প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে একজন ইউএনও’র ভূমিকা

Uno.1-1.jpg

মোঃ আঃ কুদ্‌দূস, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বোরহানউদ্দিন, ভোলা।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা পর্যায়ের প্রায় সকল কমিটির সদস্য। ক্ষেত্র ভেদে তিনি অধিকাংশ কমিটির সভাপতি অথবা সদস্য-সচিব। এসব কমিটির সভায় মূলত উপজেলার সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রাথমিক শিক্ষা একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলভিত্তি।

কারণ, প্রাথমিক স্তরে নতুন প্রজন্মের শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে পরবর্তী শিক্ষা জীবনে তা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়ে। শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, কাবিং কার্যক্রম, খেলাধুলা ও নৈতিকশিক্ষা কার্যক্রমে কোমলমোতি শিশুদেরকে সম্পৃক্ত করা না গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আলোচ্য নিবন্ধে একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে তার একটি ধারাবাহিক আলোচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।

 

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোনা জাতি উন্নতির শেখড়ে পৌঁছতে পারে না। শিক্ষকগণকে মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়ে থাকে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার মান উন্নয়নে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য তুলে ধরে শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। ফলে শিক্ষক নির্দেশিকা মোতাবেক যথাযথভাবে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি নিশ্চিত হবে।

এছাড়া শহরের বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় গ্রাম অঞ্চলে প্রতিবছর ২০% শিশু ঝড়ে পরে এবং তারা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা হতে বঞ্চিত হয়ে জাতির জন্য সম্পদ না হয়ে সমাজের বোঁঝা হয়ে দাঁড়ায়। এই সকল বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কোমলমোতি শিশুরা না খেয়ে দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করলে শিশুরা আনন্দের সাথে পাঠদান গ্রহণ করবে এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হবে।

এতে করে ঝড়ে পারা শিশুদের হার হ্রাস পাবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সমাজের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বচ্ছল ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী, বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং এসএমসি এর আর্থিক সহায়তা নিয়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল কার্যক্রম চালু করতে পারেন। এতে ঝড়ে পড়ার (Drop Out)এবং বিদ্যালয় ত্যাগের হার দ্রুত হ্রাস পাবে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা দুপুরের বিরতির পরবর্তী ক্লাসসমূহে মনোযোগ দিতে পারবে।

নতুন প্রজন্মের শিশুদের বিদ্যালয়মূখী করার জন্য অভিভাবকদের ভূমিকা মূখ্য। কিন্তু আমাদের গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকরা এ ব্যাপারে খুব সচেতন নন। তারা শিশুদেরকে তাদের পেশার কাজে সহায়তাকারী হিসেবে নিয়োগ করে দ্রুত সন্তানের উপার্জন ফল পেতে অভ্যস্ত। অবশ্য এক্ষেত্রে তাদের দারিদ্রতাও কম দায়ী নয়।

তাই  শিক্ষার উন্নতিকল্পে অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উদ্যোগে প্রতিটি বিদ্যালয়ে সময়ে সময়ে অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করা যেতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ের উপস্থিতি হওয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করতে পারেন। একই সাথে তিনি বিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা/শিক্ষার উন্নতি কল্পে বিভিন্ন মতামত/প্রস্তাব গ্রহণ করে আশু সমাধানের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

শিক্ষা জীবনের শুরুতেই যাতে আমাদের শিশুরা নকলের অভিশপ্ত পাঠ গ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নকলমুক্ত পরিবেশে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরীক্ষা গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন। কারণ, পরবর্তী জীবনে এই পরীক্ষার পরিবেশ তাদের কিশোর মনের দাগ কাটবে। এছাড়া পরীক্ষার শেষে যথাযথ খাতা মূল্যায়নের মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ফলাফল নির্ধারণের শিক্ষকগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।

