’। আমার বিবেচনায় শব্দগত দিক থেকে সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা আর গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীর মধ্যে পার্থক্য আছে। ‘সাংবাদিককতা’ শব্দে পেশাগত মর্যাদার একটা বিষয় আছে। কিন্তু ‘গণমাধ্যমকর্মী’ শব্দে তা নেই। এতে কেমন যেন কর্মচারী কর্মচারী ভাব রয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সাংবাদিকদের ‘সাংবাদিক’ হিসেবেই জানেন এবং সম্মান দেন। তা সত্ত্বেও নানা অজুহাত ও যুক্তি দেখিয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় সাংবাদিকদের মান-মর্যাদা ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ কাজগুলো করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
বর্তমানে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম শিল্পে বহু পক্ষের আবির্ভাব ঘটেছে। মালিক, সম্পাদক, প্রকাশকদের অনেক দল, অনেক গ্রুপ। এসব দল আর গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের জন্য। কারণ, সংবাদপত্র শিল্প বর্তমানে একটি লাভজনক ব্যবসায়ী খাত। তাই সারাদেশে হাজার হাজার পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন। তার সাথে এখন যোগ হচ্ছে, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর %A

scroll to top