একটি ট্রলার ও দুটি জীবন

PicsArt_07-10-01.25.50.jpg

একটি ট্রলার ও দুটি জীবন।

পুলিশের চাকরির এই দীর্ঘ জীবনে অনেক হত্যাকাণ্ডই দেখেছি। কিন্তু কিছু কিছু হত্যাকাণ্ড এমনই হয় যে মনে দাগ কেটে যায়। মনে প্রচন্ড কষ্টের অনুভূতি জন্ম দেয়। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করি কি দোষ ছিল এই অসহায় মানুষগুলোর? কেন মানুষ তার নিজের বিবেক বুদ্ধি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে বারবার? আমাদের এই জীবনে যদি রিওয়াইন্ড এর কোন সিস্টেম থাকতো তাহলে হয়তো অসহায় মানুষগুলোকে সতর্ক করে দিতে পারতাম! মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করুন।

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানায় গত ৩ জুলাই একটি ডাবল মার্ডারের ঘটনা ঘটে। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার কলারদোয়ানিয়া গ্রামের মোহাম্মদ হেলাল এবং ইয়াসিন সম্পর্কে বাবা- ছেলে।বরিশাল নদী বিধৌত অঞ্চল হওয়ায় এখানকার অধিকাংশ লোকজনই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে । তাই এখানে মাছ ধরার সরঞ্জামাদির চাহিদা প্রচুর।হেলাল এবং ইয়াসিন মাছ ধরার চাঁই তৈরি করে এবং সেগুলো বিভিন্ন হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে থাকে। যেহেতু নদী বিধৌত অঞ্চল তাই নদীপথে হচ্ছে তাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম । তারপরও যেহেতু নিতান্তই দরিদ্র ঘরের মানুষ তাই নিজের ট্রলার না থাকায় অন্যের কাছ থেকে ট্রলার ভাড়া করে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করে থাকে। আর এই ট্রলার ই হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য কাল।

বাকেরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ৩ জুলাই সন্ধ্যা সাতটার দিকে একটি ফোনকল পায়। কলার তাকে জানায় যে চরলক্ষীপাশা এলাকায় খেয়া ঘাটের পাশে একটি বাগানে ২০ বছরের অজ্ঞাতনামা এক যুবকের গলাকাটা মৃতদেহ পড়ে আছে। সাথে সাথে বাকেরগঞ্জ থানা পুলিশ সেখানে যায় এবং পুলিশি কর্মকান্ড শেষে লাশ টি কেও শনাক্ত করতে না পারায় থানায় নিয়ে চলে আসে।পরের দিন সকাল সাতটায় আবারো বাকেরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আর একটি ফোনকল পায় এবং তাকে জানানো হয়েছে গত কালকের ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পাশেই একটি নদীতে আরো একটি লাশ পাওয়া গেছে । দুই পাশের কোমরে ছুরির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।থানা পুলিশ সেখানে যায় এবং আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পিরোজপুর নিবাসী এক ব্যক্তি এখানে এসে লাশটিকে শনাক্ত করে এবং বলে যে এটি তার ছোট ভাইয়ের লাশ। তিনি জানান গত শুক্রবার দুপুর বারোটার পর থেকে তার ভাই হেলাল এবং তার ছেলে ইয়াসিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা সংশ্লিষ্ট সাতরাজ বাজারে চাই বিক্রি করার জন্য এসেছিল । হেলালের লাশের সাথে তার ভাইকে থানায় নিয়ে আসার পর তিনি আইডেন্টিফাই করে এটি তার ভাইয়ের ছেলে ইয়াসিনের লাশ। তিনি আরো জানান গত ২৭ জুন তার ভাই হেলাল এবং তার ছেলে ইয়াসিন কিছু চাই তৈরি করে একটি ট্রলার ভাড়া করে বরিশালের বাকেরগঞ্জে বিভিন্ন বাজারে চাই বিক্রি করতে এসেছিল।

হত্যাকাণ্ডটি খুব নির্মমভাবে করা হয়েছিল। তাই প্রথমেই আমাদের মনে হয়েছিল এটি হয়তো পারিবারিক কোনো বিরোধ বা চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ অথবা নারী ঘটিত কোন বিষয় হতে পারে।পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার কলার দোয়ানিয়া গ্রামে ভিকটিমদের এলাকায় আমরা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি যে ব্যক্তিরা নিতান্তই অসহায় এবং দরিদ্র ঘরের লোক । কারো সাথে তাদের কোন বিরোধ বা নারীঘটিত কোন কিছু ছিল না । এলাকার সবার সাথেই চমৎকার সম্পর্ক ছিল। ভিকটিমের ভাইয়ের সাথে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারি চাই বিক্রি করার কিছু টাকা হয়তো তাদের সাথে থাকতে পারে । তবে তারা যে ট্রলারটি ভাড়া করে নিয়েছিল সেটিও নিখোঁজ।এবং তার দাম মার্কেটে ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকা।তখনই আমরা ধারণা করতে পারি যে হয়তোবা এই ট্রলার অথবা টাকার জন্য তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ট্রলারের সাথে সাথে ভিকটিমের মোবাইল এবং তার পরিধেয় কিছু কাপড়চোপড় ও নিখোঁজ ছিল।