এতে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।  এতদ্ব্যতীত শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিল্পকলা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করার জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। মাঝে মাঝে তিনি স্বয়ং এসব প্রোগ্রামে হাজির হতে পারেন। এতে করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শিশুকাল হতেই সুস্থ, সুন্দর ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার মন-মানসিকতা তৈরি হবে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিটি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। যে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যত সুন্দর সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানও ততটা সুন্দর হবে এটাই স্বাভাবিক। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিভাবকদের বসার ছাউনি, বিদ্যালয়ের সম্মুখে ফুলের বাগার সৃজন, আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কারকরণ, বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছের চারা রোপন করার জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পভুক্ত করে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহকে সহায়তা প্রদান করতে পারেন।

এছাড়া শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী ভবন, কক্ষ, চেয়ার, টেবিল, টুল বেঞ্চ, হোয়াইট বোর্ড, ফ্যান, পানির ফিল্টার, ফুলের টপ, সংযোগ সড়ক, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, মাঠ ভরাট, টয়লেট নির্মাণ ও টিউবওয়েল স্থাপন প্রভৃতি সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এসব বিষয়ে প্রয়োজনে আর্থিক বরাদ্দের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করতে পারেন।

একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলোস্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলাপরিস্থিতি। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকলে শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা সম্ভব হয়। উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাদক, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ নিরোধ ইত্যাদি আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিদ্যালয়গামী শিশুদের সাথে আগত তাদের মা, বোন, কাজের লোক এবং মহিলা শিক্ষকগণ যাতে ইভটিজিং, ধর্ষণ ইত্যাদির ভয়ভীতি হতে মুক্ত থেকে নিরাপদভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন- এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

তাছাড়া বিদ্যালয়ের জায়গা জমি-নিয়ে স্থানীয়ভাবে কোন সমস্যা দেখা দিলে উক্ত সমস্যার সমাধানে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়া শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাবিং কার্যক্রম একটি ফলপ্রসূ পদক্ষেপ। প্রতিটি বিদ্যালয় কাবিং কার্যক্রম থাকা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর পূর্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলন কালে দৈনিক সমাবেশ এবং শারীরিক কসতর বাধ্যতামূলক করা এবং বছরে ১ বার ‘তাবু জলসা’ এর আয়োজন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ। কাবিং কার্যক্রমের সভাপতি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিশুদেরকে এতে সম্পৃক্ত করে দলগতভাবে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমাজে একত্রে বসবাস করার মনমানসিকতা তৈরি করতে পারেন।

প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সকল পাঠ্যবই সরকারিভাবে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়ে থাকে। তাই প্রতিবছর ১লা জানুয়ারি শিশুদের হাতে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছানোর বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশ্চিত করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের কাছে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছানো নিশ্চিত হলে শিশুরা সানন্দে বিদ্যালয়গামী হবে এবং পড়াশুনায় মনোযোগী হবে। তাই বই বিতরণে যাতে কোন প্রকার অনিয়ম না হয় সে বিষয়ে ইউএনও-গণ উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে কঠোর তদারকির ব্যবস্থা করতে পারেন। তাছাড়া বই সংরক্ষণ করার জন্য গুদাম ঘরের অপ্রতুলতা প্রায় প্রতিটি উপজেলায়ই বিদ্যমান। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ লক্ষ রাখলে সহজেই এই সমস্যা সমাধান করা যায়।

সর্বোপরি, প্রাথমিক সমাপনী/বার্ষিক পরীক্ষায় বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রতিবছর উপজেলা পর্যায়ে সমাজের দানশীল ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে সম্মাননা দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ। উপজেলার স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ,রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক এবং শিক্ষকগণের সমন্বয়ে এই সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এতে বিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীগণ পড়াশুনায় মনোযোগী হবে এবং ভালো ফলাফল অর্জনে বিদ্যালয়সমূহের মাঝে ইতিবাচক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে,  উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রায় সকল কাজের সমন্বয় সাধন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাই প্রতিটি উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নে একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে ভবিষ্যতের কর্ণধার এই নতুন প্রজন্মের শিশুদের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি দেশের সকল ইউএনও-গণ অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা রাখবেন-এমনটাই প্রত্যাশা।

মোঃ আঃ কুদ্‌দূস, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বোরহানউদ্দিন, ভোলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top