বরিশাল জেলার সুযোগ্য পুলিশ সুপার জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম বিপিএম (বার) স্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ভিকটিমের ভাইয়ের সাথে কথা বলেন এবং আমাকে বলেন যে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড যারাই ঘটিয়ে থাকুক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। খুব দ্রুতই তাদের খুঁজে বের করো। বাকেরগঞ্জ সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ অত্যন্ত মেধাবী অফিসার । আমরা দুজনে মিলে হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খোঁজা শুরু করলাম । হত্যাকাণ্ডের সময় দুপুরবেলা চরলক্ষীপাশা খেয়া ঘাটের নৌকার মাঝি একটি ট্রলারে করে ৪/৫ জন লোককে দেখেছিল এখানে নামতে। এবং ওই সময় নদীতে গরু গোসল করানো অবস্থায় একজন ব্যক্তি ও দেখেছিলেন ৪/৫ জন লোক সহ একটি ট্রলার এখানে থামিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে তদন্ত ওই দুজনকে দিয়েই শুরু করলাম। এবং জিজ্ঞাসাবাদের লক্ষ্যে থানায় নিয়ে আসলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তারা তেমন কোন তথ্য দিতে পারল না । শুধু বলল যে চার থেকে পাঁচ জন লোক ছিল । ঘাট থেকে একটু দূরে ভিরেছিল এবং ট্রলার থেকে চাই নামাচছিল। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ এর সহযোগিতায় আমরা আসামিদের অবস্থান জানার চেষ্টা করতে থাকলাম।

আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ট্রলারটি কে টার্গেট করে আসামিরা হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে।তাই তারা ট্রলারটি নিয়ে কোথাও বিক্রি করার চেষ্টা করবে । তবে অবশ্যই অত্র এলাকায় এটি তাদের জন্য সহজ হবে না । কারণ ট্রলারটি চুরি হয়েছে এবং একটি ডাবল মার্ডার হয়েছে। তাই এত সহজে এখানে বিক্রি করতে পারবেনা ।তাহলে অবশ্যই তারা এটি ঢাকার দিকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করবে। এবং আসামিরা কিছু ভুল করেছিল। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে তেল সংগ্রহ করে ছিল। যেহেতু ঢাকায় যেতে হবে লম্বা সময়ের দরকার ।তারা বিভিন্ন জায়গায় নেমেছিল তেল সংগ্রহ করার জন্য- খাবার জন্য। আমরা আমাদের সোর্সের মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছিলাম এবং সর্বোপরি আমরা নিশ্চিত হলাম যে তারা ঢাকায় যাচ্ছে। আমরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করলাম তারা ঢাকার সদরঘাট এলাকায় তেলঘাট নামক স্থানে অবস্থান করছিল। ট্রলার বিক্রি করার জন্য দালাল খোঁজ করছিল ।আমরা তখন ঢাকা জেলা পুলিশের দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার সাথে যোগাযোগ করি এবং তাদের সহযোগিতায় শেষপর্যন্ত ট্রলারসহ ওই তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই।

আটককৃত আসামি তাদের প্রত্যেকেরই বাড়ি বাকেরগঞ্জ থানার গো মা এলাকায় । মূল পরিকল্পনাকারী হল বাদশা (৩৮)। এবং সহযোগী হল শাহিন(২৫) ও সানি (১৬)। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ও কোন তথ্য বের করতে পারলো না । অফিসার ইনচার্জ আমাকে ফোন দিয়ে জানালো স্যার ওরা কঠিন মাল। কোন কিছুই স্বীকার করছে না। আমি বললাম দ্রুত বরিশালে পাঠিয়ে দিন তোতাপাখির মত কথা বলা শুরু করবে। মজার ব্যাপার হলো মামলার আসামি সানি ছিল অপ্রফেশনাল। জিজ্ঞাসাবাদের শুরু থেকে সে কাঁদতে শুরু করে । তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এমনকি কোকাকোলা পর্যন্ত খেতে দিয়ে কান্না থামিয়ে অভয় দিয়ে মূল ঘটনা শুনি। আসামি শাহিন একটু চালাক প্রকৃতির। ক্রাইম পেট্রোল আর বিভিন্ন ক্রাইম সিরিজ দেখে দেখে একটু পেকে গিয়েছিল। সে ধরে নিয়েছিল ধরা পড়লে হয়তো পুলিশ তাকে মেরে ফেলবে বা ক্রসফায়ার দিয়ে দিবে । আমার রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার একটু পরেই সে তার প্যান্টে পায়খানা করে দেয় । তাকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে অভয় দিলাম কোকাকোলা অফার করলাম। সে জানালো সে এসমস্ত বাজে ড্রিংকস খায় না ? বাদশা ছিল পুরো প্রফেশনাল।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সব তথ্য একসাথে করলে এরকম দাঁড়ায় বাদশা হলো মূল পরিকল্পনাকারী । সে চার পাঁচ দিন আগে শাহিন এবং সানিকে একটি প্রস্তাব দেয়। সে বলে করুনার কারণে তো বর্তমানে আমাদের কারোই কোন কাজ নেই । একটা কাজ যদি তিনজনে মিলে করতে পারি তাহলে অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। কিন্তু কাজটি কি ছিল তা সে প্রকাশ করে নাই।
বাদশা কয়েকদিন আগে থেকেই ভিকটিম হেলালকে নজরে রাখে । তার দৃষ্টি পড়ে ট্রলারটির উপরে । বাদশা ভিকটিম হেলালকে জানায় তার ৪০ পিস চাই লাগবে। তবে এই চাই গুলোকে তার ট্রলার দিয়ে একটু তার বাড়ি চর লক্ষীপাশা এলাকায় পৌঁছে দিতে হবে। বিনিময় যাতায়াত খরচ সে দিয়ে দিবে । তার এই কথায় সহজ-সরল হেলাল মেনে নেয় এবং তার ছেলে ইয়াসিনকে সহ শুক্রবার দুপুর 12 টার দিকে বাদশা শাহিন এবং সানিকে নিয়ে তারা পাঁচজন একসাথে যাত্রা করে। চর লক্ষীপাশা এলাকায় পৌঁছার পর তারা দেখে খেয়াঘাটে মানুষ। তাই তারা একটু আগেই ট্রলারটি ভিরায়। ওখানে নেমে বাদশা হেলাল কে বলে আপনি চাই গুলো নিচে নামিয়ে রাখুন। আর সানি ও শাহীনকে নির্দেশ দেয় ভিকটিম ইয়াসিনকে উপরে নিয়ে যেতে। ওখানে তাদের টাকা দেওয়া হবে । সরল বিশ্বাসে তার ছেলেকে শাহীন এবং সানির সাথে যেতে দেয়। শাহীন এবং সানি তাদের দুজনের মাঝখানে ইয়াসিনকে নিয়ে হাঁটতে থাকে । হাঁটতে হাঁটতে পাশেই একটি বাগানের ভিতর প্রবেশ করে আর ওই মুহূর্তে বাদশা তাদের পিছনে পিছনে গিয়ে হঠাৎ করে পিছন দিক থেকে ইয়াসিনের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। সাথে সাথে ইয়াসিনের গলা কেটে যায় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে এবং সে মাটিতে ঢলে পড়ে । ওই সময় তার শরীর লাফাতে থাকলে শাহিন এবং সানি তার পা মাটিতে চেপে ধরে রাখে। কিছুক্ষণের ভিতরে ইয়াসিনের মৃত্যু হয় । এরপর তারা তিনজন ওখান থেকে নদীর ধারে যায়।শাহিন চাঁই নামাতে থাকা হেলালকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেয় এবং তার মাথাটা পানির নিচে ধরে রাখে। বাদশা হেলালের কোমরের দুই পাশে ছুরি চালাতে থাকে। কিছুক্ষনের ভিতর হেলালের মৃত্যু হয়। তার লাশটি ওরা পানিতে ডুবিয়ে দেয়। তারপর ওখান থেকে ভিক্টিমের পকেটে থাকা 3500 টাকা, ভিকটিমের মোবাইল, পরিধেয় কাপড় এবং ট্রলারটি নিয়ে ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

এই ছিল বাকেরগঞ্জ থানার ডাবল মার্ডার মামলার মূল রহস্য। শুধুমাত্র একটি ট্রলারের লোভে পড়ে তাদের হাতে দুটি নিষ্পাপ জীবন শেষ হয়ে গেল।বর্তমান সময়ে নিরাপদ থাকতে হলে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে সতর্ক থাকার ব্যবস্থা করতে হবে পরিবারের লোকজন কোথায় যায় কার সাথে থাকে কি করে সবসময় খোঁজখবর রাখতে হবে বিশেষ করে সানির মত অল্প বয়সের ছেলেরা যেন খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবন নষ্ট না করে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।হেলালের পরিবার আজ অসহায় হয়ে গেল। এমনিতেই দরিদ্র ছিল তার উপরে পরিবারের দুজন কর্মক্ষম লোকের এরকম হত্যা পরিবারটিকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে গেল।আমরা সবাই সচেতন হই ।পরিবারকে রক্ষা করি । নিজেকে রক্ষা করি । সব সময় আইন মেনে চলি এবং পুলিশকে সহায়তা করি করি।

লেখক
নাইম নিপু
সহকারী পুলিশ সুপার
বরিশাল জেলা পুলিশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top